চামড়া কেনায় আগ্রহ কম সাভারের ট্যানারিগুলোর
২৬ আগস্ট ২০১৮ ১১:০৮
।। গোলাম সামদানী, স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট।।
সাভার থেকে ফিরে: আন্তর্জাতিক বাজারে চামড়ার চাহিদা কমে যাওয়ায় সাভারের ট্যানারি মালিকেরা আগের মতো চামড়া কিনতে পারছেন না। ফলে সরকার চামড়ার দাম নির্ধারণ করে দিলেও কোথাও কোথাও সেই দামে চামড়া কেনাবেচা হচ্ছে না। চামড়া মালিকরা বলছেন, আন্তর্জাতিক বাজারে চামড়ার চাহিদা কমে যাওয়ার পাশাপাশি অর্থ সংকপট থাকায় ট্যানারি মালিকরা এ বছর বেশি চামড়া কিনতে আগ্রহী না।
এ ব্যাপারে বাংলাদেশ ট্যানার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিটিএ) সভাপতি শাহীন আহমেদ সারাবাংলাকে বলেন, এখনও ট্যানারিগুলোতে কোরবানির ঈদ পরবর্তী ব্যস্ততা শুরু হয়নি। আগামী সপ্তাহ থেকে আমাদের প্রতিনিধিরা নাটোরের লালপুর, টাঙ্গাইলের পাকুটিয়া, যশোরের বাজারহাট, চট্রগ্রামের আতুরহাট, বগুড়ার পলাশবাড়িসহ দেশের বিভিন্ন জেলায় গিয়ে চামড়া সংগ্রহ করবেন। চামড়া কেনার ক্ষেত্রে আমরা সরকারের বেঁধে দেওয়া দামেই কিনব।
তিনি বলেন, ‘চামড়ার চাহিদা আন্তর্জাতিক বাজারে কমে যাওয়ায় অনেক ট্যানারি আগের মতো চামড়া কিনতে পারছেন না। সে সঙ্গে রয়েছে অর্থের সংকট। সব মিলিয়ে চামড়া দাম কমে গেছে।’
এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘এবার মৌসুমি ব্যবসায়ীরা চামড়া কিনে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন এটা সঠিক। আবার অনেকক্ষেত্রে না বুঝে বেশি দামেও চামড়া কেনার কারণেও অনেক মৌসুমী ব্যবসায়ীরা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন। আর সব ক্ষেত্রে আমাদের নিয়ন্ত্রণ করা কঠিন।’
শনিবার (২৫ আগস্ট) সাভারের ট্যানারি পল্লীতে সরেজমিনে দেখা যায়, ট্যানারিগুলোতে কোরবানির ঈদ পরবর্তী চামড়া প্রক্রিয়াকরণ এখনও পুরোমাত্রায় শুরু হয়নি। ঈদের চারদিন পার হলেও ট্যানারিগুলোতে চোখে পড়ার মতো কোনো ব্যস্ততা নেই। শনিবার দিনভর
চামড়া শিল্প নগরীতে ঘুরে দেখা গেছে বেশ কয়েকটি কারখানা খুলেছে, সেখানে গুটি কয়েকজন শ্রমিক কাজ করছেন। বেশিরভাগ শ্রমিক এখনও ঈদের ছুটি শেষে কাজে যোগ দেয়নি।
ফলে চামড়া শিল্প নগরীতে এক ধরনের সুনসান নিরবতা বিরাজ করছে। বেশ কয়েকজন ট্যানারির মালিক, কর্মকর্তা ও শ্রমিকের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, আন্তর্জাতিক বাজারে চামড়ার চাহিদা কম থাকায় এবার চামড়া কেনার প্রতি ট্যানারিগুলোর আগ্রহ অনেক কম।
সরেজমিনে দেখা গেছে, রাস্তাঘাটের অবস্থা খারাপ থাকায় ঠিকমত গাড়ি চলতে পারছে না। ট্যানারিগুলোর কোনো ড্রেনেজ ব্যবস্থা নেই। আবার কোনো কারখানার সামনে ড্রেন থাকলেও সেগুলো বদ্ধ ড্রেন। ফলে তা উপচে পড়ে পানি রাস্তায় চলে আসছে। আবার কোনো কোনো কারখানার চামড়া প্রক্রিয়াজাতকরণের পানি কারখানা গেট দিয়ে বের হয়ে ড্রেনে পড়ছে। পরে সেই পানি ড্রেন উপচে রাস্তায় চলে আসছে। বৃষ্টির সময় রাস্তায় হাঁটু পানি জমে যায় বলেও স্থানীয়রা জানান। আবার রাস্তার ম্যানহোলগুলোর মুখ খোলা থাকায় পানি উপচে গিয়ে পড়ছে পাশের ধলেশ্বরী নদীতে। ফলে বুড়িগঙ্গার মতো ধলেশ্বরী নদীর পানিও দূষিত হচ্ছে। এছাড়া চামড়া শিল্প নগরীতে ডাম্পিং ইয়ার্ড না থাকায় কারখানার বর্জ্যগুলো সেখানে পাঁচ একর জমিতে তৈরি করা একটি পুকুরে ফেলা হচ্ছে। এতে এলাকার পরিবেশ দূষিত হচ্ছে। এ সব কারণে সাভারের চামড়া শিল্প নগরীতে বিদেশি বায়াররা আসতে চাইছেন না বলে জানিয়েছেন বেশ কয়েকজন কারখানার মালিক।
তাদের মতে, ট্যানারি মালিকরা পর্যাপ্ত অর্ডার আনতে না পারায় চামড়া রফতানির পরিমাণ আগের চেয়ে কমে গেছে। আর এ কারণে এবার বিগত কয়েক বছরের তুলনায় চামড়া রফতানির পরিমাণ আগের চেয়ে কমে গেছে। কোনো কোনো এলাকায় সরকার নির্ধারিত দামের চেয়েও কম দামে কোরবানির চামড়া বিক্রি করতে বাধ্য হয়েছেন সাধারণ মানুষ।
এ ব্যাপারে এপেক্স ট্যানারির নির্বাহী পরিচালক এমএ মাজেদ শনিবার দুপুরে তার কার্যালয়ে সারাবাংলাকে বলেন, সাভারে চামড়া শিল্প নগরী স্থান্তান্তরের পরেও আমাদের অনেক সমস্যা রয়ে গেছে। এখানকার পরিবেশ মানসম্মত না হওয়ায় বিদেশি বায়াররা আসতে চাচ্ছেন না। ফলে অর্ডার কমে গেছে এবং চামড়ার দাম পড়ে গেছে। এছাড়াও আন্তর্জাতিক বাজারে চামড়ার বাজার মন্দাতো রয়েছে। সবকিছু মিলিয়ে চমড়ার দাম কম।’
এদিকে শনিবার দিনভর সাভাবের ট্যানারিগুলোতে ঘুরে সাধারণ মানুষ, শ্রমিক, মালিক ও কারখানার কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে, চামড়ার দাম কমে যাওয়ার কয়েকটি কারণ জানা গেছে। সেগুলোর মধ্যে রয়েছে প্রথমত আন্তর্জাতিক বাজারে চামড়ার চাহিদা কমে যাওয়ায় গত বছরের অনেক চামড়া ট্যানারিগুলোতে পড়ে আছে। তাই ট্যানারি মালিকরা পুরনো চামড়া রফতানি না হওয়া পর্যন্ত চামড়া কিনতে চাইছেন না। এতে করে চামড়ার দাম কমে গেছে।
দ্বিতীয়ত, সাভারেব চামড়া শিল্প নগরীর রাস্তাঘাট, ড্রেনেজ ব্যবস্থা ও ডাম্পিং ইয়ার্ড নিমার্ণ করা হয়নি। আবার কেন্দ্রীয় বর্জ্য পরিশোধনাগার (সিইটিপি) নিমার্ণ করা হলেও রাসায়নিক ক্রোমিয়াম পুনরুদ্ধার বা রিকভারি ইউনিট চালু করা হয়নি। সিইটিপি‘র পরিশোধন ক্ষমতা ২৫ হাজার ঘনমিটার হলেও বর্জ্য উৎপাদন হচ্ছে ২৮ হাজার ঘনমিটার। ফলে রাতের আধারে অতিরিক্ত বর্জ্য পরিশোধন না করেই পানিতে ফেলে দেওয়ার অভিযোগ রয়েছে। এসব কারণে বিদেশি বায়াররা চামড়া শিল্প নগরী থেকে মুখ ফিরিয়ে নেওয়ায় অর্ডার পাওয়া যাচ্ছে না। ফলে চামড়ার দাম কমে গেছে। এছাড়াও চীন ও আমেরিকায় বাণিজ্য বিরোধের প্রভার বাংলাদেশের চামড়া খাতে নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে।
সাভারের হরিণধরায় ধলেশ্বরী নদীর তীরে প্রায় ২০০ একক জমির ওপর গড়ে উঠেছে নতুন ট্যানারি পল্লী। ফলে হাজারীবাগের অধিকাংশ ট্যানারি এখন সাভারে কার্যক্রম চালাচ্ছে। ১৫৫টি ট্যানারির মধ্যে ১১৫টি ট্যানারি সেখানে স্থানান্তরিত হয় উৎপাদন প্রক্রিয়া শুরু করেছে। এর মধ্যে ৫৬টি কারখানা পুরোদমে উৎপাদন প্রক্রিয়া শুরু করেছে।
সারাবাংলা/জিএস/একে