লাইসেন্সধারী চালক সংকট, ঈদযাত্রার শিডিউলে অনিশ্চয়তা
১১ আগস্ট ২০১৮ ২১:১৫
।। আবদুল জাব্বার খান, সিনিয়র করেসপন্ডেন্ট।।
ঢাকা: এবারের ঈদযাত্রায় বাসের অগ্রিম টিকেট কেটে যারা স্বস্তির নিশ্বাস ফেলেছেন তাদের সেই স্বস্তির নিশ্বাস কতটা দীর্ঘ স্থায়ী হবে তা নিয়ে রয়েছে সংশয়।
প্রশাসনের পক্ষ থেকে আইন প্রয়োগে জোরালে পদক্ষেপ নেওয়ায় চালক সংকটে পড়েছেন বাস মালিকেরা। পর্যাপ্তসংখ্যক লাইসেন্সধারী চালক না থাকায় ঈদে বাসের শিডিউল কীভাবে নির্ধারণ করা হবে, তা নিয়ে তৈরি হয়েছে অনিশ্চয়তা।
এ অবস্থায় সুষ্ঠুভাবে ঈদ যাত্রা শেষ করতে, হয় আইন প্রয়োগে শিথিলতা আনতে হবে নচেৎ দ্রুত সময়ের মধ্যে বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষকে (বিআরটিএ) বিপুল সংখ্যক লাইসেন্স সরবরাহ করতে হবে।
বিআরটিএ’র ওয়েবসাইট খুঁজে দেখা যায়, সারাদেশে বাস-ট্রাকসহ ভারি যানহনের রেজিস্ট্রেশন সংখ্যা ২ লাখ ২৪ হাজার ৬৫৬টি। এর মধ্যে ঢাকা মেট্রোতে আছে ১ লাখ ৫ হাজার ২৫১টি। এই বিপুল সংখ্যক ভারি যানহবের বিপরীতে বৈধ লাইসেন্সধারী চালকের সংখ্যা আছে শতকরা ১৫ শতাংশ মাত্র। যে কারণে এবার ঈদ যাত্রায় চালক সংকট বিরাটাকার ধারণ করবে আশঙ্কা করছেন বাস মালিকরা।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে ঢাকা সড়ক পরিহবন মালিক সমিতির সভাপতি হাজী আবুল কালাম সারাবাংলাকে বলেন, লাইসেন্সধারী ভারি যানবাহনের চালকের সংকট আগে থেকেই ছিল। এক্ষেত্রে মিডিয়াম লাইসেন্সধারী চালকেরাও ভারি যানবহন পরিচালনা করতো। কিন্তু সম্প্রতি শিক্ষার্থীদের আন্দোলন, নতুন খসড়া আইন প্রণয়ন ও আইনের প্রয়োগ শুরু হওয়ায় লাইসেন্সধারী চালক সংকট ভয়াবহ আকার ধারণ করেছে। এ অবস্থায় ঈদে বাস যাত্রায় বিপর্যয়ের আশঙ্কা করছেন তিনি। পাশাপাশি বাস মালিকদের বিপুল পরিমাণে আর্থিক ক্ষতির শঙ্কা তৈরি হয়েছে।
তিনি বলেন, এবারের ঈদ যাত্রায় বিগত বছরের ন্যায় যাত্রী সংখ্যা হলে বাসের শিডিউল চরম পরিমাণে বিপর্যয় ঘটবে। বাস সংকটে যাত্রীরা হয়রানির শিকার হবে। বাসের অপেক্ষার প্রহণ গুনতে হবে দীর্ঘ সময় ধরে।
এক্ষেত্রে একটি উদাহরণ দিয়ে তিনি বলেন, একটি বাসের জন্য যেখানে কম করে হলেও দুইজন লাইসেন্স ধারী চালক থাকার কথা। সেখানে একজনই পাওয়া কষ্টসাধ্য। আর একজন চালককে দিয়ে একটানা কত ঘন্টা বাস চালানো সম্ভব হবে।
পরিবহন শ্রমিক ও বাস মালিকদের চাপে এক ধরনের মাইনকা চিপায় পড়ে আছেন বলে উল্লেখ করেন সমিতির এ নেতা।
চালক সংকটের বিষয়ে জানতে চাইলে হিমাচল পরিবহনের জেনারেল ম্যানেজার মো. বেলাল উদ্দিন সারাবাংলাকে বলেন,লাইসেন্সধারী চালক সংকট তো আছেই।
তিনি জানান, তাদের কোম্পানি হিমাচল পরিবহনে গাড়ি প্রতি একজন করে চালক নিয়োগ দেওয়া আছে।
লাইসেন্স দেখে তাদের কোম্পানিতে চালক নিয়োগ দেওয়া হয় উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘দূর পাল্লার গাড়িতে লাইসেন্সধারী চালক সংকট তেমনটা না থাকলেও ঢাকা শহরে চলমান গাড়িতে লাইসেন্সধারী চালক সংকট অনেক বেশি।’
লাইসেন্সধারী চালক সংকট প্রসঙ্গে ঢাকা জেলা ট্রাক কাভার্ড ভ্যান শ্রমিক ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদক মো. ইনসুর আলী সারাবাংলাকে বলেন, ‘৩৬ লাখ গাড়ির বিপরীতে লাইসেন্স আছে মাত্র ১৮ লাখ চালকের। এ অবস্থায় সংকট থাকাটা স্বাভাবিক। তবে অনেকের লাইসেন্স আছে কিন্তু মেয়াদ শেষ হয়ে যাওয়ায় নবায়ন করা হয়নি। তাছাড়া এতো দিন মিডিয়াম লাইসেন্স দিয়ে ভারি যানবাহন চালানোর সুযোগ ছিল। কেননা একজন চালকের যতই অভিজ্ঞতা থাকুক না কেন। লাইসেন্স করতে গেলে প্রথমে তাকে হালকা বা মিডিয়াম লাইসেন্স দেওয়া হয়। এক্ষেত্রে আইনের যথাযথ প্রয়োগ হলে গাড়ির তুলনায় চালক সংকট থাকবেই।’
ঢাকা-চট্টগ্রাম-কক্সবাজার রুটে চলাচলকারী ফাহিম এন্টারপ্রাইজের চালক শাহ আলম জানান, সঠিক লাইসেন্সধারী চালক সংকট তো থাকবেই। সরকার যদি লাইসেন্স করতে যথাযথ সুযোগ না দেয়। তাহলে সংকট দিনে দিনে আরও বাড়বে।
তিনি বলেন, ‘অনেক সময় সঠিক লাইসেন্স থাকলেও বিভিন্ন অজুহাতে পুলিশকে টাকা দিতে হয়। লাইসেন্স এবং কাগজপত্র থাকলেও যদি ঘুষ দিতে হয় তাহলে লাইসেন্স না করে ঘুষ দিয়ে গাড়ি চালানোই ভালো।’
এ সময় পাশে থাকা নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক চালক বলেন, ‘আগে গাড়ি প্রতি ২শ থেকে এক হাজার টাকা জরিমানা করতো। এখন ১৫শ থেকে দুই হাজার টাকা জরিমানা করে ছেড়ে দেয়। এ কারণে অনেক মালিকও গাড়ি রাস্তায় নামাতে চাচ্ছে না।’
আজকের এ অবস্থার জন্য মালিকেরও কিছু দায়বদ্ধতা রয়েছে উল্লেখ করে ঢাকা-সিলেট রুটে চলাচলকারী আল মোবারাকা পরিবহনের চালক মো. জালাল মোল্লা বলেন, ‘ঢাকা শহরের মধ্যে চলাচলকারী মিনিবাস, লেগুনাগুলোতে সড়কের কোনোদিক-ঠিক বুঝে উঠার আগেই অপ্রাপ্ত ছেলেদের হাতে গাড়ির স্টিয়ারিং ধরিয়ে দেওয়া হয়েছে। এই ছোট ছোট ছেলেরা না জানে আইন -কানুন, না জানে নিয়ম-নীতি।’
রাস্তায় একটি বড় গাড়ি কীভাবে চালাতে হবে, ছোট গাড়ি কীভাবে চালাতে হবে তা বুঝে না। একটি বড় গাড়ির গতি প্রতি খেয়াল না করেই নিজেদের মতো করে একটু ফাঁক পাইলেই গাড়ি ঢুকিয়ে দেয়। আর এ কারণেই দুর্ঘটনা ঘটে।
শুধু তাই নয়, দুর্ঘটনা এড়াতে যাত্রীদেরও অনেক দায়িত্ব রয়েছে। তিনি বলেন, ‘অনেক সময় গাড়ি একটু আস্তে চালালে যাত্রীরা বকাবকি করে। চালকদের উত্তেজিত করতে নানা রকম কটু কথা বলে। চালকদের আইন ভাঙতে তারা সাহস দেয়। অথচ উচিত ছিল চালকেরা আইন ভঙ্গ করলে তাকে ধরা। প্রয়োজনে আইন শৃঙ্খলা বাহিনীর কাছে অভিযোগ দেওয়া। এ কাজটি কোনো যাত্রী করে না। বরং আইন ভাঙতে উস্কানি দেয়। দোষ শুধু চালকের একার নয়, সকলেরই।’ এ কারণে আইনের যথাযথ প্রয়োগই হতে পারে সমাধান বলেও উল্লেখ করেন ২৪ বছরের অভিজ্ঞতা সম্পন্ন এ চালক।
আইনের ব্যাপারে তিনি বলেন, ‘আইনকে সবার শ্রদ্ধা করতে হবে। দেশের আইন মেনে চলা ভালো। সতর্ক থাকা ভালো। নতুন এ আইন হওয়াতে অনেকেই সতর্ক হয়ে গেছে। এখন রাস্তাঘাটে অনেকেই সোজা হয়ে গেছে। আইন মেনে চললে যানজটও তেমন পড়বে না।’
গত ২৯ জুলাই রাজধানীর বিমানবন্দর সড়কে কুর্মিটোলা এলাকায় জাবালে নূর পরিবহনের দুই বাসের রেষারেষিতে শহীদ রমিজ উদ্দিন কলেজের দুই শিক্ষার্থীর প্রাণহানি ঘটলে এর প্রতিবাদে এবং নিরাপদ সড়কের দাবিতে আন্দোলনে নামে বিভিন্ন স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থীরা। টানা এক সপ্তাহের আন্দোলনের তৃতীয় দিন থেকে সড়কে শৃঙ্খলা ফেরাতে ট্রাফিক নিয়ন্ত্রণের দায়িত্ব নেয় শিক্ষার্থীরা। এতে রাজধানীর ব্যস্ততম সড়কেও ফিরে আসে শৃঙ্খলা। বন্ধ হয়ে যায় অবৈধ যান চলাচল।
শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের দাবি অনুযায়ী দ্রুত নতুন আইনের খসড়া মন্ত্রিসভায় অনুমোদন হয়। এরপর শিক্ষার্থীরা ঘরে ফিরে যায়। প্রশাসনের পক্ষ থেকে ঘোষণা করা হয় ট্রাফিক সপ্তাহ।
সারাবাংলা/এজেডকে/একে