গুপ্তধনের বাড়িতে খোশ গল্পে কাটছে সময়
১২ আগস্ট ২০১৮ ০৮:৪৬
।। সাদ্দাম হোসাইন, স্টাফ করেসপন্ডেন্ট ।।
১১ আগস্ট, দুপুর দেড়টা। সুনসান নীরবতা মিরপুরের ১০ নাম্বার সেকসনের সি ব্লকের ১৬ নাম্বার রোড়টিতে। কিছু দিন আগেও ওই সড়কটিতে ছিল উৎসুক জনতার ভিড়। এখন আশপাশের বাসাবাড়ির মানুষ-জন ছাড়া তেমন কোনো মানুষের আনাগোনা নেই। আবার কেউ কেউ ওই সড়ক দিয়ে যাতায়াত করলেও অনুমানও করতে পারছেন না কিছু দিন আগে কি হয়েছিল ওই সড়কটির একটি বাড়িকে কেন্দ্র করে।
বলছিলাম গুপ্তধনের সন্ধানে সাড়ে চারফুট মাটি খনন করার ঘটনায় সম্প্রতি দেশজুড়ে আলোচনায় আসা ওই সড়কের ১৬ নম্বর বাড়িটির কথা। ওই বাড়িতে গুপ্তধনের সন্ধানে গত ২১ জুলাই মিরপুর থানা পুলিশের সহযোগিতায় উদ্ধার কাজ পরিচালনা করেন ঢাকা জেলা প্রসাশকের একজন নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট আনোয়ারুজ্জামান। ওই দিন সকাল সাড়ে দশটা থেকে বিকেল তিনটা পর্যন্ত প্রায় ২০জন শ্রমিক সাড়ে সাড়ে চারফুট মাটি খনন করেও গুপ্তধনতো দূরের কথা কোনো জিনিসই পাননি। সেই সঙ্গে আদৌ বাড়িটিতে কোনো গুপ্তধন আছে কিনা তাও নিশ্চিত হতে পারছিলেন না সংশ্লিষ্টরা।
এ কারণে ওই দিন পরবর্তী সময় অর্থাৎ ২২ জুলাই সকাল পর্যন্ত বাড়িটিতে খনন কাজ স্থগিত করা হয়। কিন্তু পরের দিন উদ্ধার কাজ শুরু না করে অনির্দিষ্ট সময়ের জন্য স্থগিত ঘোষণা করা হয় বিশেষজ্ঞদের মতামত অনুযায়ী আবার অভিযান চালানো হবে বলে। সেই সঙ্গে উদ্ধার কাজ সম্পন্ন না হওয়া পর্যন্ত বাড়িটি পুলিশের নিরাপত্তায় থাকবে বলে ঘোষণা দেন নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট তাজওয়ার আকরাম সাকাপি ইবনে সাজ্জাদ।
তারপর থেকে এখন পর্যন্ত ওই বাড়িটি নিরাপত্তার জন্য পুলিশের দখলে। সেখানে রাতদিন চলছে পুলিশের নিরাপত্তার দায়িত্ব। এজন্য শিফট অনুযায়ী সেখানে নিরাপত্তার দায়িত্ব পালন করছেন পুলিশ সদস্যরা। একেক শিফটে তিন থেকে চারজন করে দায়িত্ব পালন করছেন সেখানে।
বাড়িটিতে গুপ্তধনের সন্ধানে উদ্ধার কাজ চালানো হয়েছে এমন খবরে ওইদিন থেকে বাড়িটির সামনে উৎসুক জনতা ভিড় করতে থাকে। মিরপুরসহ রাজধানীর বিভিন্ন স্থান থেকে বাড়িটি দেখতে ছুটে আসতে থাকে সাধারণ মানুষরা। কিন্তু কয়েকদিনের ব্যবধানে সুনসান নীরবতায় রূপ নিয়েছে ওই বাড়িটির আশপাশ। মাত্র কয়েকদিনের ব্যবধানে সবাই এক প্রকার ভুলেই গেছে গুপ্তধনের বিষয়টা। তাই কেউ এখন আর ওই বাড়িকে ঘিরে ভিড় জমাচ্ছে না। এমনকি বাড়িটির সামনে দিয়ে হেঁটে গেলেও কেউ ফিরেও তাকাচ্ছে না।
বাড়িটির বিপরীত পাশের একটি বাড়ির কেয়ারটেকার মো. দুলাল বলেন, ‘গত কয়েক দিন হলো লোকজন আসা বন্ধ হয়েছে। তার আগে সকাল-বিকেল সবাই বাড়ির সামনে ঘুরঘুর করতো। একেকজন একেক দিক থেকে আইছিলো বাড়িটা দেখার জন্য। কিন্তু এখন তো লোকজন সব ভুলেই গেছে মনে হয়। এ বলেই তিনি হাসতে থাকেন। এরপর আবার বলেন, মজার বিষয় হইল ছাত্রগো আন্দোলনের কারণে সবাই এ বাড়ির কথা ভুলে গেছে। তই ভালোই হইছে। লোকজন এখন আর ভিড় করে না। তার মতে, ওই বাড়িতে গুপ্তধনের বিষয়টা একেবারেই গুজব।
সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, বাড়িটির মূল গেইট ভেতর থেকে বন্ধ। এরপর একজন কেয়ারটেকার শফিকুল এসে গেইট খুলে দিলেন। ভেতরে ডুকে দেখা যায় নুর হোসেন, মো. মিঠুন ও মো. রশেদুল ইসলাম নামে তিন পুলিশ সদস্য ওই বাড়ির ভেতর একটি রুমে বসে নিজেরা খোশ গল্প করছেন। নিজেদের অস্ত্র ও আত্মরক্ষার পোশাক রুমে থাকা খাটের উপর ছড়িয়ে ছিটিয়ে ফেলে রেখেছে। তিনজন তিনটি প্লাস্টিকের চেয়ারে বসে কথার ফাঁকে ফাঁকে মোবাইল টিপছেন তারা। তাদের তিনজনের দুজন আজকে প্রথম ডিউটি পড়েছে ওই বাড়িতে। বাকি একজনের প্রথম দিন ডিউটি পড়েছিল। তাই তিনি মোটামুটি ধারণা করছেন বাড়িটিতে আর যাই থাকুক গুপ্তধন বলে কোনো কিছু নেই। তবে উপরের নির্দেশ অনুযায়ী তারা ডিউটি পালন করতে বাধ্য বলে জানান তিনি।
তাদের সঙ্গে আলাপ হলে এ প্রতিবেদককে তারা জানান, বাড়িটিতে নিরাপত্তা বলতে কেউ যেন ভেতরে প্রবেশ না করতে পারে এবং কোনো ধরনের বিশৃঙ্খল সৃষ্টি করতে না পারে সে বিষয়ে কড়া নজর রাখা। কিন্তু এখন মানুষজনের তেমন কোনো আনাগোনা নেয় তাই তারা খোশ গল্প করে সময় পার করছেন বলে জানান। কতদিন ধরে এ দায়িত্ব চলতে থাকবে তাও জানেন না তারা। শুধু জানেন, যতদিন দায়িত্ব থাকবে ততদিন হয়তো এভাবে অলস সময় পার করবেন তারা।
এ বিষয়ে মিরপুর মডেল থানার উপ-পরিদর্শক (অপারেশন) আরিফুর রহমান সরদার সারাবাংলাকে বলেন, যতদিন পর্যন্ত ম্যাজিস্ট্রেটের নির্দেশ না পাওয়া যাবে ততদিন পর্যন্ত পুলিশ ওই বাড়িতে নিরাপত্তা দিবে। এতে ওই বাড়িতে গুপ্তধন থাকুক বা না থাকুক তাতে তাদের কিছুই করার নেই বলে জানান তিনিনি।
একই কথা জানালেন ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) দাদন ফকির। তিনি সারাবাংলাকে বলেন, ওই বাড়িতে পুলিশের নিরাপত্তা চাওয়ায় তা দেওয়া হয়েছে। কিন্তু গুপ্তধনের বিষয়ে আমরা কিছু বলতে পারব না। এটা ম্যাজিস্ট্রেট ভালো জানেন।
এ বিষয়ে ঢাকা জেলা প্রশাসকের নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট তাজওয়ার আকরাম সাকাপি ইবনে সাজ্জাদ সারাবাংলাকে বলেন, ওই বাড়িতে প্রাথমিক উদ্ধার কাজ চালিয়ে কোনো গুপ্তধনের সন্ধান পাওয়া যায়নি। এ জন্য উদ্ধার কাজ স্থগিত করে বিশেষজ্ঞদের মতামতের ভিত্তিতে কাজ চালাতে আমরা বিষয়টি নিয়ে লিখিত চিঠি দিয়েছি ভূতাত্ত্বিক জরিপ অধিদপ্তর ও বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়কে (বুয়েট)। তারা আমাদের চিঠির পরিপ্রেক্ষিতে পরীক্ষা করতে চেয়েছেন। গত কয়েকদিন শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের কারণে আমরা তাদের সঙ্গে সময় মিলাতে পারিনি। তবে চলতি সপ্তাহের যেকোনো দিন বিশেষজ্ঞদের নিয়ে ফের উদ্ধার কাজ চালানোর সম্ভাবনা রয়েছে বলে জানান তিনি।
উল্লেখ্য, গত ১০ জুলালাই টেকনাফের তৈয়ব নামে এক ব্যক্তি মিরপুর থানায় অভিযোগ করেন, ওই বাড়িতে বহুবছর আগে তার এক বন্ধু সৈয়দ আলমের আত্মীয়রা প্রায় ২ মণ স্বর্ণংলঙ্কার মাটিতে পুতিয়ে রেখে পাকিস্তান চলে গেছে। সম্প্রতি সে পাকিস্তান বেড়াতে গিয়ে এমন তথ্য পায় বলে জানায় থানাকে। এরপর তৈয়ব স্থানীয়দের মধ্যে বিষয়টিকে নিয়ে গুঞ্জন ছড়ায়। এতে এলাকায় তোলপাড় শুরু হয়। এক পর্যায়ে গত ১২ জুলাই রাত ১১টার দিকে গুপ্তধন উদ্ধারের জন্য চারজন যুবক ও ১জন মহিলা ওই বাড়িতে প্রবেশ করার চেষ্টা করে। কিন্তু বাড়িটির কেয়ারটেকারের কারণে প্রবেশ করতে পারেনি। এমতাবস্থায় বাড়িটির বর্তমান মালিক মনিরুল ১৪ জুলাই মিরপুর থানায় নিরাপ্তত্তা চেয়ে সাধারণ ডায়েরি করেন। তার অনুরোধের পরিপেক্ষিতে ২১ জুলাই গুপ্তধন উদ্ধার কাজ চালায় পুলিশ।
বাড়ির মালিক মনিরুল ইসলাম সারাবাংলাকে বলেন, ‘আমি গত আট বছর আগে এই বাড়িটি কিনেছি। বর্তমানে দুজন কেয়ারটেকার এই বাড়িতে বাস করেন। মিরপুর পল্লবীতে আমার আরেকটি বাড়িতে পরিবার নিয়ে বসবার করি।’
‘বাড়ির নিচে গুপ্তধন রয়েছে, কে বা কারা এ বিষয়ে থানায় জিডি করেন। এরপর গত ১২ জুলাই রাতে জোর করে কয়েকজন যুবক আমার বাড়ির ভিতরে ঢোকার চেষ্টা চালায়। পরদিন আমি মিরপুর মডেল থানায় গিয়ে এ সংক্রান্ত একটি সাধারণ ডায়ারি করি। পাশাপাশি আমার বাড়ির মাটির নিচে যদি কোনো ধরনের গুপ্তধন থাকে তবে তা উদ্ধারের আহ্বান জানাই।’
এ উদ্ধার কাজে সকল ব্যয়ভার নিজে বহন করারও আশ্বাসও দেন বাড়ির মালিক মনিরুল ইসলাম। তারপর থেকে গুপ্তধনের বিষয়টি নিশ্চিত না হওয়া পর্যন্ত বাড়িটি পুলিশের নিরাপত্তায় রয়েছে।
সারাবাংলা /এসএইচ/একে