মেয়াদোত্তীর্ণ টিয়ার গ্যাস শেল, বিষক্রিয়ার ঝুঁকি
৬ আগস্ট ২০১৮ ২৩:৩৮
।। জাকিয়া আহমেদ, স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট ।।
ঢাকা: নিরাপদ সড়কের দাবিতে আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের ওপর হামলার প্রতিবাদে রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায় বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থীদের সঙ্গে দিনভর আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর দফায় দফায় সংঘর্ষ হয়েছে।
এর মধ্যে শাহবাগে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, রামপুরায় ইস্ট ওয়েস্ট ইউনিভার্সিটি ও বসুন্ধরা আবাসিক এলাকায় নর্থ সাউথ ইউনিভার্সিটির শিক্ষার্থীদের সঙ্গে এই সংঘর্ষ ঘটে। টিয়ারশেল নিক্ষেপ করে শিক্ষার্থীদের ছত্রভঙ্গ করে পুলিশ পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে নেয়।
তবে অভিযোগ উঠেছে, আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা যে টিয়ারশেল নিক্ষেপ করেছেন- তা মেয়াদোত্তীর্ণ। গতকালও (রোববার) রাজধানীর জিগাতলায় ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়া এবং সংঘর্ষের ঘটে। অভিযোগ পাওয়া যায়, সেখানেও পরিস্থিতি স্বাভাবিক করতে পুলিশ যে টিয়ারশেল ছোড়ে তা মেয়াদোত্তীর্ণ ছিল।
এই প্রসঙ্গে জানতে চাইলে তথ্যের সত্যতা নিশ্চিত করে ঢাকা মহানগর পুলিশের মিডিয়া বিভাগের উপ-কমিশনার ওবায়দুর রহমান সারাবাংলাকে বলেন, দীর্ঘ দিন অব্যবহৃত থাকায় এগুলোর মেয়াদ চলে গেছে। পুলিশ ছত্রভঙ্গ করতে টিয়ারশেল নিক্ষেপ করে, তবে মেয়াদ না থাকলে তাতে ধোঁয়া কম হয় এবং যথাযথ কাজ হয় না।
তবে মেয়াদোত্তীর্ণ টিয়ারশেল নিয়ে স্বাস্থ্য ঝুঁকির কথা বলছেন চিকিৎসকরা। এই প্রসঙ্গে জানতে চাইলে প্রিভেন্টিভ মেডিসিন বিশেষজ্ঞ ডা. লেলিন চৌধুরী সারাবাংলাকে বলেন, টিয়ারশেল এমনিতেই চোখের জন্য ক্ষতিকর, যন্ত্রণাকর পরিস্থিতি সৃষ্টি করে। আর যদি সেটি মেয়াদোত্তীর্ণ হয় তাহলে বিষক্রিয়া তৈরি করতে পারে।
তিনি বলেন, টিয়ারশেল বা যেকোনো ওষুধের মেয়াদ উত্তীর্ণ হয়ে গেলেই সেটি তার নিজস্বতা হারায়, নষ্ট হয়ে যায়। আর এই নষ্ট হয়ে যাওয়ার মাধ্যমেই সেটি বিষ বা বিষক্রিয়া তৈরি করতে পারে। টিয়ারশেল এমনিতেই ক্ষতিকর চোখের জন্য, শ্বাসপ্রশ্বাসের জন্য। মেয়াদোত্তীর্ণ হয়ে গেলে আরো কী প্রতিক্রিয়া করতে পারে সে বিষয়ে যদিও কোনো গবেষণালব্ধ প্রমাণ নেই, কিন্তু চিকিৎসক হিসেবে বলতে পারি, এটি তীব্রতর বিষক্রিয়া তৈরি করবে।
টিয়ারশেলের ধোঁয়ায় চোখে জ্বালাপোড়া হয়, কিছু সময় পরেই ঠিক হয়ে যায়। তবে মেয়াদোত্তীর্ণ হয়ে গেলে সেই বিষক্রিয়া অন্যান্য শারীরিক সমস্যাও তৈরি করতে পারে, বলেন ডা. লেলিন চৌধুরী।
টিয়ার গ্যাস (কাঁদানে গ্যাস) হলো কয়েক ধরনের রাসায়নিক যৌগের একীভূত নামকরণ, যাকে ল্যাক্রিমেটরও বলা হয়। প্রকৃতপক্ষে এটি কোনো গ্যাস নয়। মিহি গুঁড়া কিংবা তরলের অতি ক্ষুদ্রকণার সমষ্টি নিয়ে এ গ্যাস গঠিত। গুঁড়ায় ক্ষারজাতীয় রাসায়নিক পদার্থের উপস্থিতি রয়েছে। এর প্রভাবে চোখের শ্লৈষ্মিক ঝিল্লিতে প্রচণ্ড জ্বালা-যন্ত্রণা অনুভূত হয় এবং সংবেদনশীলতার কারণে চোখ থেকে অনবরত পানি ঝরতে থাকে।
এই গ্যাসের কারণে শ্বাস-প্রশ্বাস জনিত সমস্যা হতে পারে। এমনকি কাশি, বিষণ্ণতা এবং শারীরিক দুর্বলতাও দেখা দিতে পারে। প্রথম বিশ্বযুদ্ধে রাসায়নিক হামলার অংশ হিসেবে এই গ্যাসটি প্রথম ব্যবহার করা হয়। তবে স্বল্প সময়ের জন্য কার্যকর হওয়ায় দাঙ্গা নিয়ন্ত্রণ, বিক্ষুব্ধ জনতাকে ছত্রভঙ্গ করে দিতে এটি সারাবিশ্বে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ব্যাপক হারে ব্যবহার করে আসছে।
টিয়ার গ্যাসের উপাদানগুলো সাধারণত সিনথেটিক জৈব হ্যালোজেন যৌগ আকারে থাকে। সাধারণ অবস্থায় যেগুলো স্বাধীন গ্যাস নয় কিন্তু স্প্রে, কুয়াশা জেনারেটর, গ্রেনেড এবং শেলের ভেতরে তরল বা কঠিন অবস্থায় থেকে তা সরাসরি বাতাসে ছড়িয়ে যেতে পারে। বহুল ব্যবহৃত দুটি টিয়ার গ্যাস হচ্ছে- ক্লোরোএসিটোফেনন অথবা সিএন এবং ক্লোরোবেনজাইলিডিনেমেলোনোনেইট্রাইল বা সিএস।
টিয়ার গ্যাসের কার্যকারিতা সাময়িক, পূর্বে এমন ধারণা করা হলেও নতুন এক গবেষণা বলছে, এর পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া সাময়িক নয় বরং এতে আক্রান্ত হওয়ার দুই সপ্তাহ পরেও সমস্যা দেখা গেছে।
ইউরোপিয়ান রেসপিরেটরি সোসাইটি (ইআরএস) ২০১৪ সালের ১০ সেপ্টেম্বর আন্তর্জাতিক কংগ্রেসে উত্থাপিত ওই গবেষণা প্রতিবেদনে বিক্ষোভকারী ব্যক্তিদের ফুসফুসজনিত সমস্যার আক্রান্ত হওয়ার জন্য সরাসরি টিয়ার গ্যাসকে দায়ী করা হয়। ২০১৩ সালে তুরস্কের একটি বিক্ষোভ সমাবেশ থেকে টিয়ার গ্যাসে আক্রান্ত ৫৪৬ জন ব্যক্তির ওপর পরীক্ষা-নিরীক্ষা চালিয়ে তারা ওই গবেষণা প্রতিবেদনটি দাঁড় করান।
গবেষণা প্রতিবেদনে উঠে আসে, টিয়ার গ্যাসে আক্রান্তদের ৭০ শতাংশ শ্বাস-প্রশ্বাস জনিত সমস্যায় পড়েন, ৮০ শতাংশ কাশিতে ভোগেন, ৪৫ শতাংশের ফুসফুসে কফ জমে যায় এবং ৪৩ শতাংশ লোক বুকে ব্যথা অনুভব করেন। এমনকি আক্রান্তদের কাশি ও বুক ব্যথা দূর হতে ১৫ দিনের মতো সময় লাগে।
অন্য আরেকটি গবেষণায় দেখা গেছে, টিয়ার গ্যাসের পরোক্ষ প্রভাবও রয়েছে। সরাসরি আক্রান্ত না হলেও, টিয়ার গ্যাস প্রয়োগের অঞ্চলে বসবাসরত অন্যান্য ব্যক্তিরাও নানান স্বাস্থ্যগত সমস্যায় পড়েছেন। ২০১৩ সালে তুরস্কের ওই বিক্ষোভ শেষ হয়ে যাওয়ার ৭ দিন পরেও টিয়ার গ্যাসের কারণে শারীরিক বিভিন্ন সমস্যায় পড়ার বিভিন্ন আলামত পেয়েছেন গবেষকরা। সেখান থেকে দেখা গেছে, ৭৬ শতাংশ মানুষের স্বাভাবিক শ্বাস-প্রশ্বাসে অস্বস্তি হচ্ছে, ৮৯ শতাংশ মানুষ কাশিতে আক্রান্ত হয়েছেন।
যদিও বেশ কয়েকটি আন্তর্জাতিক চুক্তির প্রেক্ষাপটে অন্যান্য রাসায়নিক অস্ত্রের মতো টিয়ার গ্যাসের ব্যবহারও নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়েছে। বিশ্বের অধিকাংশ দেশ চুক্তিতে সাক্ষরও করেছে।
সারাবাংলা/এএস/এটি