পথে পথে গাড়ি তল্লাশি, ভোগান্তিতে সাধারণ মানুষ
৪ আগস্ট ২০১৮ ১৮:৩৬
।। স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট ।।
চট্টগ্রাম ব্যুরো: চট্টগ্রাম নগরজুড়ে পথে পথে গাড়ি থামিয়ে তল্লাশি করা হচ্ছে। একেকটি গাড়ি চলতি পথে পাঁচ-সাতবারেরও বেশি তল্লাশির মুখে পড়ছে। পুলিশ-সাংবাদিক কিংবা সরকারি গাড়ি দেখলেই হুমড়ি খেয়ে পড়ছেন শিক্ষার্থীরা। মাঝে মাঝে পুরো সড়কজুড়ে বসে থামিয়ে দেওয়া হচ্ছে গাড়ি চলাচল। এতে তীব্র যানজট সৃষ্টি হচ্ছে নগরীর ব্যস্ততম সড়কগুলোতে। আটকা পড়ছে রোগীদের বহনকারী অ্যাম্বুলেন্সও।
নগরীর বিভিন্ন সড়কে শনিবারও (৪ আগস্ট) ট্রাফিকের দায়িত্ব পালন করছেন ক্ষুদে শিক্ষার্থীরা। এক লাইনে গাড়ি চালাতে বাধ্য করছেন চালকদের। তবে শিক্ষার্থীদের এই তল্লাশি শুরুতে সহানুভূতি আদায় করতে পারলেও ধীরে ধীরে তা নগরবাসীর কাছে বিড়ম্বনায় পরিণত হচ্ছে। পথ চলতে যাওয়া নগরবাসীর কাছে এই কর্মকাণ্ড বিবেচিত হচ্ছে ভোগান্তি হিসেবে।
এর বাইরে ক্ষুদে শিক্ষার্থীদের এই আন্দোলন নিয়ে টানা-হ্যাঁচড়াও শুরু হয়েছে সক্রিয় বিভিন্ন ছাত্র সংগঠনের মধ্যে। আন্দোলনের ভেতরে ছদ্মবেশে ঢুকে পড়েছে ছাত্রশিবিরের কর্মীরা। জামায়াত নিয়ন্ত্রিত শিক্ষা প্রতিষ্ঠান হিসেবে পরিচিত আন্তর্জাতিক ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের সীতাকুণ্ড ক্যাম্পাস থেকে বাসে করে শিক্ষার্থীদের এনে ওয়াসার মোড়ে নামিয়ে দিতে দেখা গেছে। পুলিশ আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীদের ভেতর থেকে শিবির সন্দেহে পাঁচ যুবককে আটক করেছে।
পথে পথে তল্লাশি
সকাল ১১টা। নগরীর নিউমার্কেটের কাছে মিউনিসিপ্যাল মডেল হাইস্কুলের সামনে আনুমানিক ১০-১২ বছর বয়সী এক কিশোর একাই দাঁড়িয়ে গাড়ি থামাচ্ছিলেন। ওই কিশোর একাই ড্রাইভিং লাইসেন্স ও গাড়ির ডকুমেন্ট পরীক্ষা করছিলেন। আনুমানিক ৫০ জনের মতো ইউনিফর্ম পরা কিশোর মিছিল করছিলেন সে সময়।
নিউমার্কেট মোড় ঘিরে অন্তত চার পয়েন্টে চলছে তল্লাশি। একটি গাড়ি প্রতিটি পয়েন্ট অতিক্রম করতে গিয়ে তল্লাশির মুখে পড়ছেন। লাইসেন্স থাকলে অমোচনীয় কালি দিয়ে লেখা হচ্ছে ‘ওকে’। না থাকলে ‘ভুয়া’ ‘লাইসেন্স নেই’ এই ধরনের বিভিন্ন বাক্যের সঙ্গে অসংলগ্ন বিভিন্ন কথাবার্তাও লিখে দেওয়া হচ্ছে। এসব লেখা দিয়ে একবার তল্লাশির প্রমাণ পাওয়া গেলেও আবারও ভিন্ন পয়েন্টে বিভিন্ন গাড়িকে তল্লাশির মুখে পড়তে দেখা গেছে।
নিউমার্কেট থেকে টাইগারপাসের দিকে যাবার পথে অন্তত ৫-৭টি স্থানে দাঁড়িয়ে কিশোররা গাড়ির চালকের লাইসেন্স ও ডকুমেন্ট পরীক্ষা করতে দেখা গেছে। শুধু পরীক্ষা নয়, বিভিন্ন ধরনের প্রশ্ন করা হচ্ছে বাস, প্রাইভেট কার, সিএনজি অটোরিকশা, মাইক্রোবাসসহ বিভিন্ন যানবাহনের যাত্রী ও চালকদের।
বেলা ১২টার দিকে নগরীর ওয়াসা মোড়ে হেলমেটবিহীন অবস্থায় এক মোটর সাইকেল চালককে পেয়ে তাকে আটকে ফেলেন কয়েকজন শিক্ষার্থী। মুহুর্তের মধ্যে শ খানেক শিক্ষার্থী জড়ো হয়ে যায়। বিভিন্ন প্রশ্নে তাকে নাজেহাল করে একপর্যায়ে কান ধরে উঠবস করানোর নির্দেশ দেওয়া হল প্রায় ৫০ বছর বয়সী এই মোটর সাইকেল আরোহীকে। নগর গোয়েন্দা পুলিশের উপকমিশনার (বন্দর) মোহাম্মদ শহীদুল্লাহ ও পরিদর্শক মো. কামরুজ্জামান গিয়ে ওই ব্যক্তিকে নাজেহালের হাত থেকে রক্ষা করে নিরাপদে সরিয়ে নেন।
শহীদুল্লাহ সারাবাংলাকে বলেন, হেলমেট নেই, এজন্য তাকে ধরা হয়েছে এটা ঠিক আছে। কিন্তু কান ধরে উঠবস করানোর মতো নির্দেশনা দেওয়াটা উচিৎ নয়। যে ছেলেরা এই নির্দেশ দিচ্ছে, লোকটি তাদের বাবার বয়সী কিংবা তার চেয়েও বড়।
নগরীর ওয়াসা মোড়ে লাইসেন্স দেখিয়ে ছাড়া পাওয়ার পর একটি প্রাইভেট কারের চালক সারাবাংলাকে বলেন, ‘চকবাজার থেকে আসছিলাম। চকবাজারে একবার, দিদার মার্কেটে একবার, আন্দরকিল্লায় একবার, ওয়াসার মোড়ে আরেকবার গাড়ি থামিয়ে কাগজপত্র পরীক্ষা করা হয়েছে। বারবার একই প্রশ্ন। ছোট ছোট ছেলে নানা ধরনের কথা বলছে। এটা তো হয়রানি ছাড়া আর কিছুই নয়।’
টার্গেট মিডিয়া-পুলিশ আর সরকারি গাড়ি
ওয়াসা মোড়ে এসেছিলেন চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসনের নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট সৈয়দ মোরাদ আলী। তার গাড়ি ঘিরে ধরে একদল কিশোর। গাড়িতে আঘাত করে ম্যাজিস্ট্রেটকে বের হয়ে আসার নির্দেশ দেন তারা। এ সময় কয়েকজন কিশোর বলে উঠে, ‘এসএসসি পরীক্ষার সময় আমাদের বহিস্কার করছিলা, মনে আছে ?’ চালকের কাছে লাইসেন্স চাওয়া হয়।
সৈয়দ মোরাদ আলী সারাবাংলাকে বলেন, কয়েকজন অশ্রাব্য ভাষায় গালি দিচ্ছিল। স্লোগানও দিচ্ছিল। আমার গাড়ির উপর নানান অশ্রাব্য কথা লিখে দেওয়া হয়েছে। পরে আমি গাড়ি চালিয়ে সেখান থেকে চলে আসি।
এই কিশোরদের দেখে সাধারণ ছাত্র মনে হয়নি বলে জানিয়েছেন জেলা প্রশাসনের এই কর্মকর্তা।
নগরীর আলমাস মোড় থেকে ওয়াসা পর্যন্ত আনুমানিক ১০০ গজ রাস্তা পার হতে দুইবার তল্লাশির মুখে পড়েন বিডিনিউজটোয়েন্টিফোর ডটকমের ফটোসাংবাদিক সুমন বাবুর মোটর সাইকেল। তার সঙ্গে ছিলেন প্রতিবেদক উত্তম সেনগুপ্তও। দুজনের মাথায় হেলমেট নেই কেন, ড্রাইভিং লাইসেন্স কোথায়, কেন তারা ওয়াসা যাচ্ছেন, সাংবাদিকের কী দরকার- এই ধরনের নানা প্রশ্নে নাজেহাল করতে থাকেন তাদের। দ্বিতীয় দফা তল্লাশির সময় সুমন বাবু তাদের প্রথমে একবার পরীক্ষা করা হয়েছে জানালে কিশোররা তাদের উপর চড়াও হন। এ সময় প্রিমিয়ার বিশ্ববিদ্যালয়ের এক শিক্ষার্থী বলেন, যতবার চাইব ততবার দেখাতে হবে।
ওয়াসার মোড়ে যাবার পথে নাজেহাল হন সময় টেলিভিশনের প্রতিবেদন শফিকুল আলমও। সময় টেলিভিশনের স্টিকার লাগানো গাড়িতে থাকার পরও তারা শফিকুলের কাছে প্রেস কার্ড দেখানোর জন্য তর্ক-বিতর্কে জড়িয়ে পড়েন।
আলমাস মোড়ে রাঙামাটি জেলা প্রশাসনের একটি গাড়ি দেখে সেটিকে ঘিরে ধরে বিভিন্ন ধরনের স্লোগান দিতে শুরু করেন শিক্ষার্থীদের একটি দল। চালকের লাইসেন্স না থাকায় পুলিশ ডেকে ওই গাড়ির চালকের বিরুদ্ধে মামলা দিতে বাধ্য করেন তারা।
নগরীর সিআরবি পুলিশ ফাঁড়ির সার্জেন্ট মো. রফিক সারাবাংলাকে বলেন, গাড়িটির যাতে কোনো ক্ষতি করতে না পারে সেজন্য মামলা দিয়ে দ্রুত গাড়িটিকে সরিয়ে দেওয়া হয়েছে।
অবশ্য শনিবার পুলিশের বিরুদ্ধে স্লোগান দেওয়া থেকে বিরত ছিলেন বিক্ষোভে জড়ো হওয়া শিক্ষার্থীরা। তবে পুলিশের গাড়ি দেখলেই হুমড়ি খেয়ে পড়ে লাইসেন্স ও ডকুমেন্ট পরীক্ষা করেছেন শিক্ষার্থীরা। এ ছাড়া অপেক্ষমাণ পুলিশ কর্মকর্তাদের মোবাইলে ছবি তুলতে এবং ভিডিও ধারণে ব্যস্ত দেখা গেছে শিক্ষার্থীদের বিভিন্ন গ্রুপকে।
বিক্ষোভে ঢুকে পড়েছে শিবির
শনিবার সকাল ১১টার দিকে বিক্ষোভ শুরু হয় ওয়াসার মোড়ে। এর আগেই ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের সীতাকুণ্ড ক্যাম্পাস থেকে দুটি বাসে করে দুই দফায় শিক্ষার্থীদের সেখানে এনে নামিয়ে দিতে দেখা গেছে। দুপুর আড়াইটার দিকে বিক্ষোভ কর্মসূচি শেষ হওয়ার পর আবারও বাসগুলো এসে সেখান থেকে শিক্ষার্থীদের নিয়ে যেতে দেখা গেছে। ওয়াসার মোড়ের পুরো বিক্ষোভ কর্মসূচিতে জামায়াত নিয়ন্ত্রিত আন্তর্জাতিক ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের ব্যাপক উপস্থিতি দেখা গেছে।
পুলিশ সূত্র জানায়, অপেক্ষমাণ পুলিশ কর্মকর্তাদের ছবি তোলা ও ভিডিও ধারণে ব্যস্ত শিক্ষার্থীদের তারা ছাত্রশিবিরের কর্মী বলেই সন্দেহ করছেন। জামায়াত-শিবিরের নির্দেশেই তারা এই কাজ করেছেন বলে মনে করছেন তারা।
তবে ছাত্রশিবিরের কর্মী সন্দেহ হলে অনেকে বিক্ষোভের ভেতর থেকেই প্রতিরোধের সম্মুখীন হয়েছেন। এই ধরনের পাঁচ যুবককে ধরে পুলিশের কাছে সোপর্দ্দ করা হয়েছে। তাদের মোবাইলে যুদ্ধাপরাধী দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর ছবি ও ওয়াজ মাহফিলের রেকর্ড পাওয়া গেছে।
নগর পুলিশের অতিরিক্ত উপকমিশনার (দক্ষিণ) শাহ মো. আব্দুর রউফ সারাবাংলাকে বলেন, পাঁচ যুবককে ধরে আমাদের কাছে দেওয়া হয়েছে। আমরা যাচাই বাছাই করে দেখছি।
কোতয়ালী থানার ওসি মোহাম্মদ মহসিন সারাবাংলাকে বলেন, ‘আজ আমাদের বিরুদ্ধে সেভাবে স্লোগান দেওয়া হয়নি। তবে আমরা কোথাও দাঁড়ালেই সেখানে এসে মোবাইলে আমাদের ছবি তোলা হয়েছে। ভিডিও করা হয়েছে। এসব কাজ সাধারণত শিবিরের ছেলেরা করে। এজন্য আমাদের ধারণা, আন্দোলনের মধ্যে কুচক্রীমহলের অনুপ্রবেশ ঘটেছে।
এর আগে শুক্রবার দুপুরে জামায়াতের সাবেক সংসদ সদস্য শাহজাহান চৌধুরীসহ আট নেতাকে গ্রেফতার করে নগর গোয়েন্দা পুলিশ। প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে এসব নেতারা শিক্ষার্থীদের আন্দোলন নিজেদের নিয়ন্ত্রণে নেওয়ার পরিকল্পনা করার কথা স্বীকার করেছেন বলে জানিয়েছে নগর পুলিশের এই ইউনিটের কর্মকর্তারা।
নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা ছাত্রলীগের
ওয়াসার মোড়ে বিক্ষোভ সমাবেশের শুরু থেকেই ছদ্মবেশে ছিলেন শিবির ও ছাত্রদলেন। সরব ছিলেন ছাত্র ফেডারেশন, ছাত্র ইউনিয়ন ও ছাত্রফ্রন্টসহ প্রগতিশীল বাম সংগঠনের নেতাকর্মীরাও। তবে শেষ পর্যন্ত বিক্ষোভের নিয়ন্ত্রণ ছিল অনেকাংশে ছাত্রলীগের হাতে।
চট্টগ্রাম মহানগর ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক নুরুল আজিম রনি বিভিন্ন স্কুল-কলেজ থেকে আসা শিক্ষার্থীদের বড় অংশকে নিয়ন্ত্রণে নিতে সক্ষম হন। একপর্যায়ে বিক্ষোভের মাঝে গিয়ে মাইক হাতে নেন রনি ও তার অনুসারীরা। দুপুর আড়াইটায় বিক্ষোভ কর্মসূচি শেষ হওয়া পর্যন্ত মূলত মাইকের নিয়ন্ত্রণ ছিল তাদের হাতেই।
ছাত্রলীগের আধিপত্যের মধ্যে থাকতে না পেরে ছাত্র ইউনিয়নের নেতাকর্মীরা দুপুর ১টার দিকে বিক্ষোভস্থল ছেড়ে যান। এসময় ছাত্র ইউনিয়নের নেতাদের লাঞ্ছিত করারও অভিযোগ পাওয়া গেছে।
ছাত্র ইউনিয়নের ডবলমুরিং থানার সাংগঠনিক সম্পাদক শাহরিয়ার রাফি সারাবাংলাকে বলেন, সব ছাত্র সংগঠনের কর্মীরা গেছে, সে জন্য আমরাও গিয়েছিলাম। আমরাও তো শিক্ষার্থী। এই আন্দোলন তো আমাদেরও আন্দোলন। কিন্তু ছাত্রলীগের কিছু ছেলে আমাদের সঙ্গে অশোভন আচরণ করেছেন।
এর মাঝে ছাত্র ফেডারেশনের নেতাকর্মীরা আরেকটি মাইক এনে পাল্টা বিক্ষোভ শুরুর চেষ্টা করেন। সেখানে সক্রিয় ছিলেন শিবিরের কর্মীরাও। রনির অনুসারীরা গিয়ে মাইক কেড়ে নেন। এরপর ছাত্র ফেডারেশনের নেতা-কর্মীরা সেখান থেকে প্রেসক্লাবের দিকে চলে যান। তবে ছাত্র ফ্রন্টের নেতাকর্মীরা বিক্ষোভ শেষ হওয়া পর্যন্ত অবস্থা করছিলেন।
নুরুল আজিম রনি সারাবাংলাকে বলেন, এই আন্দোলন কোনো রাজনৈতিক আন্দোলন নয়। আমরা চেয়েছিলাম, আন্দোলনটা সাধারণ শিক্ষার্থীদের হাতেই যেন থাকে। আন্দোলনটা যাতে কেউ ভিন্নখাতে নিতে না পারে, সে জন্য আমরা গিয়েছিলাম। শেষ পর্যন্ত শান্তিপূর্ণভাবেই শিক্ষার্থীরা তাদের কর্মসূচি শেষ করেছেন।
এদিকে ওয়াসার মোড়ের আশপাশ ঘিরে অবস্থান নেন নগর ছাত্রলীগের সভাপতি ইমরান আহমেদ ইমুর নেতৃত্বে শ’খানেক নেতাকর্মী। বিক্ষোভ শেষ হওয়ার পরও যেসব শিক্ষার্থী বিচ্ছিন্নভাবে দাঁড়িয়েছিলেন ছাত্রলীগের নেতাকর্মীদের তাদের সরিয়ে দিতে দেখা গেছে।
সারাবাংলা/আরডি/এমআই