বঙ্গবন্ধুবিহীন বাংলাদেশে থাকেন না তিনি, শুধু আগস্টে ছুটে আসেন
১৫ আগস্ট ২০১৮ ০৯:৫১
।। রমেন দাশগুপ্ত, স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট ।।
চট্টগ্রাম ব্যুরো : একাত্তরের রণাঙ্গনের বীর সেনানী চট্টগ্রামের অমলেন্দু সরকার। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমানকে হত্যার প্রতিবাদে চট্টগ্রামের যে ক’জন তরুণ-যুবক এবিএম মহিউদ্দিন চৌধুরীর নেতৃত্বে অস্ত্র হাতে তুলে নিয়েছিলেন, অমলেন্দু তাদের একজন।
এমনকি হত্যাকারীদের উপর পাল্টা আক্রমণের জন্য সশস্ত্র প্রতিরোধের প্রশিক্ষণ নিতে অমলেন্দু গিয়েছিলেন ভারতে। তবে তৎকালীন সেনাশাসনের নিষ্ঠুর বাস্তবতায় তারা বড় ধরনের কোনো প্রতিরোধ গড়ে তুলতে পারেননি। ফলে ফিরে এসেছিলেন প্রায় সব সহযোদ্ধা। কিন্তু বঙ্গবন্ধুহীন বাংলাদেশে আর ফেরেননি অমলেন্দু সরকার।
যে দেশে বঙ্গবন্ধু নেই, সেইদেশে আর ফিরবেন না- এমন শপথ নিয়েছিলেন পাকিস্তান আমলের ছাত্রলীগের ডাকসাইটে নেতা অমলেন্দু সরকার। তবে বছরের পুরো সময় ভারতে থাকলেও আগস্ট এলে অমলেন্দুর বুকের ভেতরে তোলপাড় শুরু হয়। মন টেকে না ভারতে। চোখের সামনে ভেসে ওঠে বঙ্গবন্ধুর নির্মম হত্যাকাণ্ড, প্রতিবাদ-প্রতিরোধের সেই দুঃসহ দিনগুলোর স্মৃতি। আগস্ট এলেই তাই তিনি চলে আসেন বাংলাদেশে। নীরবে টুঙ্গিপাড়ায় যান। চট্টগ্রামে বঙ্গবন্ধুর স্মৃতিবিজড়িত যেসব জায়গা আছে সেগুলোতে যান। সহযোদ্ধাদের মধ্যে যারা বেঁচে আছেন তাদের সঙ্গে দেখা করেন আর নীরবে চোখের জল ফেলেন।
এবারও ব্যতিক্রম হয়নি। এক সপ্তাহ আগেই অমলেন্দু সরকার এসেছেন চট্টগ্রামে।
সারাবাংলার সঙ্গে কথা হয় অমলেন্দু সরকারের। তিনি বলেন-মুক্তিযুদ্ধ যখন হয় কিংবা বঙ্গবন্ধুকে হত্যার প্রতিশোধ নিতে আমরা যখন অস্ত্র হাতে নিয়েছিলাম, তখন আমাদের তরুণ বয়স। বঙ্গবন্ধুর জন্য জীবনের শ্রেষ্ঠ সময়টা, এমনকি নিজের জীবনটাকেও হাসিমুখে বিলিয়ে দিতে প্রস্তুত ছিলাম। সেই নেতা যেখানে নেই, সেখানে আমি আর যাব না-তরুণ বয়সে এমন আবেগময় একটা সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম।
‘তবে বাংলাদেশে, যে দেশকে আমরা যুদ্ধ করে স্বাধীন করেছি, সেই দেশে না এসে থাকতে পারি না। আগস্ট এলেই আমার মধ্যে কেমন যেন একটা অনুভূতি হয়, এটা আমি বলে বোঝাতে পারব না। আমাকে ছুটে আসতেই হয়। যে মাটিতে বঙ্গবন্ধু শুয়ে আছেন, সেই মাটির টান আমি এড়িয়ে যেতে পারি না’, যোগ করেন এই মুক্তিযোদ্ধা।
অমলেন্দু সরকারের বাড়ি চট্টগ্রামের হাটহাজারী উপজেলার মদুনাঘাটে। শৈশবেই ছাত্রলীগের রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়েন। ছিলেন শেখ মুজিবর রহমানের কট্টর অনুসারী। মুক্তিযুদ্ধের সময় ঘনিষ্ঠতা গড়ে উঠে সেসময়কার ছাত্রলীগের ডাকসাইটে নেতা এবিএম মহিউদ্দিনের সঙ্গে।
মুক্তিযুদ্ধ পরবর্তী সময়ে মহিউদ্দিন-অমলেন্দুরা ছিলেন যুবলীগ সভাপতি শেখ ফজলুল হক মণির অনুসারী। তারা জয় বাংলা স্বেচ্ছাসেবক বাহিনী গঠন করেছিলেন। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট যখন বঙ্গবন্ধুকে নৃশংসভাবে হত্যা করা হয়, তার আগের রাতে অমলেন্দুরা ছিলেন ঢাকায়।
অমলেন্দু সরকার বললেন, ‘ভোরের দিকে বঙ্গবন্ধুকে হত্যার খবর শুনে আমরা পাগলের মতো রাস্তায় বের হয়ে পড়ি। দেখি ঢাকার রাস্তায় সেনাবাহিনী টহল দিচ্ছে। ট্যাংক নামানো হয়েছে। ছুটে যাই পিজিহাসপাতালে। আমাদের প্রিয় নেতা শেখ মনি ও তার স্ত্রীর মরদেহ তখন পিজিতে নেওয়া হয়েছে। আমরা কান্নায় ভেঙে পড়ি। পরবর্তীতে মহিউদ্দিন ভাইয়ের সঙ্গে যোগাযোগ হয়। রেললাইন ধরে পায়ে হেঁটে অনেক দূর চলে আসি। অনেক কষ্ট করে চট্টগ্রামে ফিরি। মহিউদ্দিন ভাই বললেন, এ হত্যার প্রতিশোধ নিতে হবে। চট্টগ্রামকে বাংলাদেশ থেকে বিচ্ছিন্ন করে দেব আমরা।’
‘রেললাইন ধরে হেঁটে হেঁটে চট্টগ্রামে পৌঁছাই। চট্টগ্রামের টাউন ইন্সপেক্টর মাসুদুর রহমান এবং এসপি বললেন, অমলেন্দু বাবু আপনাকে আর্মি খুঁজছে। পেলে মেরে ফেলবে। তারপর আমি মন্ত্রী ফণী ভূষন মজুমদারের সঙ্গে যোগাযোগ করে ভারতের হাইকমিশনার সুবিমল মিত্রের মাধ্যমে বিমানে করে ভারতে চলে যাই। মোস্তফা মহসীন মন্টুকেও (গণফোরাম নেতা) আর্মি জোরপূর্বক বিমানে তুলে ভারতে পাঠিয়ে দেয়। পরে মহিউদ্দিন ভাইদের সঙ্গে সেখানে আমাদের যোগাযোগ হয়।’ বলেন অমলেন্দু সরকার
অমলেন্দু জানান, আগরতলা ক্যাম্পে তাদের প্রশিক্ষণ শুরু হয়। হিমালয়ের তান্দুয়ায় হয় উচ্চতর প্রশিক্ষণ। সেসময় আওয়ামী লীগের এমপি চিত্তরঞ্জন সুথারও তাদের সঙ্গে ছিলেন। তিনি কয়েকজন এমপির মধ্যে একজন, যিনি বঙ্গবন্ধু হত্যার সশস্ত্র প্রতিবাদের পরিকল্পনা করেছিলেন। পরে ১৯৭৬ সালের মার্চে জেল থেকে বেরিয়ে মহিউদ্দিন চৌধুরী ভারতে গিয়ে প্রশিক্ষণে যোগ দেন।
ভারতে অবস্থান নিয়ে বিদ্রোহে যুক্ত হয়েছিলেন আওয়ামী লীগ নেতা শেখ ফজলুল করিম সেলিম ও তার ভাই শেখ মারুফ, আবুল হাসনাত আবদুল্লাহ, বর্তমান স্বাস্থ্যমন্ত্রী মোহাম্মদ নাসিমসহ অনেক আওয়ামী লীগ-যুবলীগ-ছাত্রলীগ নেতা।
১৯৭৭ সালের মাঝামাঝিতে ভারতের রাজনৈতিক দৃশ্যপট পাল্টে যায়। বাংলাদেশেও সামরিক অভ্যুত্থান, পাল্টা অভ্যুত্থানের ধারাবাহিকতায় ক্ষমতায় আসেন সামরিক শাসক জিয়াউর রহমান। প্রশিক্ষণরত নেতাকর্মীদের অনেককে পুশ ব্যাক করে ভারত। টিকতে না পেরে অনেকেই বাংলাদেশে ফিরে আসেন। এতে সশস্ত্র প্রতিবাদের পরিকল্পনা বাস্তবায়নে ছেদ পড়ে।
বঙ্গবন্ধু হত্যার প্রতিশোধ নিতে গিয়ে যারা অস্ত্র হাতে তুলে নিয়েছিলেন, ১৯৮১ সালে শেখ হাসিনা দেশে ফেরার পর তাদের অনেকেই দেশে ফিরে আসেন। কিন্তু ফেরেননি একজন, তিনি অমলেন্দু সরকার।
না ফেরার কথা বলতে গিয়ে আবেগাপ্লুত হন অমলেন্দু। বলেন, ‘মহিউদ্দিন ভাই আর আমি থেকে গেলাম। একসময় মহিউদ্দিন ভাই ফিরে আসেন। আমার এক কথা, বঙ্গবন্ধু যেখানে নেই সেখানে আমি যাব না। এরপর আমার জীবনের আসল ট্র্যাজেডি শুরু হয়। কলকাতা থেকে সবজি-আলু নিয়ে গিয়ে বারাসাতে বিক্রি করেছি। মাথায় করে কাপড় ফেরি করে বিক্রি করেছি। ভারতের মাটিতে প্রতিষ্ঠা পেতে অনেক কষ্ট করতে হয়েছে।’
অমলেন্দু সরকার জানান, শেখ হাসিনা দেশে ফেরার পর ১৯৮২ সালে অমলেন্দু সরকারও একবার গোপনে বাংলাদেশে আসেন। কয়েকদিন থেকে আবার চলে যান। আশির দশক থেকে প্রায় প্রতিবছরই আগস্টে তিনি দেশে এসেছেন।
‘সেলিম ভাই (শেখ সেলিম) ও উনার স্ত্রী মণি ভাইয়ের দুই ছেলে তাপস আর পরশ, নিজের ছেলে সুভাষকে নিয়ে ইন্ডিয়া গিয়েছিলেন। তাদের বয়স তখন ১২ থেকে ১৫ মাসের মধ্যে। আমাদের কোলেপিঠেই তারা বড় হয়েছে। আগস্টে দেশে আসলে সেলিম ভাইয়ের বাসায় যাই। তাপস-সুভাষদের সঙ্গে দেখা করি। নাসিম ভাইয়ের (স্বাস্থ্যমন্ত্রী) কাছে যাই। হাসনাত (আবুল হাসনাত আবদুল্লাহ) ভাইয়ের কাছে যাই। টুঙ্গিপাড়া যাই।’
মহিউদ্দিন চৌধুরীর কথা বলতে গিয়ে কেঁদে ফেলেন অমলেন্দু সরকার। তিনি বলেন, মহিউদ্দিন ভাই তো শুধু রাজনৈতিক সহকর্মী ছিলেন না, আমার বড় ভাইয়ের মতো ছিলেন। প্রতিবার ইন্ডিয়া থেকে এসে নিজের আত্মীয়স্বজনের কাছে যাবার আগে মহিউদ্দিন ভাইয়ের বাসায় যেতে হয়েছে। সেই মহিউদ্দিন ভাই এখন নেই। মনকে বোঝাতে পারছি না।
যতদিন বেঁচে থাকবেন এবং সক্ষম থাকবেন ততদিন আগস্টে দেশে আসবেনই, এমন প্রতিজ্ঞা অমলেন্দু সরকারের।
এছাড়া বছরে আরও একবার অমলেন্দু সরকার দেশে আসেন। ডিসেম্বরে। যে মাসে স্বাধীন হয়েছিল বাংলাদেশ।
যাদের আত্মত্যাগে স্বাধীনতা পেয়েছে বাঙালি জাতি, পেয়েছে লাল-সবুজের পতাকা, সেই বীরদের একজন অমলেন্দু সরকার, বঙ্গবন্ধুবিহীন বাংলাদেশে ৩০ লাখ শহীদের রক্তেভেজা মাটিই যাঁকে টেনে আনে বারবার।
সারাবাংলা/আরডি/এসএমএন