‘বড় নেতার আশ্রয়ে খুনিরা, তাই পুলিশ ধরছে না’
১৭ আগস্ট ২০১৮ ১২:৩৫
।। উজ্জল জিসান, সিনিয়র করেসপন্ডেন্ট ।।
ঢাকা: বনানীর আমতলী এলাকায় যুবলীগের আহ্বায়ক ইউসুফ সরদার সোহেল ওরফে সুন্দরী সোহেল ও তার পাঁচ সহযোগী মিলে দেহরক্ষী কাজী রাশেদকে হত্যা করার যথেষ্ট তথ্য ও প্রমাণ থাকা সত্ত্বেও পুলিশ এখনো কাউকে গ্রেফতার করতে পারেনি।
রাশেদকে হত্যার এক মাস পার হলেও পুলিশ কেন আসামিদের গ্রেফতার করছে না তা বুঝতে পারছেন না রাশেদের পরিবার সদস্যরা।
রাশেদের মা রাবেয়া বেগম সারাবাংলাকে বলেন, ‘আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা কথা দিয়েছিল, হত্যার সঙ্গে জড়িত সবাইকে গ্রেফতার করা হবে। এক মাস হয়ে গেল এখনও কাউকে ধরতে পারেনি পুলিশ।’
রাশেদের মা বলেন, ‘ওরা অনেক শক্তিশালী। শুনেছি একজন বড় নেতা সোহেলদের শেলটার দিয়ে আসছেন। এ জন্য পুলিশ কাউকে ধরছে না।’
এ সময় রাশেদের মা কান্নায় ভেঙে পড়েন আর বলেন, ‘আমার ছেলেটাকে ওরা মেরেই ফেলল। আমি কি ছেলে হত্যার বিচার পাব না? রাশেদের একটা ছেলে আছে। ওর নাম আরহাম। বাবা কোথায় গেছে? আরহামকে জিজ্ঞাসা করলে সারাদিনই বলে, ‘বাবা অফিসে গেছে। কাজ করে বাসায় আসবে।’
আরহাম রাতের বেলা ঘুম থেকে উঠে ওর মাকে বলে, ‘বাবা কই। আসবে না?’ তখন ওর মা কান্নাকাটি করে। ছেলেকে বুকে জড়িয়ে নিয়ে কষ্ট চেপে থাকা ছাড়া আমাদের আর কী করার আছে-যোগ করেন রাশেদের মা।
রাশেদ হত্যাকাণ্ডের পর ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের একজন ঊর্ধতন কর্তকর্তা জানিয়েছিলেন, রাশেদ হত্যার ভিডিও ফুটেজ সংগ্রহ করে খুনিদের শনাক্ত করা হয়েছে। র্যাবের পক্ষ থেকেও একই কথা বলা হয়েছিল।
ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের (উত্তর) উপকমিশনার মশিউর রহমান সারাবাংলাকে বলেন,‘বনানীর যুবলীগ নেতার ব্যক্তিগত অফিসে রাশেদকে কারা হত্যা করেছে তা দিনের আলোর মতো পরিষ্কার। ডিবি পুলিশ ওইসব মামলা তদন্ত করে যেগুলোর শনাক্তবিহীন (আনডিটেকটেড) থাকে। কোনো ডিটেকডেট মামলা তদন্ত করে না। যেহেতু হত্যাকারীরা শনাক্ত এটা সবাই জানে। কাজেই ওটা থানা পুলিশ দেখবে। আমরা বলে দিয়েছি, বনানী থানা পুলিশ আসামিদের গ্রেফতার করবে। কেন গ্রেফতার করছে না তা সংশ্লিষ্ট থানা পুলিশই বলতে পারবে বলে’ যোগ করেন তিনি।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে বনানী থানার অফিসার ইনচার্জ (ওসি) বিএম ফরমান আলী সরকারি মুঠো ফোন নম্বরে কল করা হলে তিনি রিসিভ করেননি।
তবে মামলার তদন্ত কর্মকর্তা বনানী থানার এসআই শাহীনুল ইসলাম বলেন, রাশেদের হত্যাকারীদের কেউ কেউ শনাক্ত হয়েছে। সিসিটিভি ফুটেজে যে চারজনকে দেখা গেছে তারা হলেন- মহাখালীর দক্ষিণ পাড়ার ফিরোজ, আকিজপাড়ার দীপু, আমতলীর সন্ত্রাসী হাসু ও সোহেলের সহযোগী সন্ত্রাসী জাকির। যারা শনাক্ত হয়েছে তারা পলাতক। পুলিশ তাদের গ্রেফতারের চেষ্টা অব্যাহত রেখেছে।
গত ১৫ জু্লাই রাতে রাশেদকে হত্যার পর চারজন মিলে হাতে পলিথিন পেঁচিয়ে লাশ ফেলার দৃশ্য ধরা পড়ে পুলিশ কর্তৃক উদ্ধার করা সিটিটিভি ফুটেজে। পুলিশের উদ্ধার করা ওই ভিডিও ফুটেজে দেখা যায়, জাকির, হাসু, দীপু ও ফিরোজ মিলে হাতে পলিথিন পেঁচিয়ে রাশেদের লাশ নিয়ে যাচ্ছে। লাশ ফেলে আসার পর তারা পুনরায় সোহেলের ব্যক্তিগত ওই অফিসে প্রবেশ করছে।
পুলিশ জানায়, সুন্দরী সোহেলের অফিসের ভেতরেই ৬ জন মিলে (সোহেল, ফিরোজ, হাসু, দীপু, জাকির ও রবি) রাশেদকে গুলি করে। ওই সময় দরজা বন্ধ করে প্রচণ্ড শব্দে গান বাজছিল। যার ফলে গুলির শব্দ বাইরের কেউ শোনেননি। অফিসের মেঝেতে রক্ত ভেসে যায়। পানি দিয়ে সেই রক্ত ধুয়ে মুছে ফেলে তারা। রাশেদের শরীরও অনেক বেশি রক্ত মাখা অবস্থায় ছিল। লাশ ফেলার সময় রাস্তায় রক্ত পড়বে তাই রাশেদের শরীরও ধুয়ে দেওয়া হয়।
পুলিশ হত্যার পর জানিয়েছিল, গুলশান, বনানী ও মহাখালী এলাকার চাঁদাবাজি, টেন্ডারবাজি ও মাদকের আন্ডারওয়ার্ল্ড নিয়ন্ত্রণের টাকা ভাগাভাগি নিয়েই রাশেদকে হত্যা করা হয়। তদন্ত চলছে। জড়িতরা অবশ্যই ধরা পড়বে।
রাশেদের স্ত্রী মৌসুমী আক্তার সারাবাংলাকে বলেন, সবই তো শেষ হয়ে গেছে। এই দেশে হত্যাকারীরা ধরাছোঁয়ার বাইরে থাকে সেটাই প্রমাণ হলো। খুনের পরপরই আসামিরা গ্রেফতার হয়, এটাই দেখে আসছি। কিন্তু আমার স্বামীকে মেরে ফেলার এক মাস হলেও পুলিশ কাউকে গ্রেফতার করতে পারেনি।
হত্যাকারীদের ধরতে পুলিশ ও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর দৃষ্টি আকর্ষণ করেন তিনি।
তিনি বলেন, ‘এখন একমাত্র ছেলে আরহামকে নিয়ে এগিয়ে যাওয়ার স্বপ্ন দেখছি। ওরা এই স্বপ্নকেও বাঁচতে দেবে কি না সেই আশঙ্কাও করছি।’
কান্না জড়িত কণ্ঠে মৌসুমী বলেন, ‘যত রাতেই রাশেদ বাসায় ফিরত, আরহামের জন্য কিছু না কিছু খাওয়ার জিনিস নিয়ে ঘরে ঢুকত।’
দক্ষিণ আফ্রিকায় ছিলেন কাজী রাশেদ হোসেন। সোহেলের পরামর্শে প্রায় পাঁচ বছর আগে তিনি দক্ষিণ আফ্রিকা থেকে দেশে ফেরেন। তখন থেকে সোহেলের সাথেই চলাফেরা করতেন তিনি।
চার বছর আগে নীলফামারীর সৈয়দপুরের মেয়ে মৌসুমী আক্তারকে বিয়ে করেন রাশেদ। দুই বছর আগে তাদের এক ছেলে আরহামের জন্ম হয়। চার ভাইয়ের মধ্যে রাশেদ বড়। তাদের আরও দুই বোন রয়েছে। বাবা ব্রিটিশ আমেরিকা টোব্যাকোতে গাড়ি চালান। মা গৃহিণী।
সারাবাংলা/ইউজে/একে
আরও পড়ুন,
বনানীর যুবলীগ নেতা রাশেদ হত্যাকান্ডের সি সি টিভি ফুটেজ