সেলিম আল দীনের জন্মজয়ন্তীতে শ্রদ্ধা
১৮ আগস্ট ২০১৮ ১২:৩৪
।। জাবি করেসপন্ডেন্ট ।।
নাট্যাচার্য সেলিম আল দীনের ৬৯তম জন্মজয়ন্তী উপলক্ষে শোভাযাত্রা অনুষ্ঠিত হয়েছে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে (জাবি)। একইসঙ্গে তার সমাধিতে শ্রদ্ধা জানিয়েছেন বিশ্ববিদ্যালয়ের উপ-উপাচার্যসহ নাটক ও নাট্যতত্ত্ব বিভাগের শিক্ষক-শিক্ষার্থী ও নাট্যব্যক্তিত্বরা।
শনিবার (১৮ আগস্ট) সকালে সেলিম আল দীনের জন্মজয়ন্তী উপলক্ষে একটি শোভাযাত্রা বের হয় জাবি নাটক ও নাট্যতত্ত্ব বিভাগ থেকে। শোভাযাত্রায় অংশ নেন জাবি উপ-উপাচার্য (শিক্ষা) মো. নূরুল আলম, কোষাধ্যক্ষ অধ্যাপক শেখ মো. মনজুরুল হক, নাট্যব্যক্তিত্ব ও ঢাকা থিয়েটারের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা মুক্তিযোদ্ধা নাসির উদ্দিন ইউসুফ বাচ্চু, জাবি নাটক ও নাট্যতত্ত্ব বিভাগের চেয়ারম্যান ড. ইউসুফ হাসান অর্ক, একই বিভাগের সিনিয়র শিক্ষক অধ্যাপক ড. আফসার আহমদ, আমার গান টেলিভিশনের উপ অনুষ্ঠান প্রধান ড. ইসলাম শফিকসহ নাটক ও নাট্যতত্ত্ব বিভাগের অন্যান্য শিক্ষক ও শিক্ষার্থীরা। শোভাযাত্রা শুরুর আগে নাটক ও নাট্যতত্ত্ব বিভাগের শিক্ষার্থীরা সেলিম আল দীন রচিত সঙ্গীত পরিবেশন করেন।
শোভাযাত্রাটি বিশ্ববিদ্যালয় চত্বর প্রদক্ষিণ করে। শোভাযাত্রা শেষে বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় মসজিদের পাশে সেলিম আল দীনের সমাধিতে ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা জানানো হয়। এরপর একে একে নাট্যদল ঢাকা থিয়েটার ও স্বপ্নদল ছাড়াও জাবি নাটক ও নাট্যতত্ত্ব বিভাগ, বাংলাদেশ গ্রাম থিয়েটার, সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোট সাভার, ছাত্র শিক্ষক কেন্দ্র, বঙ্গ থিয়েটার, বাংলদেশের পুতুল নাট্য গবেষণা ও উন্নয়ন কেন্দ্র, বুনন থিয়েটার, অন্নিতা সেলিম আল দীন পাঠশালা, জাহাঙ্গীরনগর থিয়েটার, তালুকনগর থিয়েটারসহ জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় ও ঢাকার বিভিন্ন নাট্য সংগঠন ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা জানায় তার সমাধিতে। এছাড়া অন্যান্য সামাজিক-সাংস্কৃতিক সংগঠনের পক্ষ থেকেও নাট্যাচার্যের সমাধিতে শ্রদ্ধা জানানো হয়।
পরে ‘গ্লোবাল ভিলেজে সেলিম আল দীন’ শীর্ষক এক সেমিনার অনুষ্ঠিত হয় জাবি নাটক ও নাট্যতত্ত্ব বিভাগে। সেমিনারে অংশ নেন নাসির উদ্দিন ইউসুফ বাচ্চু, নাট্যব্যক্তিত্ব আতাউর রহমানসহ অন্যান্যরা অংশ নেন।
এর আগে, বাংলা নাটকের অন্যতম এই পুরোধার জন্মজয়ন্তীকে ঘিরে দুই দিনের বিশেষ উৎসব শুরু করেছে নাট্যদল ‘ঢাকা থিয়েটার’ ও ‘স্বপ্নদল’। শুক্রবার (১৭ আগস্ট) বিকেলে স্মারক বক্তৃতার মধ্য দিয়ে শুরু হয় ঢাকা থিয়েটারের অনুষ্ঠান। এদিন সন্ধ্যায় নাট্যশালার মূল মিলনায়তনে মঞ্চস্থ হয় শিমুল ইউসুফের নির্দেশনায় সেলিম আল দীনের লেখা নাটক ‘ধাবমান’। অন্যদিকে, স্বপ্নদলের দুই দিনের উৎসবও শুরু হয় শুক্রবার সন্ধ্যায়। ‘সেলিম আল দীন সতত অনিবার্য রয়, বাঙলা নাট্যের শিল্পসুধা বিশ্ব করবে জয়’ প্রতিপাদ্যে উৎসবের শুরুতে নাট্যাচার্যের জীবন-কর্ম-দর্শন নিয়ে আলোচনা হয়। পরে মঞ্চস্থ হয় বাদল সরকারের রচনা অবলম্বনে জাহিদ রিপনের রূপান্তর ও নির্দেশনায় স্বপ্নদল প্রযোজনা ‘ত্রিংশ শতাব্দী’। শনিবার সন্ধ্যায় সেলিম আল দীন রচিত স্বপ্নদল প্রযোজনা ‘হরগজ’ মঞ্চস্থ হবে এক্সপেরিমেন্টাল থিয়েটারে।
সেলিম আল দীনের জন্ম ১৯৪৯ সালে, ফেনীতে। ফিরোজা খাতুন ও মফিজউদ্দিন আহমেদ দম্পতির তৃতীয় সন্তান তিনি। ফেনীতে জন্ম হলেও বাবার চাকরির সূত্রে ফেনী, চট্টগ্রাম, সিলেট, ব্রাহ্মণবাড়িয়া ও রংপুরের বিভিন্ন স্থানে তার শৈশব ও কৈশোর কেটেছে। ১৯৯৫ সালে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পিএইচডি ডিগ্রি লাভ করেন তিনি। তার পিএইচডি অভিসন্দর্ভের বিষয় ছিল মধ্যযুগীয় বাংলা সাহিত্যে নাটক।
পরে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের নাটক ও নাট্যতত্ত্ব বিভাগ প্রতিষ্ঠা করেন সেলিম আল দীন। ওই বিভাগ থেকেই তার সম্পাদনায় প্রকাশিত হতো নাটক বিষয়ক পত্রিকা ‘থিয়েটার স্টাডিজ’। নাট্যচর্চার জন্য ঢাকা থিয়েটার প্রতিষ্ঠাতেও ভূমিকা ছিল তার। পরে সারাদেশে নাট্যআন্দোলনকে ছড়িয়ে দিতে ১৯৮১-৮২ সালে আরেক নাট্যযোদ্ধা নাসিরউদ্দীন ইউসুফের সঙ্গে গড়ে তোলেন বাংলাদেশ গ্রাম থিয়েটার।
ঔপনিবেশিক সাহিত্য ধারার বিপরীতে দাঁড়িয়ে বাংলা নাটককে আবহমান বাংলার গতিধারায় ফিরিয়ে এনেছিলেন নাট্যাচার্য সেলিম আল দীন। বাংলা নাটকে বিষয়, আঙ্গিক আর ভাষা নিয়ে গবেষণা ও নাটকে তার প্রতিফলন তুলে ধরার মাধ্যমে রবীন্দ্র পরবর্তী যুগের সবচেয়ে শক্তিশালী নাট্যব্যক্তিত্ব তিনি। স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে বাংলা নাটকের যে আন্দোলন, তার পেছনেও রয়েছে সেলিম আল দীনের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা।
নাটক রচনার পাশাপাশি নাটক নিয়ে তিনি গবেষণা চালিয়ে গেছেন আজীবন। বাংলা ভাষার একমাত্র নাট্যবিষয়ক কোষগ্রন্থ ‘বাংলা নাট্যকোষ’ সংগ্রহ, সংকলন, প্রণয়ন ও সম্পাদনা করেছেন তিনি নিজেই। তার রচিত ‘হরগজ’ নাটকটি সুয়েডীয় ভাষায় অনূদিত হয় এবং এ নাটকটি ভারতের রঙ্গকর্মী নাট্যদল হিন্দি ভাষায় মঞ্চায়ন করেছে। আদিবাসী জনগোষ্ঠীর জীবনাচরণকেন্দ্রিক এথনিক থিয়েটারেরও উদ্ভাবনকারী তিনিই।
সেলিম আল দীনের লেখা নাটকের মধ্যে ‘জন্ডিস ও বিবিধ বেলুন’, ‘মুনতাসির ফ্যান্টাসি’, ‘শকুন্তলা’, ‘কীত্তনখোলা’, ‘কেরামতমঙ্গল’, ‘যৈবতী কন্যার মন’, ‘চাকা’, ‘হরগজ’, ‘প্রাচ্য’, ‘হাতহদাই’, ‘নিমজ্জন’, ‘ধাবমান’, ‘পুত্র’, ‘বনপাংশুল’ উল্লেখযোগ্য। ময়মনসিংহ গীতিকা অবলম্বনে তার গবেষণাধর্মী নির্দেশনা দুইটি— ‘মহুয়া’ ও ‘দেওয়ানা মদিনা’। তার রচিত ‘চাকা’ ও ‘কীত্তনখোলা’ অবলম্বনে চলচ্চিত্র নির্মিত হয়েছে।
রাজধানীর একটি বেসরকারি হাসপাতালে ২০০৮ সালের ১৪ জানুয়ারি মৃত্যুবরণ করেন সেলিম আল দীন। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে কেন্দ্রীয় মসজিদের কাছে তাকে সমাহিত করা হয়।
আরও পড়ুন-
সারাবাংলা/টিআই/টিআর