বিআরটিএর আশপাশে বিক্রি হয় মেডিকেল সার্টিফিকেট !
১১ আগস্ট ২০১৮ ১৫:০০
।। গোলাম সামদানী, স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট ।।
ঢাকা: নিয়ম অনুযায়ী ড্রাইভিং লাইসেন্স করতে প্রয়োজনীয় কাগজপত্রের সঙ্গে মেডিকেল সার্টিফিকেট জমা দিতে হয়। বাধ্যতামূলক হওয়ায় ভূয়া মেডিকেল সার্টিফিট বানিয়ে ব্যবসা করছে এক শ্রেণীর দালাল চক্র। বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআরটিএ)-তে প্রতিদিন লাইসেন্স করতে আসা চালকরা টাকার বিনিময়ে পাচ্ছেন সেসব মেডিকেল সার্টিফিকেট।
এই চক্রটি মিরপুর বিআরটিএ-র আশেপাশে সিন্ডিকেট করে ভূয়া মেডিকেল সার্টিফিকেট বানিয়ে টাকার বিনিময়ে বিক্রি করছেন লাইসেন্স তৈরি করতে আসা চালকদের হাতে। বিনিময়ে নিচ্ছেন ২০০ থেকে ৩০০ টাকা।
আবেদনকারির মেডিকেল সার্টিফিকেটটি সঠিক কি না তা যাচাই করে না বিআরটিএ কর্তৃপক্ষ। এর ফলে এ চক্রটি প্রতিদিন আবেদনকারীরদের কাছ অবৈধ মেডিকেল সার্টিফিকেট বিক্রি করে হাতিয়ে নিচ্ছেন হাজার হাজার টাকা। এই চিত্র পাওয়া গেছে রাজধানীর মিরপুর বিআরটিএতে গত কয়েকদিন ঘুরে।
এ ব্যাপারে, বিআরটিএ সচিব মো. শওকত আলীর কাছে জানতে চাইলে তিনি সারাবাংলাকে বলেন, বর্তমানে লাইসেন্স নবায়ন, নতুন লাইসেন্স করার প্রবণতা এবং গাড়ির ফিটনেস পরীক্ষার করার হার অন্য যে কোনো সময়ের তুলনায় বেড়েছে। এটা বিআরটিএর সফলতা। তবে বিআরটিএগুলোতে দালালদের উৎপাৎ বেড়েছে এই প্রসঙ্গে জানতে চাইলে তিনি কোনো মন্তব্য করতে রাজী হননি।
বিআরটিএ সূত্র জানায়, ড্রাইভিং লাইসেন্স করতে প্রয়োজনীয় কাগজপত্রের সঙ্গে মেডিকেল সার্টিফিকেট জমা দেওয়া বাধ্যতামূলক। ড্রাইভিং লাইসেন্স করতে মেডিকেল সার্টিফিকেটে আবেদনকারীর বয়স, দৃষ্টিশক্তির কোনো ত্রুটি রয়েছে কি না ? থাকলে কী কী ধরনের চশমা ব্যবহার করে ঠিক করা হয়েছে ? প্রার্থী সহজে সবুজ লাল রং চিহ্নিত করতে পারেন কি না ? চালক রাতকানা রোগে ও বধির রোগে ভুগছে কি না ? ড্রাইভিং করতে বাধা এমন কোনো অঙ্গহানি রয়েছে কি না ? প্রার্থী অতিরিক্ত মদ বা ড্রাগ আসক্ত কি না ? এইসব সমস্যা রয়েছে কি না তা ডাক্তারের কাছ থেকে মেডিকেল সার্টিফিকেট সংগ্রহ করে প্রয়োজনীয় কাগজপত্রসহ আবেদন করতে হয়।
সূত্র জানায়, মিরপুর বিআরটিএ-এর আশেপাশে গড়া ওঠা বিভিন্ন কম্পিউটার দোকান থেকে দালাল চক্র কোনো ধরনের পরীক্ষা না করেই রেডিমেট সার্টিফিকেট বানিয়ে তা পূরণ করে দিচ্ছেন। এই সার্টিফিকেট জমা দিয়েই লাইসেন্স পেয়ে যাচ্ছেন চালকরা। সার্টিফিকেটটি সঠিক কি না তা যাচাই করেও দেখছেন না বিআরটিএ কর্তৃপক্ষ। আবার কখনো কখনো দেখা যায় মেডিকেল সার্টিফিকেট সঠিক হলেও ডাক্তার চালককে না দেখে এবং কোনো প্রকার পরীক্ষা ছাড়াই নির্ধারিত ফরমে ডাক্তারের স্বাক্ষরিত সনদ আশেপাশের দোকানগুলোতে পাওয়া যাচ্ছে। অর্থাৎ চালকদের ফিজিক্যাল ফিটনেস কিংবা অঙ্গহানি রয়েছে কি না তা না দেখেই ডাক্তারা মাত্র ২০০/৩০০ টাকার বিনিময়ে সার্টিফিকেট সরবরাহ করছেন। বিনিময়ে এই টাকার অর্ধেক নিচ্ছেন দালাল চক্র আর বাকি অর্ধেক নিচ্ছেন ডাক্তাররা।
সূত্র জানায়, চলতি মাসের শুরু থেকে রাজধানীতে যানবাহন ফিটনেস, গাড়ির চালকদের নতুন লাইসেন্স ও লাইসেন্স নবায়নের পরিমাণ বেড়ে গেছে। এতে করে বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআরটিএ) প্রতিদিন লাইসেন্স এবং গাড়ির ফিটনেস পরীক্ষা করার পরিমাণ বেড়ে গেছে। রাজধানীর রাজপথে শিক্ষার্থীদের নিরাপদ সড়ক আন্দোলন এবং ট্রাফিক পুলিশ সপ্তাহ উপলক্ষে রাস্তায় যানবাহন চেকিংয়ের ক্ষেত্রে পুলিশের কঠোর অবস্থানের কারণে বিআরটিএতে ভিড় বাড়ছে। আর লাইসেন্সের জন্য চাপ বেড়ে যাওয়ায় বেড়েছে দালালদের কদর। আর এই ক্ষেত্রে লাইসেন্স করতে আসা লোকজন সবচেয়ে বেশি হয়রানির শিকার হচ্ছেন মেডিকেল সার্টিফিকেট নিয়ে।
বিআরটিএ সূত্র জানিয়েছে, আগে মিরপুর বিআরটিএতে প্রতিদিন গড়ে ১৮০ জন থেকে ২০০ জন চালক নতুন করে শিক্ষানবিশ লাইসেন্স বা লার্নার লাইসেন্স করার জন্য আবেদন করতেন। বর্তমানে আবেদনের সংখ্যা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ২৬০ থেকে ২৭০টিতে। বর্তমানে আবেদনকারীর সংখ্যা বেড়েছে ৪০ শতাংশের বেশি। বিভিন্ন যানবাহন ও গাড়ি চালকদের নতুন লাইসেন্সের আবেদনের পাশাপাশি বেড়েছে লাইসেন্স নবায়ন করার হারও। আগে যেখানে মিরপুর বিআরটিএতে লাইসেন্স নবায়নের জন্য প্রতিদিন আবেদন জমা পড়ত গড়ে ৭০ থেকে ৮০টি, সেখানে এই সংখ্যা এখন ১২০ থেকে ১৫০টি ছাড়িয়ে গেছে বলে জানালেন একজন কর্মকর্তা। অন্যদিকে স্বাভাবিক সময়ে মিরপুৃর বিআরটিএ দৈনিক ৮০০ গাড়ি ফিটনেস পরীক্ষার জন্য আসলেও বর্তমানে তা বেড়ে দাড়িয়েছে ১২০০ থেকে ১৩০০ পর্যন্ত।
এ ব্যাপারে মিরপুর বিআরটিএর লাইসেন্স নবায়ন ও লাইসেন্স শাখার সহকারী পরিচালক মোহাম্মদ আলী আহসান মিলন তার কার্যালয়ে সারাবাংলাকে বলেন, গত দুসপ্তাহ ধরে লাইসেন্স নবায়ন ও নতুন লাইসেন্স করা এবং গাড়ির ফিটনেস করার হার বেড়েছে গড়ে ৪০ শতাংশ। সপ্তাহখানেক আগে দিনে গড়ে ৮০টির মতো লাইসেন্স নবায়নের আবেদন পড়লেও বর্তমানে তা বেড়ে ১০০ ছাড়িয়েছে।
বিআরটিএকে ঘিরে দালালদের দৌরাত্য প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘দালাল তো আছেই। তবে তাদের বিরুদ্ধে আমরা কঠোর অবস্থানে আছি। মাঝেমধ্যেই ভ্রাম্যমাণ আদালতের মাধ্যমে অভিযান চালিয়ে তাদের সাজা দেওয়া হয়। তবে কিছুদিন পরই আবারও তারা ফিরে আসে।’
বিআরটিএ লাইসেন্স করতে আসা আবুল কালাম সারাবাংলাকে বলেন, মোটরসাইকেলসহ অন্য একটি হালকা যানের লার্নার লাইসেন্স করতে সরকারিভাবে ৫১৮ টাকা লাগে। কিন্তু তার জন্য তো অনেক বিড়ম্বনা। ব্যাংকে লাইনে দাঁড়িয়ে টাকা জমা দেওয়া, মেডিকেল সার্টিফিকেট সংগ্রহ করা, তারপরও দীর্ঘ লাইনে দাঁড়িয়ে কাগজপত্র জমা দেওয়া। এগুলো করতে দুই থেকে তিনদিন লেগে যায়। কিন্তু দালাল চক্রকে ১ হাজার থেকে ১৩০০ টাকা দিলে কোনো ঝামেলা ছাড়াই একদিনেই লার্নার লাইসেন্স সংগ্রহ করা যায়।
সারাবাংলা/জিএস/এমআই