‘সাপের গন্ধ’ নিয়ে বড় হওয়া খোকন খেল সাপের ছোবল
২৩ আগস্ট ২০১৮ ০৮:৪৪
।। জাকিয়া আহমেদ, স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট ।।
ঢাকা: বাবা, দাদা, দাদার দাদাসহ পূর্বপুরুষেরা ছিলেন সাপুড়ে। আমারে পেটে নিয়া মা সাপের খেলা দেখাইতেন। বলতে গেলে সাপের গন্ধ পাইছি মায়ের পেট থিইক্যা, জন্মের পর আমাকে পেটে-পিঠে নিয়ে সাপের খেলা দেখাতেন মা। সাপরে কোনও দিন সাপ মনে হয় নাই আমার কাছে। সাপরে মনে হইতো দড়ি-কিন্তু সেই সাপের কামড়েই আমার এই অবস্থা- সাপের বিষে পচনধরা হাতের দিতে তাকিয়ে এ কথা বলেন খোকন মিয়া।
ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের বার্ন অ্যান্ড প্লাস্টিক সার্জারি ইউনিটের একটি ওয়ার্ডে বসে কথা হয় ৪৫ বছর বয়সী সাপুড়ে খোকন মিয়ার সঙ্গে। সামনের দিকে পা ছড়িয়ে বসা খোকন মিয়ার ডান হাত বুকের সঙ্গে চামড়া দিয়ে লাগানো। এলোমেলো শুষ্ক-রুক্ষ্ম চুলের কিছুটা পনিটেইল করে বাধা, বাকিটা উসকো-খুসকো হয়ে ছড়িয়ে আছে। চোখের ভেতরটা কেমন রক্তাভ; খোকন কথা বলেন একটু থেমে থেমে। তাতে গা শিউরে ওঠে তার। আলাপ জমতে থাকে খোকন মিয়ার সঙ্গে। ততক্ষণে ওয়ার্ডে থাকা অন্যান্য রোগী আর তাদের স্বজনেরা খোকন মিয়ার বেডের পাশে ভিড় করেন, তারাও কথা শোনেন। ছোটবেলা থেকে সাপের সঙ্গে সখ্য থাকা খোকন মিয়াকে সাপে কামড় দেওয়ার ঘটনাটি তাদের দুঃখিত করে। কেউবা আবার পাশ থেকে বলেন, ‘দুধ-কলা দিয়ে পুষলেও সাপ তো সাপই, সুযোগ পাইলেই ছোবল মারব।’
নীরব চোখে প্রথমে তাকিয়ে থাকেন খোকন মিয়া। কথা বলতে যেন কিছুটা আপত্তি। তারপর বলেন, ‘এমন কিছু লেইখেন না, যাতে অন্য সাপুড়েদের অসুবিধা হয়। আমি তো একা না-বাংলাদেশে প্রায় আড়াই লাখ সাপুড়ে আছে। তাদের কোনো সমস্যা হোক সেটা আমি চাই না।’
এমন কিছু লেখা হবে না আশ্বস্ত করাতে কথার ঝাঁপি খুলে বসেন তিনি। বলেন, ‘সাপ ছিল আমার বড় বন্ধু, নিজের সঙ্গী। মাছের মতো সাপ ধরছি, কোনওদিন ভয় করিনি। সাপ নিয়ে ঘুমাইছি, পকেটে রাখতাম। ২৭ থেকে ২৮ বছর সাপ নিয়ে খেলা করছি। তারপর সাপ বেচা-কেনার ব্যবসা শুরু করলাম।’
খোকন মিয়া বলেন, ‘সাপ নিয়ে ব্যবসা করি, খেলা দেখাই। দেখে বুঝতে পারি সেটা বিষাক্ত নাকি বিষাক্ত না। সাপের কামড় দেখলেই বুঝতে পারি-কোন ধরনের সাপ ছিল এটা।’ বই বের করে দেখাতে লাগলেন সাপের ছবি। বলতে থাকেন, প্রচুর সাপের নাম জানি। কিন্তু অন্যান্য দেশের তুলনায় বাংলাদেশে সাপের সংখ্যা কম। এখানে কয়েকটা সাপে বিষ আছে, তার মধ্যে আছে-পদ্ম গোখরা, কালি গোখরা সাপ, শঙ্খিনী, কাল দাড়াশ বা কাল সাপ, গুইলগা সাপ-ছোট হলেও এ সাপ খুব বিষাক্ত।
খোকন মিয়া জানালেন, এবার নিয়ে দ্বিতীয়বার সাপের ছোবল খেলেন। তবে প্রথমবার এতো ভোগান্তি পোহাতে হয়নি তাকে। তবে এবারের ভোগান্তির পেছনে একটা কার্যকারণ রয়েছে-বিশ্বাস করেন তিনি। সেটা কী জানতে চাইতেই বলেন, নিজের ছেলেদের সাপের ব্যবসায় আনবেন না-এমন আশা করাতেই সাপবন্ধু তার ওপর নাখোশ হওয়াতে এবারে তার এমন ভোগান্তি।
‘আমার মনে একটা আশা ছিল’-বলে চুপ হয়ে যান খোকন মিয়া। অনেক সময় নিয়ে পরে বলেন-নিজে যা করছি করছি, কিন্তু পরিবারের আর কাউকে এ পেশায় আনব না। চারটা মেয়ের পর দুইটা জমজ ছেলের বাবা হই। কোনও মেয়েকে এই খেলা শিখাইনি, ছেলেরা মাদ্রাসায় পড়ে। কিন্তু এখন এই দুই ছেলে দুইটার জন্য খুব কষ্ট হয় বলে কেঁদে দেন খোকন মিয়া। এর আগে চার বছর আগে সাপের খেলা, ব্যবসা বাদ দিয়ে দিছিলাম, নিজেও করব না-ছেলেদেরও শেখাব না।
কেন এই পেশায় ছেলেদের আনতে চান না জানতে চাইলে খোকন মিয়া বলেন, ‘এইগুলার মধ্যে কী আছে সেইগুলা সব আমি জানি। বিষাক্ত সাপের কাজ ছেলেরা করুক এটা আমি চাই নাই। চাইছিলাম, ওরা লেখাপড়া শিখে ‘আপনাদের মতো মানুষ হবে। বিষাক্ত সাপ কামড় দিলে মানুষ বাঁচে না। নিজে কষ্ট করতাম।’ তাই বোধ হয় সাপ এই প্রতিশোধটা নিলো। বাঁচার কোনো আশাই ছিল না, আল্লাহ আমারে বাঁচিয়ে রাখছে, অনেক টাকা ঋণ হয়ে গেছে। এখন তো আর এই ব্যবসা না করলে আমি ঋণের টাকা পরিশোধ করতে পারব না।
খোকন মিয়ার পূর্ব পুরুষের বাড়ি বিক্রমপুরে। তার জন্ম নৌকাতে। কিন্তু স্বাধীনতার পর বেদেরা নৌকা ছেড়ে সমতলে বসত শুরু করে জানিয়ে তিনি বলেন, ‘আমার জন্ম নৌকায় কিন্তু কর্ম মাটিতে। বিক্রমপুর ছেড়ে খোকন মিয়া গাজীপুরে বাড়ি করেন। পাঁচ মেয়ের মধ্যে চারজনকে বিয়ে দিয়েছেন, জমজ দুটো ছেলে মাদ্রাসায় লেখাপড়া করছে।’
কীভাবে সাপ ছোবল দিল জানতে চাইলে খোকন মিয়া বলেন, ‘জয়দেবপুরের রেলওয়ে স্টেশনে সাপের খেলা দেখাই, সাপ কেনাবেচার ব্যবসা করি। সেদিন ছিল ৭ রমজান। ১০টা সাপ আসে রাজশাহী থেকে। ঐ সাপগুলো কিনে রাখি। সাপগুলো যে বাক্স থেকে নিয়ে আসছে সে বাক্স থেকে আমার বাক্সে সাপগুলো যখন নিচ্ছিলাম তখন একটা গোখরা ডান হাতের মাঝের আঙুল কামড় দেয়।’
নিজের অভিজ্ঞতায় বুঝতে পারি-এটি বিষাক্ত, সঙ্গে সঙ্গে নিজের লোকদের বলি বান (রশি দিয়ে শক্ত করে বেঁধে দেওয়া) দিতে। রাত তখন সাড়ে আটটার মতো হবে। বান হাতে নিয়েই ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চলে আসি। সেখানে বলি- আমাকে গোখড়া সাপে কামড় দিছে, ইনজেকশন দেন। এরপরও সাপে কাটা ইনজেকশন হাসপাতাল থেকে বিনামূল্যে দেওয়ার কথা থাকলেও ১১ হাজার টাকা দিয়ে ১০টি ইনজেকশন কিনে আনি আমি। প্রায় ১৫ মিনিটের মতো সময় চলে যায়- আমার কথা ততক্ষণে এলোমেলো, চোখে ঝাপসা দেখছিলাম, জ্ঞান হারাতে থাকলাম। কেবল শুনলাম, একে আইসিইউতে নাও, আমাকে টাইনা যে ট্রলিতে করে নিতাছে এই শব্দটুকু পাইছিলাম আর কিছু মনে নেই। যখন জ্ঞান ফিরলো-বাড়িওয়ালিকে ( স্ত্রী) জিজ্ঞেস করলাম-কতক্ষণ ঘুমালাম? সে বলল-আজ চারদিন।
এর একদিন পর ওয়ার্ডে দেওয়া হয়। হাতে একটা ফোসকার মতো হয়ে গেল যেমনটা হয় আগুনে পুড়ে গেলে।এরপর আমাকে দেখতে আসেন রোবেন (ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের মেডিসিন বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ডা. রোবেদ আমিন) স্যার। তিনি আমাকে বলেন, ‘এই ঠোসা ধীরে ধীরে বড় হবে। ঘা হয়ে যাবে, হাতটা কেটে ফেলতে হতে পারে। আমি চাই হাতটা রাখতে, তাই কয়েকদিন চিকিৎসা করতে হবে। কিন্তু অপারেশনের কথা বলা হলে স্যারকে না বলেই চলে যাই।’ কিন্তু হাতের অবস্থা খারাপ হওয়াতে আবার আসতে হয় হাসপাতালে।
খোকন মিয়া প্রসঙ্গে জানতে চাইলে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের মেডিসিন বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক মো. রোবেদ আমিন বলেন, ‘খোকন মিয়া সে সময় বাড়ি চলে যান। কিন্তু তার হাতের অবস্থা খুব খারাপ হয়ে যায়। ডান হাতের কবজি থেকে কনুই পর্যন্ত পানি-ফোসকা পড়ে এবং সেগুলো ফেটে গিয়ে হাতে পচন শুরু করে। খোকনের হাতের অবস্থা এতোটাই খারা হয়েছিল যে, তার হাত কেটে ফেলতে হতে পারে-এমনটাও মনে হয়েছিল আমাদের। তবে তার হাতে বোধ রয়েছে, আঙুল নাড়াতে পারেন। এতে করেই মনে হচ্ছে, হাতটা হয়তো কেটে ফেলতে হবে না। এরপরই তাকে বার্ন, প্লাস্টিক ও রিকন্সট্রাকটিভ সার্জারি বিভাগে স্থানান্তর করা হয়। খোকন মিয়া বর্তমানে ভর্তি রয়েছেন বার্ন অ্যান্ড প্লাস্টিক সার্জারি বিভাগের অধ্যাপক ডা. সাজ্জাদ খোন্দকারের অধীনে।
অধ্যাপক ডা. সাজ্জাদ খোন্দকার সারাবাংলাকে বলেন, ‘খোকন মিয়ার হাতে এখন স্কিন গ্রাফটিং ( চামড়া অন্য জায়গা থেকে কেটে লাগানো) হয়েছে। তার হাতে এখন বিষক্রিয়া নেই। প্রথমবার অস্ত্রোপচার হলেও সেটি সফল না হওয়াতে কয়েকদিন আগে পুনরায় অস্ত্রোপচার হয়েছে। এবার পেট থেকে মাংস নিয়ে হাতে লাগানো হয়েছে। ২১ দিন পর আবার অস্ত্রোপচার হবে, হাত পেট থেকে ছুটিয়ে আনা হবে ততোদিনে হাতের চামড়া পুরোপুরি লেগে যাবে। তবে তার চিকিৎসায় সময় লাগবে’ বলেন অধ্যাপক ডা. সাজ্জাদ খোন্দকার।
খোকন মিয়া বলেন, গত ২৮ জুলাই থেকে এখানে আছি। আমি কত মানুষের চিকিৎসা করছি গাছ-গাছলা দিয়ে। মানুষ তাতে সুস্থ হত?- প্রশ্ন করলে খোকন মিয়া তার বেডে থাকা কালো একটি ব্যাগ থেকে বের করলেন চিকিৎসা সংক্রান্ত বেশকিছু সনদ। বললেন, ভারত সরকার থেকে কতো সার্টিফিকেট দিছে, এরমধ্যে রয়েছে ত্রিপুরা থেকে পাওয়া খানদানি আয়ুর্বেদিক শাহি দাওয়াখানার একটি সনদ।
তবে কথা বলতে বলতে চোখে পানি আসে খোকন মিয়ার। বলেন, ‘আমি সীমিত আয়ের মানুষ। কতো মানুষরে এই হাসপাতালে নিয়া আসছি। রাতে এসে সকালেই সুস্থ মানুষটাকে নিয়ে চলে গেছি। কিন্তু আমার নিজের যে এই অবস্থা হবে তা কোনোদিন মাথায় আসেনি।’
সারাবাংলা/জেএ/একে