Thursday 21 Nov 2024
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

পুলিশ-ছাত্রলীগের হুমকি; মোবাইলে হাত দেবেন না


৫ আগস্ট ২০১৮ ২০:৩৭

।। জাকিয়া আহমেদ, স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট ।।

ঢাকা: দুপুর সাড়ে ১২টার দিকে শাহবাগে জড়ো হওয়া শিক্ষার্থীরা রওনা হয় জিগাতলার দিকে। গতকাল শনিবার শিক্ষার্থীদের ওপর হামলার প্রতিবাদে সেখানে জড়ো হবার পরই হামলা হয় তাদের ওপর। এরপর থেকেই পুরো সায়েন্সল্যাব মোড় থেকে কাঁটাবন মোড়ের পরিস্থিতি বদলে যেতে থাকে, চলতে থাকে ছাত্রলীগের মহড়া—অভিযোগ প্রত্যক্ষদর্শীদের।

আন্দোলনরত শিক্ষার্থীরা শাহবাগ থেকে চলে যাবার কিছু সময় পরই সেখানে বিপুল সংখ্যক পুলিশ সদস্য অবস্থান নেন, এর কিছুক্ষণ পর আসে ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীরা। তারা কেন্দ্রীয় গ্রন্থাগারের সামনে জড়ো হয়ে শ্লোগান দেয় এবং অবস্থান করে বেশ কিছুটা সময়।

এর কিছুক্ষণ পর ধানমন্ডি এলাকায় আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীদের ওপর হামলা চালিয়েছে ঢাকা কলেজ ছাত্রলীগ ও স্থানীয় ‍যুবলীগের নেতা-কর্মীরা। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে একাধিক টিয়ারশেল নিক্ষেপ করে পুলিশ। এ সময় ছাত্রদের ছত্রভঙ্গ করতে ফাঁকা গুলিও ছোড়ে পুলিশ।

সে সময় হামলাকারীদের হাতে আগ্নেয়াস্ত্র ছিল বলে জানিয়েছেন প্রত্যক্ষদর্শীরা। হামলাকারীরা বেশিরভাগই হেলমেট পরা, তাদের হাতে রাম দা, অস্ত্রশস্ত্র রয়েছে। এ সময়টায় শাহবাগ থেকে আসা আন্দোলনকারীদের সঙ্গে তাদের দফায় দফায় ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়া হয়। জিগাতলা-সায়েন্সল্যাব-ঢাকা কলেজ-মিরপুর রোড এলাকায় অবস্থান নেয় ছাত্রলীগ-যুবলীগের নেতাকর্মীরা। জানা যায়, এসময় ঢাকা কলেজের ছাত্রলীগ নেতাকর্মী সায়েন্সল্যাব থেকে বাটা সিগনালে অবস্থান নেন।

শাহবাগ এলিফেন্ট রোড ঘুরে দেখা যায়, ধাওয়া পাল্টা ধাওয়ার পুরো সময়টাতে শাহবাগ থেকে কাঁটাবন হয়ে এলিফেন্ট রোড জুড়ে ছড়িয়ে পরে আতঙ্ক, আশে-পাশের সব দোকান বন্ধ করে দেন বিক্রেতারা, আজিজ সুপার মার্কেটের পাশের ওষুধ মার্কেটের সামনে রাস্তায় বসা ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীরা দোকান-পাট গুটিয়ে নেন।

বিজ্ঞাপন

বাংলাদেশ প্রেকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্যানারে সাধারণ শিক্ষার্থীরা মিছিল করে মিছিল এলিফেন্ট রোডে থেকে শাহবাগে আসতে চাইলে পুলিশ তাদের কাঁটাবন থেকে নীলক্ষেত পাঠিয়ে দেয়।

এরপরপরই হামলাকারীরা প্রথমে সায়েন্স ল্যাবরেটরি মোড়ে অবস্থান নেয়। তাদের প্রতিহত করতে নিউ এলিফ্যান্ট রোডের বাটা সিগন্যালে অবস্থান নেয় আন্দোলনকারীরা। এ সময় পুলিশের একটি দল শাহবাগ থেকে বাটা সিগনালের দিকে এগিয়ে আজিজ সুপার মার্কেট পর্যন্ত এসে আবার ফিরে যায়। তারা মার্কেটের বিভিন্ন তলার দোকানিদের ওপর থেকে মোবাইল ফোনে ছবি তুলতে বা ভিডিও করতে নিষেধ করে।

একই কাজ করে ছাত্রলীগের কর্মীরাও। কাউকে ফোনে ছবি বা ভিডিও তুলতে দেয়নি।

সারাবাংলার সাংবাদিক সন্দীপন বসু বলেন, বাটা সিগনালের সামনে থেকে মুখ ঢেকে রাখা কয়েক জনের ছবি তোলার পর হাত থেকে ফোন নিয়ে যায় দৌঁড় দেয়, কোনো কথা না বলেই। বেশ কয়েক মিনিট পর তারা ছবি ডিলিট করে ফোন ফেরত দেয়।

তিনি আরও বলেন, এলিফেন্ট রোডের মাল্টিপ্ল্যান শপিং কমপ্লেক্সের সামনে এক লোকের ফোন ছুড়ে ভেঙ্গে ফেলে ছাত্রলীগের কর্মীরা।

শিক্ষার্থী এবং হামলাকারী উভয় পক্ষই দোকান বন্ধ করতে হুমকী-ধামকী দেয়। যান চলাচলে বাধার সৃষ্টি করে। সায়েন্সল্যাব থেকে অ্যাম্বুলেন্স আসতে পারলেও বাটা সিগনালের দিক থেকে কোনো যানবাহন চলতে দেয়নি শিক্ষার্থীরা।

সন্দীপন বলেন, শিক্ষার্থীদের অনেকেরই মুখ রুমাল দিয়ে ঢাকা ছিল, হাতে ছিল লাঠি ও বাঁশ। আর হামলাকারীদের মাথায় ছিল হেলমেট, তাদের হাতে ছিল লাঠি, বাঁশ, রড, হকিস্টিক। সায়েন্সল্যাব, বাটা সিগনাল, হাতিরপুল বাজারের সব ধরণের দোকান ছিল বন্ধ, দোকানীরা ছিল আতঙ্কিত।

বিজ্ঞাপন

সারাবাংলার বিশেষ প্রতিবেদক গোলাম সামদানীর মোবাইল ফোনও কেড়ে নেওয়া হয়। মিরপুর ১০ গোলচত্বরে বেলা সাড়ে তিনটার দিকে এ ঘটনা ঘটে। গোলাম সামদানী জানান, আন্দোলনরত ছাত্রদের লাঠিসোটা হাতে ছাত্রলীগ কর্মীরা ধাওয়া দেয়। সেই ছবি তুলতে গেলে, ছাত্রলীগের কর্মীরা তার হাত থেকে মোবাইল কেড়ে নিয়ে মাটিতে আছাড় মারে এবং তার আইডি কার্ড ছিঁড়ে ফেলে

‘কয়েকজন আমাকে ঘিরে ধরে, মোবাইল কেড়ে নেয়, ছবি তোলার কারণে আমাকে গালাগালি করতে থাকে। মোবাইল কেড়ে নেয়, ছবি ডিলিট করে এবং মোবাইলও ভেঙে ফেলতে যা’, যোগ করেন সামদানী।

তবে বিকেল সাড়ে ছয়টার দিকে এসব শাহবাগসহ সব এলাকার যান চলাচল স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে এলেও দোকানপাট এখও বন্ধ রয়েছে।

সারাবাংলার সাংবাদিক আবু তালহা রিকশায় করে আসছিলেন পৌনে দুইটার দিকে। তিনি বলেন, সায়েন্স ল্যাব মোড়ে পুলিশের সঙ্গে অবস্থান নিয়েছিল হেলমেট পরা একদল যুবক। তাদের হাতে ছিল লাঠি, হকিস্টিক ও লোহার রড, কারো কারো হাতে ছিল রামদা। ল্যাব এইড হাসপাতালের মোড়ে দাঁড়িয়ে এই দৃশ্য ধারণ করছিলেন দেশ টিভি, বাংলাভিশনসহ আরও কিছু ক্যামেরা পারসন। সঙ্গে ছিলেন রিপোর্টারও। হকিস্টিক হতে ওই যুবকরা তাদের ঘিরে ধরে ফুটেজ ডিলিট করায়। রামদা হাতে দুইজন তখন রাস্তার মাঝখানে দাঁড়িয়ে। মোটরসাইকেল আরোহী থামিয়ে তাদের হেলমেট নিয়ে নিচ্ছিল তারা। ওই দলে কয়েকজন ছিল খালি হাতে। তারা রোড ডিভাইডারের ওপর বসানো লোহার গ্রিল থেকে অ্যাঙ্গেল খুলে নিচ্ছিল। কিছু দূর এগিয়ে গিয়ে দেখা যায়, নূর জাহান মার্কেট, গ্লোব মার্কেট, হকার্স মার্কেট, গাউসিয়া, চক বাজার, নিউ মার্কেট, নীলক্ষেত বইয়ের মার্কেটে সাটার নামছে। দোকানিদের আতঙ্কিত মুখ। কিছুক্ষণ আগে সেখানে ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়া হয়েছে। আজিমপুরের দিকে তখনও কিছু বেশ জটলা। কিছু মানুষকে দেখা যায় মুখে রুমাল বাঁধা।

প্রথম আলোর জ্যেষ্ঠ ফটো সাংবাদিক সাজিদ হোসেন সারাবাংলাকে বলেন, তার পায়ে পেটানো হয়েছে, সেখানে কালো দাগ হয়ে গেছে।

তিনি বলেন, পেশাগত দায়িত্ব পালন করার সময় আমরা ছাত্রলীগের হামলার শিকার হয়েছি, যেটা কোনোভাবেই কাম্য হতে পারে না, আমরা এর সুষ্ঠু তদন্ত আশা করছি।

অ্যাসোসিয়েট প্রেস (এপি)-এর ফটো সাংবাদিক এ. এম. আহাদকে হামলাকারীদের হাত থেকে রক্ষা করতে গিয়ে ব্যাপক মারধরের শিকার হন দৈনিক বণিক বার্তার পলাশ শিকদার। তার আঘাতও গুরুতর।

হামলায় আরো আহত হয়েছেন সাউথ এশিয়ান মিডিয়া অ্যাকাডেমি পাঠশালার পাঁচ শিক্ষার্থী এনামুল হাসান, মারজুক আহসান, রাহাত করিম, হাসান জোবায়ের, ইনকিয়ার হাসিন।

এদের মধ্যে দু’জন রাহাত করিম ও এনামুল হাসান মাথায় আঘাত পেয়েছেন। রাহাত করিম বেসরকারি একটি হাসপাতালে ভর্তি আছেন। এমআরআই রির্পোট ভালো এসেছে তবে তার পা ভেঙে গেছে এবং রড দিয়ে পেটানোর কারণে মাংস থেতলে গেছে। বাকিরা প্রাথমিক চিকিৎসা নিয়ে আপাতত সুস্থ রয়েছে। কিন্তু সবার ক্যামেরা ভেঙে ফেলেছে হামলাকারীরা।

জানতে চাইলে পাঠশালার প্রিন্সিপাল আবীর আব্দুল্লাহ সারাবাংলাকে বলেন, এরা সবাই পাঠশালার শিক্ষার্থী। সাধারণত, এ ধরনের কোনো প্রটেস্ট হলে বা সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান হলে ওরা ছবি তুলতে যায়। ওরা পেশাদার আলোকচিত্রী না। যেহেতু পাঠশালা ফটোগ্রাফি স্কুল, তাই বিভিন্ন অকেশনাল ইনসিডেন্ট হলে ওরা ছবি তুলতে যায়। এটা এক ধরনের প্র্যাকটিস, এক ধরনের ট্রেনিং হয় এতে। কিন্তু আজ তারা সেখানে হামলার শিকার হয়েছেন।

এটা আমাদের জন্য খুবই দুঃখজনক উল্লেখ করে আবীর আব্দুল্লাহ সারাবাংলাকে বলেন, আমরা পেশাগত দায়িত্ব পালন করার সময় যদি এভাবে আক্রমণ হয়- এটা আমাদের সাংঘাতিকভাবে উদ্বিগ্ন করে তোলে। বিশেষ করে যারা নবীন আলোকচিত্রী বা সাংবাদিক কিংবা আসছেন এই পেশায়, তাদেরকে আমরা কী বলব!

গতকাল শনিবার শিক্ষার্থীদের হামলার সময়ে কেড়ে নেওয়া হয়েছিল জিগাতলায় দায়িত্বরত প্রথম আলোর সাংবাদিক এবং সারাবাংলার এই প্রতিবেদকের ফোন। ফোন চাইতে গেলে তাদের বলা হয়, আওয়ামী লীগ অফিসে যোগাযোগ করে ফোন নিতে হবে। পরে অনেক অনুরোধের পর ফোন ফেরত দেয় তারা।

সারাবাংলা/জেএ/এমআই

শিক্ষার্থীদের ওপর হামলা

বিজ্ঞাপন

আরো

সম্পর্কিত খবর