বিআরটিএ’র তদন্ত: বেপরোয়া গতি ও প্রতিযোগিতায় ছিল জাবালে নূর
৯ আগস্ট ২০১৮ ০৮:২৪
।। গোলাম সামদানী, স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট ।।
ঢাকা: বেপরোয়া গতি এবং দুই বাসের চালকের মধ্যে প্রতিযোগিতার কারণে জাবালে নূর পরিবহনের বাসটি দুর্ঘটনা ঘটিয়েছে বলে জানিয়েছেন বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষের (বিআরটিএ) মোটরযান পরিদর্শক সামসুদ্দীন আহম্মেদ।
গত ২৯ জুলাই রাজধানীর কুর্মিটোলা এলাকায় জাবালে নূর পরিবহনের বাসের চাপায় শহীদ রমিজ উদ্দিন ক্যান্টনমেন্ট কলেজের দুই শিক্ষার্থীর প্রাণহানির ঘটনায় বিআরটিএ গঠিত তদন্ত কমিটির প্রধান তিনি।
বুধবার (৮ আগস্ট) বিকেলে মিরপুর-১৩-তে বিআরটিএ মেট্রো সার্কেল-১-এ সামসুদ্দীন আহম্মেদের কার্যালয়ে কথা হয় তার সঙ্গে। ওই দুর্ঘটনার তদন্তে কী উঠে এসেছে, তা তিনি সারাবাংলা’র কাছে তুলে ধরেন এ সময়।
দুর্ঘটনার কারণ তুলে ধরে সামসুদ্দীন আহম্মেদ বলেন, ‘তদন্তে আমরা যেটা পেয়েছি, সেটা হলো— নিজেদের মধ্যে প্রতিযোগিতামূলক মনোভাবে কারণে ওই দুর্ঘটনা ঘটে। বাসটি দ্রুত ও বেপরোয়া গতিতে চলছিল এবং অন্য বাসের সঙ্গে প্রতিযোগিতা করছিল। এ কারণেই এই দুর্ঘটনা ঘটে।’
বিআরটিএ’র এই প্রধান মোটরযান পরিদর্শক জানান, জাবালে নূর পরিবহনের বাসের চালক মাসুম বিল্লাহর ড্রাইভিং লাইসেন্স ছিল হালকা যানবাহন চালানোর জন্য। তিনি বলেন, ‘লাইসেন্সের ধরন অনুযায়ী তিনি বাস চালাতে পারেন না। কারণ তার ছিল হালকা যানবাহন চালনার লাইসেন্স। এই লাইসেন্স দিয়ে পিকআপ, প্রাইভেট কার, মাইক্রোবাস চালানো যায়। কিন্তু বাস চালানো যায় না। তাই আইন অনুযায়ী, জাবালে নূর পরিবহনের ওই চালক কোনোভাবেই বাস চালাতে পারেন না। তিনি কেন এটা চালাতে গেলেন?’
সামসুদ্দীন আহম্মেদ বলেন, ‘অনেকেই বলছেন, গাড়িটি ব্রেক ফেল করেছে। কিন্তু প্রকৃত অর্থে এটা ব্রেক ফেলের ঘটনা না। গাড়ির ফিটনেসের মেয়াদ ছিল, ট্যাক্স টোকেনেরও মেয়াদ ছিল। তবে চালকের পেশাদার যে ড্রাইভিং লাইসেন্স ছিল, সেটা ছিল হালকা যানের জন্য। এটা ফরিদপুর থেকে করা হয়েছিল।’ দুর্ঘটনার পর চালকের লাইসেন্স ও গাড়ির রেজিস্ট্রেশন স্থগিত করা হয়েছে বলে জানান তিনি।
বিআরটিএ‘র এই মোটরযান পরিদর্শক আরও বলেন, ‘আমরা মূলত দুর্ঘটনার কারণ অনুসন্ধানের দুইটি প্রতিবেদন তৈরি করেছি। একটি তাৎক্ষণিকভাবে আমাদের কর্তৃপক্ষকে দিয়েছি। আরেকটি প্রতিবেদন আমরা গত ৫ আগস্ট ক্যান্টনমেন্ট থানায় দিয়েছি। কারণ এই দুর্ঘটনার জন্য ক্যান্টনমেন্ট থানায় গত ২৯ জুলাই মামলা হয়। সেই মামলার জন্যই থানা থেকে চিঠির মাধ্যমে বিআরটিএ‘র কাছে প্রতিবেদন চাওয়া হয়। তার পরিপ্রেক্ষিতে আমরা ক্যান্টনমেন্ট থানায় প্রতিবেদন দিয়েছি।’
লাইসেন্সের ধরন মেনেই যানবাহন চালানোর পরামর্শ দিয়ে বিআরটিএ’র ঊর্ধ্বতন এই কর্মকর্তা বলেন, ‘আমাদের সুপারিশ— যে ধরনের যানবাহনের লাইসেন্স, তা দিয়ে কেবল ওই ধরনের যানবাহনই চালাবেন। কাগজপত্র আপগ্রেড রাখবেন। ফিটনেসবিহীন গাড়ি চালাবেন না। তবে আমাদের তদন্ত প্রতিবেদনে দুর্ঘটনার কারণ সংক্রান্ত অনুচ্ছেদ আছে, কিন্তু সুপারিশ সংক্রান্ত কোনো অনুচ্ছেন নেই। ফলে কারণের জায়গায় আমরা লিখেছি, দ্রুত ও বেপরোয়া গতিতে গাড়ি চালানো এবং প্রতিযোগিতামুলক মনোভাবের কারণে এই দুর্ঘটনা ঘটেছে।’
আরেক প্রশ্নের জবাবে সামসুদ্দীন আহমেদ জানান, মূলত দুর্ঘটনায় কবলিত বাসটিতে কোনো ধরনো যান্ত্রিক ত্রুটি ছিল কিনা, সেটা তদন্ত করার জন্যই তাকে প্রধান করে বিআরটিএ কমিটি গঠন করে। তিনি বলেন, ‘গাড়িটির ফিটনেস ছিল কি না, সেটা বলা মুশকিল ছিল। কারণ আমি তদন্ত কমিটির প্রধান হিসেবে সেখানে যাওয়ার আগেই গাড়িটি ভাঙচুর করা হয়। ফলে গাড়ির সার্বিক পরিস্থিতি নিয়ে তেমন কিছু বলা যাচ্ছে না।’
উল্লেখ্য, গত ২৯ জুলাই রাজধানীর বিমানবন্দর সড়কে কুর্মিটোলা এলাকায় জাবালে নূর পরিবহনের দুই বাসের রেষারেষির জের ধরে একটি বাস হোটেল র্যাডিসনের সামনের ফুটপাতে উঠে পড়ে। এ সময় ফুটপাতে বাসের জন্য অপেক্ষমাণ রমিজ উদ্দিন কলেজের ১৪-১৫ জন শিক্ষার্থী আহত হয়। এর মধ্যে প্রাণ হারায় কলেজটির দ্বাদশ শ্রেণির শিক্ষার্থী আব্দুল করিম ও একাদশ শ্রেণির দিয়া খানম মীম। এ ঘটনার প্রতিবাদে শিক্ষার্থীরা রাজধানীজুড়ে নিরাপদ সড়কের দাবিতে আন্দোলন করে।
এ ঘটনায় দিয়ার বাবা জাহাঙ্গীর আলম বাদী হয়ে মামলা দায়ের করেন। পরে গ্রেফতার হন ঘাতক বাসের চালক মাসুম বিল্লাহ এবং জাবালে নূরের আরও দুই বাসচালক জোবায়ের ও সোহাগ আলী এবং দুই হেলপার এনায়েত হোসেন ও রিপন হোসেন। জাবালে নূর পরিবহনের মালিক শাহাদাত হোসেনকেও গ্রেফতার করা হয়। তারা সবাই রিমান্ডে রয়েছেন। এর মধ্যে মাসুম বিল্লাহ সোমবার আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছেন। তাতে তিনি বেপরোয়া গতিতে গাড়ি চালিয়ে সড়কের পাশে শিক্ষার্থীদের ওপর গাড়ি তুলে দেওয়ার কথা স্বীকার করেছেন।
সারাবাংলা/জিএস/টিআর