ইজারা হয়নি, তবু প্রস্তুত ডিএসসিসির ৬ পশুর হাট!
১৪ আগস্ট ২০১৮ ০৮:১৮
।। সাদ্দাম হোসাইন, স্টাফ করেসপন্ডেন্ট ।।
ঢাকা: ঈদুল আজহাকে ঘিরে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের (ডিএসসিসি) ১৩টি পশুর হাটের মধ্যে এখনও ছয়টি হাটের ইজারাই সম্পন্ন হয়নি। দফায় দফায় দরপত্র আহ্বান করেও কোনো আবেদনপত্র পাওয়া যায়নি ওই হাটগুলোর বিপরীতে। এরই মধ্যে শেষ হয়েছে আবেদনের সময়সীমাও। এতে শেষ পর্যন্ত হাটগুলো বসবে না কি বন্ধ ঘোষণা করা হবে— তাও এখনও অনিশ্চিত। তবে এমন অনিশ্চয়তার মধ্যেও ইজারা ছাড়া হাট বসানোর সব আয়োজন প্রায় শেষের দিকে।
নিয়ম অনুযায়ী, ইজারা পাওয়া হাটগুলো বসানো হয় ঈদের তিন দিন আগে থেকে। ঈদের দিনসহ হাটগুলো চলে চার দিন। আর বসার দু’দিন আগে প্রস্তুত করা হয় হাট। কিন্তু ডিএসসিসি এলাকায় ঈদের প্রায় দু’সপ্তাহ আগে থেকেই প্রস্তুতি শুরু হয়েছে হাটগুলোর। জানা গেছে, এই মধ্যে ইজারা পাওয়া হাটগুলো তো বটেই, ইজারা না পাওয়া হাটগুলোও প্রস্তুত হয়ে গেছে। এতে করে এসব হাট থেকে রাজস্ব আদায় নিয়েই শঙ্কা জানিয়েছেন ডিএসসিসির রাজস্ব বিভাগের সংশ্লিষ্টরা।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, এসব হাট ইজারা ছাড়াই প্রস্তত করতে কাজ করছেন হাটগুলোর আশপাশের স্থানীয় ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ ও এর অঙ্গসংগঠনগুলোর নেতাকর্মীদের কয়েকটি সুনির্দিষ্ট প্রভাবশালী সিন্ডিকেট গ্রুপ। তাদের সঙ্গে নেপথ্যে থেকে কাজ করছেন স্থানীয় সংসদ সদস্যরাও। আর তাদের সহায়তা করছেন ডিএসসিসির সংশ্লিষ্ট শাখার কিছু কর্মকর্তা-কর্মচারী।
ইজারা না পাওয়া ডিএসসিসি’র ছয়টি পশুর হাট হলো— ব্রাদার্স ইউনিয়ন সংলগ্ন বালুর মাঠ, কমলাপুর স্টেডিয়ামের আশপাশের খালি জায়গা, আরমানিটোলা খেলার মাঠ ও আশপাশের খালি জায়গা, ধূপখোলা ইস্ট অ্যান্ড ক্লাব মাঠ, দনিয়া কলেজ মাঠ সংলগ্ন খালি জায়গা, সাদেক হোসেন খোকা মাঠ সংলগ্ন ধোলাইখাল ট্রাক টার্মিনাল ও সংলগ্ন খালি জায়গায়।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, প্রভাবশালী এসব সিন্ডিকেট গ্রুপ দরপত্র আহ্বানের আগেই ইজারা ছাড়াই হাট বসানোর প্রস্তুতি নিয়ে রেখছিল। যে কারণে পর পর তিন বার দরপত্র আহ্বান করেও ছয়টি হাটের বিপরীতে কোনো দরপত্রের আবেদনও জমা পড়েনি। এতে ডিএসিসির কাঙ্ক্ষিত ৮ কোটি ৭৯ লাখ ১০ হাজার ৫২৫ টাকা আদায়ে দেখা দিয়েছে অনিশ্চয়তা। এখন পর্যন্ত ১৩টি হাটের মধ্যে মাত্র সাতটি হাটের ইজারা হয়েছে। এসব হাট থেকে মাত্র ৩ কোটি ৩৯ লাখ ২৭ হাজার ১৫০ টাকা রাজস্ব আদায় করেছে ডিএসসিসি। মূলত ওই সাতটি হাটের দরপত্রে সিন্ডিকেট গ্রুপগুলোর আধিপত্যের কারণে কাঙ্ক্ষিত দরের চেয়ে নামমাত্র মূল্য পেয়েছে সংস্থাটি। ফলে ১২ কোটি ১৮ লাখ ৩৮ হাজার ৬৭৫ টাকার রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্য থাকলেও তা নিয়ে শঙ্কায় রয়েছে ডিএসসিসি।
ডিএসসিসি’র রাজস্ব বিভাগের একজন কর্মকর্তা না প্রকাশ না করার শর্তে সারাবাংলা’কে বলেন, হাটগুলো ইজারা না হওয়ায় ডিএসসিসি বিপুল পরিমাণ রাজস্ব হারাবে। হাটগুলো যদি ইজারা না দিয়ে ডিএসসিসি নিজস্বভাবেও খাস আদায় করে, তাহলেও কাঙ্ক্ষিত রাজস্বের চেয়েও বেশি আদায় হবে। কিন্তু স্থানীয় শক্তিশালী সিন্ডিকেট দলের কারণে তা সম্ভব নয়। আবার এসব সিন্ডিকেট দলের সঙ্গে সংস্থার কিছু কর্মকর্তা-কর্মচারীরাও জড়িত আছে বলে জানান ওই কর্মকর্তা।
ডিএসসিসির একজন কাউন্সিলর নাম প্রকাশ না করার শর্তে সারাবাংলা’কে বলেন, ওই হাটগুলো ইজারা হবে না। কারণ সাধারণ ইজারাদাররা শক্তিশালী সিন্ডিকেট গ্রুপের হুমকির ভয়ে আবেদনও করেনি। তাই সেগুলো ডিএসসিসি খাস আদায় করবে। এটা গত কয়েক বছর ধরেই হচ্ছে। আবার এ বছর নির্বাচনী বছর হওয়ায় খাস আদায়ের নামে ডিএসসিসিকে নামমাত্র কিছু অর্থ দিয়ে বাকি টাকা নেতাকর্মীরা নির্বাচনী কাজে ব্যয় করতে চাইবে এবং তারা সক্রিয় থাকার জন্য এ থেকে অর্থ আয় করবে।
ডিএসসিসি সূত্রে জানা যায়, এসব হাটের ইজারা না হওয়ায় পরবর্তী নির্দেশনার জন্য স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়কে লিখিতভাবে চিঠি দিয়েছে সংস্থাটি। ওই সংস্থা থেকেও এখনও কোনো নির্দেশনা আসেনি। তবে সংশ্লিষ্টদের ধারণা, ইজারা না হলেও হাটগুলো থেকে শেষ পর্যন্ত খাস আদায় করবে সংস্থাটি। আর এমন সুযোগেরর অপেক্ষায় শক্তিশালী সিন্ডিকেট। এ কারণে কোনো নির্দেশনা ছাড়াই হাটগুলো প্রস্তুত করছে ক্ষমতাসীন সিন্ডিকেট গ্রুপগুলো।
সরেজমিনে এসব হাট ঘুরে দেখা যায়, ইজারা পাওয়া হাটগুলোর পাশাপাশি ইজারা না পাওয়া হাটগুলোর প্রস্তুতিও প্রায় শেষ পর্যায়ে। শ্রমিকরা পুরোদমে ব্যস্ত সময় পার করছে হাট প্রস্তুত করার কাজে।
ব্রাদার্স ইউনিয়ন সংলগ্ন বালুর মাঠ ও কমলাপুর স্টেডিয়ামের আশপাশের খালি জায়গায় গিয়ে দেখা যায়, হাটের গোপীবাগ অংশ ও কমলাপুর রেলওয়ে উচ্চ বিদ্যায়ের সামনে দু’টি সুবিশাল গেট তৈরির কাজ শেষের দিকে। ভেতরে বাঁশ ও খুঁটি স্থাপনের কাজ করছেন শ্রমিকরা। একই চিত্র দনিয়া কলেজের বিপরীত পাশের খালি জায়গায়। সেখানে এরই মধ্যে বাঁশের খুঁটি ও বেড়া স্থাপন শেষের দিকে। স্থাপন করা হয়েছে ওয়াচ টাওয়ারও। কাল থেকে গরু ওঠানো শুরু হবে। এজন্য সেখানে ব্যাপারিরা রঙিন পোস্টার টাঙিয়ে গরুর বিজ্ঞাপন দিচ্ছেন।
অন্যদিকে, আরমানিটোলা খেলার মাঠ ও আশপাশের খালি জায়গায় পশুর হাট না বসানোর জন্য ডিএসসিসিকে লিখিত চিঠি পাঠিয়েছে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। সে হাটের দরপত্র আহ্বান করলেও কোনো আবেদন জমা পড়েনি। অথচ সিন্ডিকেট গ্রুপের সদস্যরা সেখানেও হাট বসানোর প্রস্তুতি নিচ্ছেন। এরই মধ্যে বাঁশের বেড়া ও খুঁটি স্থাপনের কাজ এগিয়ে চলছে। ওই হাটের কারণে রাজধানী থেকে দক্ষিণাঞ্চলে যাতায়াতে দুর্ভোগ হবে। সেই সঙ্গে সাধারণ জনগণের ঈদযাত্রায় নিরাপত্তা বিঘ্নিত হবে। এজন্য হাটটি বন্ধের জন্য চিঠি দিয়েছে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়।
এ বিষয়ে ডিএসসিসির সম্পত্তি কর্মকর্তা আব্দুল মালেক সারারাংলা’কে বলেন, ‘যেসব হাট এখনও ইজারা দেওয়া হয়নি, সেগুলোর ব্যাপারে স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়কে চিঠি দিয়েছি। তাদের নির্দেশনা অনুযায়ী পরবর্তী ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’ ইজারা ছাড়াই কিভাবে হাট বসানোর প্রস্তুতি চলে এবং হাটের প্রস্তুতিতে কারা জড়িত— এমন প্রশ্নে কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি তিনি।
তবে ডিএসসিসির নির্বাহী কর্মকর্তা খান মোহাম্মদ বিল্লাল জানান, ইজারা ছাড়া হাট বসানোর কোনো নিয়ম নেই। তিনি বলেন, ‘নিয়ম অনুযায়ী ঈদের দিন ও আগের তিন দিন মিলিয়ে চার দিন বসবে হাট। যারা ইজারা নিয়েছেন তারা হয়তো দুয়েকদিন আগেই প্রস্তুতি নিচ্ছেন। কিন্তু যেগুলো ইজারা হয়নি সেগুলোর প্রস্তুতির তো প্রশ্নই আসে না।’ যদি কেউ এমনটি করে থাকে, তবে খোঁজ নিয়ে প্রমাণ পেলে তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে বলেও জানান তিনি।
সারাবাংলাকে/এসএইচ/টিআর