ঢাকার ফুটপাত, দায় নেয় না কেউই
১৪ আগস্ট ২০১৮ ০৮:২৪
।। মাকসুদা আজীজ, অ্যাসিস্ট্যান্ট এডিটর ।।
ঢাকা : ফুটপাত ধরে হাঁটুন, না হলে দুর্ঘটনা ঘটবে— এই শিক্ষা প্রতিনিয়ত ঢাকার মানুষকে দিচ্ছে ট্রাফিক পুলিশ, সিটি করপোরেশন, এমনকি নাগরিকদের সুবিধা-অসুবিধা নিয়ে কাজ করা বিভিন্ন বেসরকারি সংস্থাও। কিন্তু ঢাকায় এখনও ফুটপাত দখল হয়ে চলেছে নানাভাবে। ফলে পথচারীরা বাধ্য হচ্ছেন পথে হাঁটতে। কিন্তু ফুটপাত দখল হয়ে যাওয়ার দায় পুলিশ কিংবা সিটি করপোরেশনের কেউই এককভাবে নিতে রাজি নয়। একে অন্যকে সাহায্যের কথা বললেও আদতে ফুটপাতকে পথচারীদের চলাচলের উপযোগী করতে তারা কাজ করছে না একসঙ্গে।
‘নিরাপদ সড়ক চাই’ তাদের ২০১৭ সাল সড়ক দুর্ঘটনা নিয়ে প্রকাশিত বার্ষিক রিপোর্টে দেখিয়েছে, সে বছর সড়ক দুর্ঘটনায় প্রাণ হারানো মানুষের শতকরা ৫০ ভাগ ছিল পথচারী। বুয়েটের দুর্ঘটনা গবেষণা ইনস্টিটিউটের মতে, এ সংখ্যা আরও বেশি।
দীর্ঘদিন ধরে নিরাপদ সড়কের দাবিতে সোচ্চার ‘নিরাপদ সড়ক চাই’ নামে প্রতিষ্ঠানটির প্রধান ইলিয়াস কাঞ্চনের বরাতে পাঠানো এক বিবৃতিতে জানানো হয়, সড়ক দুর্ঘটনার কারণ শুধু পথচারীদের নিয়ম না মানা নয়, এর কারণ ফুটপাতে চলাচল করতে না পারা, যথাযথ জায়গায় জেব্রা ক্রসিং না থাকাসহ পথচারী চলাচলে অসুবিধা।
মতিঝিল, ফার্মগেট, গুলিস্থান, মোহাম্মদপুর, শ্যামলী, নিউমার্কেট, বনানী, উত্তরা— এমন কোনো এলাকাই ঢাকায় নেই, যেখানে ফুটপাত দখলের সমস্যা নেই। এমনকি সচিবালয় বা গণভবনের উল্টো দিকের ফুটপাতেও মাঝে-মধ্যে বসে পড়ে হকার। শহরটাই যেন একটি স্থায়ী বাজার।
যেসব জায়গায় হকার নেই, সেখানে হয়তো বহু ভবনের সিঁড়ি, গাড়ির পার্কিং দিয়ে দখল করে রাখা হয়েছে ফুটপাত। এছাড়াও নির্মাণাধীন ভবনের সরঞ্জাম, আবর্জনা ইত্যাদি মিলিয়ে নগরের প্রায় সব ফুটপাতের হাল অনেকটা ‘জোর যার মুল্লুক তার’।
শুধু তাই নয়, নিয়ম-নীতির তোয়াক্কা না করেই ফুটপাতের ওপর দিয়ে চলে বাইক। ২০১২ সালে হাইকোর্ট ফুটপাতে বাইক চালানো বিষয়ক এক নির্দেশনা দেন। তাতে বলা হয়, ফুটপাতে বাইক চালালে তাৎক্ষণিক ব্যবস্থা নেওয়া হবে। কিন্তু সেই নির্দেশনা উপেক্ষা করেই ট্রাফিক পুলিশের সামনেই ফুটপাতে চলে বাইক। ফলাফল নিরাপদ সড়ক ব্যবস্থাপনায় কোনো ভূমিকাই রাখতে পারে না ফুটপাত।
অভিযোগ আছে, ফুটপাতের দখলদাররা নিজেদের নিয়মে ফুটপাত চালান। তাদের নিজস্ব গঠনতন্ত্রে চলে ফুটপাতের ভাগ-বাটোয়ারা। এমনকি ফুটপাতের স্থান বরাদ্দ দিতে করা হয় নিলামের আয়োজনও।
এ বছরের শুরুতেই হকার উচ্ছেদ করে ফুটপাত দখলমুক্ত করতে গিয়ে স্থানীয় মেয়র ডা. সেলিনা হায়াৎ আইভী ও নারায়ণগঞ্জ ৪ আসনের সংসদ সদস্য সেলিম ওসমানের মধ্যে দ্বন্দ্ব তৈরি হয়। ওই সময় ডা. আইভী আহতও হন। এত কিছুর পরও নারায়ণগঞ্জের ফুটপাত যথারীতি বেহাত।
দখল হয়ে যাওয়া ফুটপাতের দায় কার?— এ প্রশ্ন করা হয় ট্রাফিক পুলিশের সর্বোচ্চ কর্মকর্তা অতিরিক্ত কমিশনার রেজাউল আলমকে। তিনি সারাবাংলা’কে বলেন, ‘ফুটপাতের দায়িত্ব পুরোপুরি সিটি করপোরেশনের। আমরা ট্রাফিক পুলিশের পক্ষ থেকে মাঝে-মধ্যে ব্যবস্থা নিয়ে থাকি। ফুটপাতে যেন মোটরসাইকেল চলাচল না করতে পারে, তাই পোল বসিয়ে দেই। এগুলো নিয়ে সিটি করপোরেশনগুলোর সঙ্গে আমাদের মনোমালিন্যও হয়।’
একই প্রশ্ন করা হয় ঢাকার দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের মেয়র মোহাম্মদ সাঈদ খোকনকে। প্যান প্যাসিফিক সোনারগাঁয়ে রোববার (১২ আগস্ট) ক্লিন অ্যান্ড সেফ মোবিলিটি প্রোগ্রাম শিরোনামে ট্রাফিক ব্যবস্থাপনার এক কার্যক্রম উদ্বোধনের অনুষ্ঠানে সারাবাংলা’র করা এ প্রশ্নের জবাব তিনি বলেন, ‘ফুটপাতের দখল উচ্ছেদ করার বিষয়ে দক্ষিণ সিটি করপোরেশন খুবই তৎপর। তবে এটাও মনে রাখতে হবে, সিটি করপোরেশনের নিজস্ব কোনো বাহিনী নেই। এই কাজের জন্য তারা পুলিশের ওপর নির্ভরশীল। তাই সার্বক্ষণিকভাবে ফুটপাতের দখল নিয়ে কাজ করা দুরূহ ব্যাপার।’
মেয়র এও জানান, ফুটপাতের দখল যে সবসময় নিরীহ হকাররা করে, তাও নয়। এর পেছনে অনেক প্রভাবশালী মহল জড়িত থাকে। এরকম পরিস্থিতে ফুটপাত পুরোপুরি দখলমুক্ত করা খুব সহজ নয়।
সিটি করপোরেশন বিভিন্ন সময় হকারদের পুনর্বাসনের কার্যক্রম নিয়ে থাকে। তবে শহরমুখী জনতার স্রোতে দ্রুতই ফুটপাতে এসে বসে নতুন কোনো হকার।
তাহলে বেড়ালের গলায় ঘণ্টাটা বাঁধবে কে? এই সমস্যার সমাধান করতে না পেরে ফুটপাত সবসময়ই থেকে যায় ফুটপাতের মূল মালিক পথচারীদের নাগালের বাইরে। পথচারীরা বাধ্য হয় পথে নেমে চলাচল করতে। পথচারীরা আগে ফুটপাতে উঠবে নাকি ফুটপাত আগে দখলমুক্ত হবে— সেই প্রশ্নে লম্বা হয় সড়ক দুর্ঘটনায় পথচারীদের মৃত্যুর মিছিল।
সারাবাংলা/এমএ/টিআর