কামার পট্টিতে ক্রেতা সংকট, শঙ্কায় ব্যবসায়ীরা
১৯ আগস্ট ২০১৮ ০৯:৩২
।। সাদ্দাম হোসাইন, স্টাফ করেসপন্ডেন্ট ।।
ঢাকা: তিন দিন পরেই ঈদুল আজহা। এই ঈদের অন্যতম অনুষঙ্গ পশু কোরবানি। আর তার জন্য প্রয়োজনীয় দা, ছুরি, চাপাতিসহ বিভিন্ন যন্ত্রের চাহিদাও বাড়ে কয়েকগুণ। সেই চাহিদার জোগান দিতেই রাজধানীর কারওয়ান বাজারের কামার পট্টি এখন মুখর টুং টাং শব্দে। এই এক মৌসুমের আয়ই যে তাদের সারাবছরের ভরসা! কিন্তু ঈদের মাত্র তিন দিন বাকি থাকলেও দোকানে নেই ক্রেতাদের ভিড়। সারি সারি ছুরি, চাকু, চাপাতি বিছিয়ে রাখলেও ক্রেতার আনাগোনা না থাকায় এখন শঙ্কার ভাঁজ পড়েছে সারাবছর আগুনের উত্তাপ গায়ে জড়িয়ে লোহা পিটিয়ে যন্ত্রে পরিণত করা মানুষের কপালে।
কামাররা বলছেন, বছরের ১১ মাসে যা আয় হয়, তার চেয়ে বেশি আয় হয় কোরবানি ঈদের মাসে। ফলে এই একমাসের আয়-উপার্জনের ওপরই তাদের সারাবছর টিকে থাকতে হয়। সে হিসেবে ধারদেনা করে কাঁচামাল কিনে প্রস্তুত করেন কোরবানির পশু কাটার যন্ত্রপাতি। প্রতিবছর প্রত্যাশা অনুযায়ী মুনাফাও অর্জিত হয়। কিন্তু অন্যান্য বছরের তুলনায় এবার তার কোনো লক্ষণ দেখছেন না তারা। কাঙ্ক্ষিত ক্রেতা না পেয়ে শঙ্কিত হয়ে পড়েছেন তারা।
কারওয়ান বাজারে কামারপল্লির কামাররা বলছেন, প্রতিবছর কোরবানির ঈদের ১০ থেকে ১৫ দিন আগে থেকেই ক্রেতাদের উপচে পড়া ভিড় থাকে। এবার তার উল্টোটাই ঘটছে। ঈদ চলে এলেও সকাল থেকে রাত অবধি দোকানে যন্ত্রপাতি নিয়ে বসে থাকলেও মিলছে না ক্রেতা। হাতেগোনা দুয়েকজন ক্রেতা এলেও দাম শুনে চলে যাচ্ছেন। তবুও তারা প্রত্যাশায় আছেন, বাকি দিনগুলোতে হয়তো ক্রেতাদের ভিড় জমবে।
কামারদের অভিযোগ, সাম্প্রতিক সময়ে চীন থেকে বিভিন্ন ধরনের যন্ত্রপাতি আমদানির পরিমাণ বেড়েছে, সেগুলোর দামও তুলনামূলকভাবে কম। অন্যদিকে বাড়ছে লোহা ও কয়লাসহ যাবতীয় কাঁচামালের দাম। এতে কামারের দোকানে ভিড় কমছে ক্রেতাদের। সেই সঙ্গে রাজধানীতে পশু জবাই থেকে শুরু করে মাংস খাওয়ার উপযোগী করা পর্যন্ত প্রতিটি পরিবার আগে থেকে কসাই বরাদ্দ করে রাখে। এসব কসাইদের কাছেই প্রয়োজনীয় সব যন্ত্রপাতি থাকে বলে কোরবানি দেওয়া পরিবারগুলো আর এগুলো কিনতে চায় না। যে কারণে চুরি-চাপাতি কম বিক্রির আশঙ্কা করছেন তারা।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, কাওরান বাজারে কামার পট্টিতে প্রায় ৪২টি কামারের দোকান রয়েছে। সেগুলোর প্রতিটিতে পাঁচ শতাধিক ছুরি, চাপাতিসহ প্রায় ১৫ হাজারের বেশি যন্ত্রপাতি রয়েছে। দোকানের পেছনেই আগুনে লোহা গলিয়ে কামাররা সেগুলো তৈরি করে সাজিয়ে রাখেন দোকানে।
সরেজমিনে কাওরান বাজারে গিয়ে দেখা যায়, কামারের দোকানগুলোতে দোকান কর্মচারী ছাড়া ক্রেতাদের ভিড়বাট্টা নেই বললেই চলে। তাই কর্মচারীরা দোকানের সামনে টুল নিয়ে বসে অলস সময় পার করছে। মাঝে মধ্যে দোকানের সামনে দিয়ে কোনো পথচারী হেঁটে গেলে হাঁকডাক দিচ্ছেন কর্মচারীরা। কিন্তু তাতেও লাভ হচ্ছে না।
সুমন নামে এক দোকানদার ছোট-বড় যন্ত্রপাতির পসরা সাজিয়ে অনেক্ষণ ধরে ছুরি, চাপাতি, দা-বটির বাহারি নাম ধরে ক্রেতা আকৃষ্ট করার জন্য হাঁকডাক দিচ্ছেন। কিন্তু কোনো ক্রেতা তার ডাকে সাড়া দিচ্ছে না। তিনি এ প্রতিবেদককে বলেন, ‘দুপুর ৩টা বাজে। অথচ এখনও কোনো বিক্রি নেই দোকানে। দুয়েকজন কাস্টমার দোকানের সামনে এসে দাঁড়ালেও কোনো কিছুর দামই জিজ্ঞেস করেনি। উল্টেপাল্টে দেখে চলে যায়।’
আরেক দোকানের কর্মচারী সজিব সারাবাংলাকে বলেন, ‘ভোলা থেকে ভাইয়ের দোকানে ঈদ পর্যন্ত কাজ করতে এসেছি। সেখানে ডিগ্রিতে পড়ালেখা করি। এসময় বিক্রি অনেক বেশি হয়। তাই গত দুই-তিন বছর ধরে আমি আসি। আমিও কিছু টাকা পাই। কিন্তু এবার সে লক্ষণ দেখতে পাচ্ছি না। প্রত্যাশা অনুযায়ী বিক্রি না হলে ভাই আমাকেই বা টাকা দেবে কিভাবে?’ তবে তার প্রত্যাশা, হয়তো ঈদের দুয়েকদিন আগে বিক্রি বাড়তে পারে।
বিক্রেতরা জানান, এবার পশু জবাইয়ের ছুরি ৭০০ থেকে ১ হাজার ৭০০ টাকা পর্যন্ত বিক্রি হচ্ছে। এছাড়া মাংস কাটার ছুরি ২০০ থেকে ৪০০ টাকা ও চামড়া ছাড়ানোর ছুরি ৫০ থেকে ২৫০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। হাড় কাটার দেশীয় চাপাতি প্রকারভেদে ৬০০ থেকে ৯০০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। দা-বটি বিক্রি হচ্ছে প্রতি কেজি ৬০০ থেকে ৮০০ টাকা দরে। আর চাইনিজ চাপাতি বিক্রি হচ্ছে ১ হাজার ৫০০ থেকে ১ হাজার ৮০০ টাকায়। তবে ইস্পাত ও কয়লার দাম বাড়তি হওয়ার গতবারের তুলনায় এসব যন্ত্রপাতির দাম এক থেকে দেড়শ টাকা বেশি বলে জানান তারা।
জানতে চাইলে কারওয়ান বাজার কামারপট্টি ও পেন্টপট্টি ব্যবসায়ী বহুমুখী সমবায় সমিতির সভাপতি আব্দুল মালেক সারাবাংলাকে বলেন, ‘দেশীয় যন্ত্রপাতির চেয়ে চাইনিজ যন্ত্রপাতির দাম কম হওয়ায় ক্রেতারা সেদিকে ঝুঁকছেন। কিন্তু সেগুলো টেকসই কম। শুধু দাম কমের কারণে ক্রেতারা সেগুলো নিচ্ছেন। যে কারণে এবার কামার পট্টিতে কোরবানির যন্ত্রপাতির ক্রেতা সংকট আছে।’ তবে ঈদের আগে আগে হয়তো ক্রেতা বাড়বে বলে মনে করছেন তিনি।
আব্দুল মালেক আরও বলেন, ‘লোহা ও কয়লার দাম বাড়তি। যে কারণে কামারদের তৈরি জিনিসপত্রের দাম কিছুটা বেড়েছে। তবে ভালো জিনিসের দাম একটু বেশি হলেও সেগুলো কেনা উচিত।’ তাই কাওরান বাজারে এসে খাঁটি লোহা ও ইস্পাতের যন্ত্রপাতি কিনতে ক্রেতাদের প্রতি অনুরোধ জানিয়েছেন তিনি।
সারাবাংলা/এসএইচ/টিআর