Friday 22 Nov 2024
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

শত অপ্রতুলতা, তবুও বিস্ময় বাংলাদেশের চিকিৎসায়


২৮ ডিসেম্বর ২০১৭ ০৯:০৩

জাকিয়া আহমেদ

সীমাবদ্ধতা অনেক। চিকিৎসকের অপ্রতুলতা, সীমিত সম্পদ, হাসপাতালে বেডের চেয়ে রোগী বেশি, এই মেশিন ঠিক আছে তো ওই মেশিন নষ্ট, হাসপাতালগুলোতে দালালের দৌরাত্ম্য এ সবই দেশের পরিচিত চিত্র। এছাড়া বেসরকারি হাসপাতালের প্রতি মানুষের আস্থা, হাসপাতালের তৃতীয় ও চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারীদের বাজে ব্যবহার, সরকারি হাসপাতালগুলোর নোংরা পরিবেশ, চিকিৎসকদের প্রতি আস্থা ও বিশ্বাসের অভাবসহ আছে  নানা অভিযোগ। তবে এ পরিচিত চিত্রের বিপরীতে বাংলাদেশের স্বাস্থ্য ব্যবস্থা, বাংলাদেশের চিকিৎসকরা এমন কিছু কাজ ২০১৭-তে করেছে যেগুলো কেবল দেশে নয়, নজর কেড়েছে বিশ্বের। বিদেশি গণমাধ্যমে ফলাও করে প্রচার হয়েছে নতুন করে বাংলাদেশের নাম, বাংলাদেশের চিকিৎসকদের নাম এবং স্বাস্থ্য ব্যবস্থার প্রশংসা। দেশের জ্যেষ্ঠ চিকিৎসকরা বলছেন, দেশের চিকিৎসা ব্যবস্থা এগিয়েছে, এগিয়েছেন চিকিৎসকরাও। একদিন বাংলাদেশের চিকিৎসা ব্যবস্থা বিশ্বসেরা হবে বলেও  বিশ্বাস করেন তারা।

বিজ্ঞাপন

চিকিৎসা সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ১০ বছর আগেও যে চিকিৎসার কথা চিন্তা করা যেত না, সেটাই এখন করে দেখাচ্ছেন বাংলাদেশের চিকিৎসকরা।

এ বছরে দেশের সবচেয়ে বেশি উচ্চারিত নামগুলোর মধ্যে মুক্তামনি এবং তোফা ও তহুরা অন্যতম। কেবল তাই নয়, মুক্তামনি এবং তোফা ও তহুরার নাম উচ্চারিত হয়েছে জাতিসংঘেও।

মুক্তামনি : বিদেশি চিকিৎসকের অপারগতা, সাহসিকতা দেশি চিকিৎসকের

অপচিকিৎসার শিকার হয়ে জন্মগত রোগ থেকে বিরল রোগে পরিণত হওয়া, প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব নেওয়া, বিদেশের হাসপাতাল থেকে তার চিকিৎসার বিষয়ে ডিনাই করার পর দেশের চিকিৎসকদের প্রচেষ্টা এবং তার আক্রান্ত হাতটি অক্ষত রাখতে পারা না পারার বিষয়গুলো মুক্তামনিকে নিয়ে আসে পুরো দেশের মানুষের মনোযোগের কেন্দ্রবিন্দুতে।

বিজ্ঞাপন

বেশ কয়েকটি অস্ত্রোপচার শেষে  গত ২২ ডিসেম্বর ১৬৪ দিন পর সাতক্ষীরায় গ্রামের বাড়ি যায় মুক্তামনি। তবে পুরোপুরি সুস্থ না হলেও একমাসের জন্য বাড়িতে যাওয়ার অনুমতি মেলে মুক্তামনির পরিবারের যদিও পরবর্তী চিকিৎসার জন্য তাকে একমাস পর আবারও হাসপাতালে আসতে বলেছেন চিকিৎসকরা। বার্ন অ্যান্ড প্লাস্টিক সার্জারি ইউনিটের সমন্বয়ক ডা. সামন্ত লাল সেন এ বিষয়ে সারাবাংলাকে বলেন, মুক্তামনিকে নিয়ে আমাদের আরও অনেক দূর যেতে হবে, দীর্ঘ চিকিৎসা দরকার হবে।

জোড়া শিশু তোফাতহুরার সফল অস্ত্রোপচার

দেশের প্রথম পাইগোপ্যাসাগ শিশু তোফা ও তহুরা। এই দু্ই শিশু যেভাবে জোড়া নিয়ে জন্মগ্রহণ করে তাকেই চিকিৎসাবিজ্ঞানের ভাষায় পাইগোপ্যাসাগ বলা হয়। তোফা ও তহুরার আগে বিশ্বে ১৩টি পাইগোপ্যাগাস শিশুর জন্ম হয়, যার মধ্যে ৬০ শতাংশ শিশুই অস্ত্রোপচার পরবর্তী জটিলতায় মারা যায়।

গত ১ আগস্ট ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের বিভিন্ন বিভাগের ২০ থেকে ২২ জন বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের একটি দল প্রায় ৯ ঘণ্টা অস্ত্রোপচার শেষে পিঠের একটু নিচ থেকে কোমরের নিচ পর্যন্ত সংযুক্ত থাকা তোফা ও তহুরাকে আলাদা করতে সক্ষম হন তারা। অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ তোফা তহুরার অস্ত্রোপচার নিয়ে ঢামেক হাসপাতালের শিশু সার্জারি বিভাগের অধ্যাপক ও পুরো অস্ত্রোপচারে নেতৃত্বদান কারী চিকিৎসক ডা. সাহনূর ইসলাম সারাবাংলাকে জানান, অস্ত্রোপচারের প্রতিটি স্তরই ছিল ঝুঁকিপূর্ণ। তবে চিকিৎসকরা ছিলেন আশাবাদী, তারা সর্বোচ্চটুকু দিয়ে চেষ্টা করেছেন। আর সে কারণেই জোড়া লাগানো এ শিশুদুটিকে পৃথক করা সম্ভব হয়েছে বলেন জানান অধ্যাপক ডা. সাহনূর ইসলাম।

মুক্তামনি, তোফা তহুরা দেশের সাকসেস স্টোরি

গত ১০ সেপ্টেম্বর হাসপাতাল থেকে ছাড়পত্র দেওয়া হয় তোফা ও তহুরাকে। সেদিন অনুষ্ঠানে স্বাস্থ্য অধিদফতরের মহাপরিচালক অধ্যাপক ডা. আবুল কালাম আজাদ গণমাধ্যমকে জানিয়েছিলেন, তোফা ও তহুরা এবং মুক্তামনিকে নিয়ে চিকিৎসকদের সফলতার খবর জাতিসংঘে যাচ্ছে। তিনি সেদিন জানান, বাংলাদেশের স্বাস্থ্যখাতে সফলতা নিয়ে মন্ত্রণালয় থেকে প্রকাশিত বইয়ে মুক্তামনি এবং তোফা ও তহুরার ছবি এবং এদের চিকিৎসা করা চিকিৎসকদের নিয়ে সাকসেস স্টোরি লিপিবদ্ধ করা হয়েছে। যে বইটি জাতিসংঘের অধিবেশনে আসা প্রতিটি দেশের প্রতিনিধি দলকে বিতরণ করা হবে।

অনুপ্রেরণা মুক্তামনি, তোফা তহুরা

জোড়া শিশু তোফা ও তহুরা এবং মুক্তামনিকে সুস্থ করে তোলার প্রচেষ্টা দেশের চিকিৎসকদের নিয়ে গেছে অনন্য উচ্চতায়, চিকিৎসা এবং চিকিৎসকদের প্রতি আস্থা ফিরিয়ে এনেছে দেশের মানুষের। আর তাইতো দেশের আনাচে কানাচে থাকা অন্য বিরল রোগীরাও আসছেন ঢামেক হাসপাতালের বার্ন ইউনিটে।

জন্ম থেকেই তাসনিয়ার মুখের বাম পাশটা ছিল ফোলা-একে বলা হয় ‘নিউরোফাইব্রোমা’। আর বয়স যতো বেড়েছে ফোলা অংশটা আরও ফুলেছে তাসনিয়ার। চার বছর বয়সে ভারতের ভেলরের সিএমসি হাসপাতালে তাসনিয়াকে নিয়ে গেলেও সেখানকার চিকিৎসকরা রিস্ক নিতে পারবেন না বলে তাসনিয়াকে  ফেরত পাঠায়।

সংস্কৃতিমন্ত্রী আসাদুজ্জামন নূরের সহযোগিতায় গত ৫ আগস্ট তাসনিয়াকে বার্ন ইউনিটে ভর্তি করা হয় এবং তার মুখে অস্ত্রোপচারও করেন বার্ অ্যান্ড প্লাস্টিক সার্জারি ইউনিটের চিকিৎসকরা। তাসনিয়ার বাবা হাফিজুর রহমান বলেন, ভারত থেকে রিফিউজ করার পর খুব হতাশ ছিলাম। কিন্তু আবুল বাজানদার, এখন মুক্তামনি এবং তোফা ও তহুরার সফলতা দেখে অনুপ্রেরণা পেয়েছি। বার্নের শিশু ওয়ার্ডে হাড় ছাড়া হাত নিয়ে ভর্তি মুসকান সোমাও এসেছে মুক্তামনিকে টিভিতে দেখে। গত ২০ নভেম্বর বার্ন ইউনিটে  ১৬ মাস বয়সী জোড়া মাথার দুই শিশু রাবেয়া ও রোকাইয়াকে নিয়ে আসেন বাবা রফিকুল ইসলাম। রফিকুল ইসলাম বলেন, দুই মেয়েকে নিয়ে জন্মের পর থেকেই হাসপাতালে হাসপাতালে ঘুরেছি, কিন্তু কেউ ভরসা দেননি। কিন্তু কয়েকদিন আগে তোফা ও তহুরার কথা জেনে এখন এখানে নিয়ে এসেছি। আমার আশা, চিকিৎসকরা আমার এই দুই মেয়েকেও নতুন জীবন দিতে পারবেন যেমন দিয়েছে তোফা ও তহুরাকে।

কেবল রোগীদের আরোগ্যই নয়, দেশের চিকিৎসকরা স্বাস্থ্যখাতে উদ্ভাবনীতে শক্তিতেও এগিয়ে রয়েছেন। নতুন নতুন এসব অবিষ্কার দেশের মানুষের চিকিৎসায় অবদান রাখবে বলেও মনে করেন চিকিৎসকরা।

স্টেমসেল থেরাপি; স্বপ্ন নয় বাস্তব

৩৭ জন লিভার সিরোসিসে আক্রান্ত রোগীর দেহে স্টেমসেল প্রতিস্থাপন করে ৩৪ জন রোগীর ক্ষেত্রে সুফল পাওয়া গেছে। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের এই ৩৪ রোগীর লিভারের উন্নতি হয়েছে এবং অকার্যকর লিভার কাজ করতে শুরু করেছে। একে চিকিৎসা বিজ্ঞানের বিস্ময়কর এক আবিষ্কার ও সফলতা বলে জানিয়েছেন বাংলাদেশ স্টেমসেল অ্যান্ড রিজেনারেটিভ মেডিসিন সোসাইটির সেক্রেটারি জেনারেল ডা. মামুন আল মাহতাব। তিনি বলেন, স্টেমসেল অ্যান্ড রিজেনারেটিভ মেডিসিন আধুনিক চিকিৎসাবিজ্ঞানের অনন্য সংযোজন।

হার্টের ভালব, স্ট্যান্ট পেসমেকারের দাম নির্ধারণ

এ বছরের প্রথমে হার্টের রিং ও করোনারি স্টেন্ট বা হার্টের রিংয়ের সর্বোচ্চ খুচরা মূল্য (এমআরপি) নির্ধারণের পর এবার হার্টের ভালভ ও পেসমেকারের এমআরপি নির্ধারণ করেছে সরকারের ওষুধ প্রশাসন অধিদফতর। ১৯ ডিসেম্বর অধিদফতরের সম্মেলন কক্ষে আয়োজিত এক সভায় এ তথ্য জানান অধিদফতরের মহাপরিচালক মেজর জেনারেল মোস্তাফিজুর রহমান। এর ফলে, দেশে এই প্রথমবারের মতো ভালভ ও পেসমেকারের এমআরপি নির্ধারণ করা হলো। এতে করে এসব জীবন রক্ষাকারী ডিভাইসের দামও আগের থেকে কমেছে।

দেশের চিকিৎসকরাই উদ্ভাবন করেছেন ওষুধ

হেপাটাইটিস বি-এর চিকিৎসায় ‘ন্যাসভ্যাক’ নামের নতুন ওষুধের ক্লিনিক্যাল ট্রায়াল সফলভাবে সম্পন্ন করেছেন বাংলাদেশি দুই চিকিৎসাবিজ্ঞানী ডা. মামুন আল মাহতাব (স্বপ্নীল) ও ডা. শেখ মোহাম্মদ ফজলে আকবর। ক্লিনিক্যাল ট্রায়ালে ন্যাসভ্যাক ব্যবহারে শতকরা ৫০ ভাগ ক্রনিক হেপাটাইটিস বি রোগীর রক্ত থেকে হেপাটাইটিস বি ভাইরাস সম্পূর্ণ নির্মূল আর শতভাগ রোগীর লিভারের প্রদাহ পুরোপুরি ভালো হয়েছে বলে সারাবাংলাকে জানিয়েছেন ডা. মামুন আল মাহতাব। সফল এই ট্রায়াল টি লিভার বিশেষজ্ঞদের সর্বোচ্চ বৈজ্ঞানিক কনফারেন্স হিসেবে স্বীকৃত আমেরিকান লিভার মিটিংয়ে ‘প্রেসিডেনশিয়াল ডিস্টিংশন পদক’ লাভ করে। এরপরই এটি কিউবাতে বাণিজ্যিকভাবে বাজারজাত হয়। তবে আইনি জটিলতার কারনে বাংলাদেশে এতদিন ন্যাসভ্যাক বাজারজাত না করা গেলেও চলতি বছরের আগস্টে ওষুধ প্রশাসন অধিদতফতর ন্যাসভ্যাকের রেসিপি অনুমোদন ( অ্যাপ্রুভ) করেছে এবং এখন  ড্রাগ টেস্টিং ল্যাবোরেটরিতে পরীক্ষার জন্য যাবে। সেখানে সন্তোষজনক ফলাফল পাওয়া গেলেই বাংলাদেশের বাজারে পাওয়া যাবে। ডা. মামুন আল মাহতাব বলেন, আমরা আশা করছি, এর ফলাফল আমাদের পক্ষেই আসবে এবং সেটি হলে এই ন্যাসভ্যাক ওষুধ হেপাটাইটিস বি এর অন্যান্য ওষুধের চেয়ে ভালো কাজ করবে এবং লিভার খারাপ হয়ে যাওয়াকে প্রতিরোধ করবে।

সারাবাংলা/জেএ/একে

চিকিৎসা সেবা সালতামামি ২০১৭

বিজ্ঞাপন

আরো

সম্পর্কিত খবর