‘‘আমার বাবু তো কিচ্ছু খায় না!”
৩০ ডিসেম্বর ২০১৭ ১৪:৪১
ডাঃ লুনা পারভীন
আমার বাবু খায় না!
করে শুধু চকলেট আর
চিপস খাওয়ার বায়না!
আমাদের মায়েদের নিত্য অভিযোগ, ‘আমার বাচ্চা খায় না’। ডাক্তারের কাছে একটাই আবদার, এমন কোন ওষুধ দিন যেন বাচ্চা খেয়ে দু’দিনেই মোটা তাজা হয়ে যায়! আর এই সুযোগটা নেয় কিছু অসৎ ব্যবসায়ী আর আশেপাশের অতি বুদ্ধিমান কিছু মানুষ। নানান চটকদার বিকল্প খাদ্য ও পুষ্টিকর পানীয়ের ব্যবসা ফেঁদে বিভ্রান্ত করে মায়েদের আর স্বাভাবিক খাবার ফেলে মায়েরা ছোটেন সেই মরীচিকারূপী ভুল পরামর্শের পিছে।
কেন বাবু খায় না?
সমস্যা সমাধানের আগে জানতে হবে আসলে সমস্যার মূল কারন কি। আমাদের মায়েরা যে কথাগুলো অহরহ এসে বলেন শিশুরোগ বিশেষজ্ঞের কাছে, সেগুলো দেখা যাক কীভাবে আমরা উত্তর দেই।
মায়ের সমস্যা- বাবু খালি কাঁদে, বারবার খেতে চায় কারন বুকের দুধ ভালো পায় না!
চিকিৎসকের উত্তর- একটা ছোট বাবুর ভাষাই হচ্ছে কান্না। সে যে কোন কারনেই কাঁদতে পারে, সব কান্না খাওয়ার জন্য নয়। একটা বাচ্চা দিনে ( ২৪ ঘন্টা) ৪-৬ বার প্রশ্রাব করলে বুঝতে হবে সে যথেষ্ট ভালো বুকের দুধ পাচ্ছে।
মায়ের সমস্যা- বাবু বুকের দুধ টানতে চায় না!
চিকিৎসকের উত্তর – এক্ষেত্রে বাচ্চা প্রিম্যাচুউর বা অপরিণত না হলে , শারীরিক কোন ত্রুটি না থাকলে এবং মায়ের নিপলে কোন সমস্যা না থাকলে, বুকের দুধ না টানতে চাওয়ার একটা কারন হতে পারে, বাচ্চাকে ঘন ঘন খাওয়াচ্ছেন। একটা বাচ্চার বয়স ভেদে পেট খালি হতে সময় লাগে ২-৩ ঘন্টা। এর আগে খাওয়াতে চাইলে, ভরাপেটে বাবু নাই খেতে চাইতে পারে। অনেক মা শুরুতেই ফিডারে বিকল্প দুধ খাওয়ান। যার ফলে বাবু কষ্ট করে আর টেনে খেতে চায় না। আরাম করে ফিডারে মুখ লাগালেই দুধ চলে আসে, সে কষ্ট করে নিপল টেনে খাবে কেন?
মায়ের সমস্যা- খিচুরী খেতে চায় না, খেলে পায়খানা পাতলা হয়!
চিকিৎসকের উত্তর – বুকের দুধ একটি স্বাদহীন খাবার। ৬ মাস বয়সের শুরুতেই আপনি যদি চালের সাথে তিন রকম ডাল,চার রকম সবজি দিয়ে দেন, এরসাথে মশলা দেন বাচ্চা খাবে কেন? শুরুতে শুধু চাল,ডাল, তেল ও লবন দিয়ে নরম করে খিচুরী রান্না করে দিতে হবে। এর এক চামচ খেতে যদি বাচ্চার একমাসও সময় লাগে, সে ধৈর্য মায়ের থাকতে হবে। পায়খানা কেমন হচ্ছে তা নিয়ে চিন্তা করার দরকার নেই, যতক্ষন জ্বর, বমি বা পানিশূন্যতা না হচ্ছে।
মায়ের সমস্যা- পাশের বাসার বাবু অমুক খাবার খাওয়ায় স্বাস্থ্য কত ভালো!
চিকিৎসকের উত্তর – বাচ্চার স্বাস্থ্য অনেকসময় নির্ভর করে বংশগত শারীরিক গঠনের উপর। বাবা মা অথবা পরিবারের সদস্যদের শরীরের গঠন যেমন ছিল ছোটবেলায়, বাচ্চারও তেমন হওয়ার সম্ভাবনাই বেশী থাকে। এর সাথে খাবারের কোন সম্পর্ক নাই। কাজেই অন্যের বাচ্চার সাথে তুলনা করা যাবে না।
মায়ের সমস্যা- বাবু সারাদিনে একচামচ খাবারও মুখে নেয় না!
চিকিৎসকের উত্তর- টাইমিং বা সময়ের একটা সম্পর্ক আছে খাওয়ার সাথে। আপনি যেমন নিয়ম করে ৩-৫ বেলা খাবার খান, বাচ্চাকেও তেমনি নির্দিষ্ট সময়ে খাওয়াতে হবে এবং আধাঘন্টার বেশী সময় নিয়ে খাওয়ানো যাবে না। এতে বাচ্চা ক্ষুধা কি বুঝতে শিখে না, খাবারের প্রতি আগ্রহ নষ্ট হয়।
মায়ের সমস্যা- বাবু শক্ত খাবার গিলতে চায় না, থু করে ফেলে দেয়!
চিকিৎসকের উত্তর – এর কারনও ভুলভাবে খাবার খাওয়ানো হতে পারে। কষ্ট করে পাটায় বেটে, ব্লেন্ডারে ঘুটে পাতলা করে খাওয়ানোর কোন দরকার নেই বাচ্চাকে। দাঁত ওঠার আগ পর্যন্ত বাচ্চার মাড়ী ও তালু যথেষ্ট শক্ত থাকে, শক্ত খাবার খাওয়ার জন্য যা উপযুক্ত।
মায়ের সমস্যা-খাবার মুখে নিয়ে ঘন্টার পর ঘন্টা বসে থাকে!
চিকিৎসকের উত্তর – বাচ্চাকে খাওয়ানোর উপর পরিবেশেরও একটা প্রভাব থাকে। কখনও বাচ্চাকে শোয়া অবস্থায় চেপে ধরে খাওয়াবেন না বা সারাক্ষণ খাওয়ানো নিয়ে বিরক্ত করবেন না। সবচেয়ে ভালো হচ্ছে, বাসার সবাই একসাথে বসে খাওয়ার সময় বাচ্চাকে সাথে নিয়ে বসা। সবাইকে খেতে দেখলে বাচ্চাও খেতে চাইবে। টিভি দেখে খাওয়ানোটাও বাজে অভ্যাস, খাবারের প্রতি মনোযোগ নষ্ট হয়। নিজের হাতে খেতে দিলে আরো ভালো।
কাজেই, শিশুকে সঠিক সময়ে সঠিক পদ্ধতিতে সঠিক খাবার খাওয়ান। একটি সুস্থ, হাসিখুশী বাচ্চা আমাদের সকলেরই কাম্য। অযথা বাচ্চাকে মোটা বানানোর চেষ্টা করে ওর সুন্দর শৈশবকে দুঃস্বপ্নে রূপান্তরিত করবেন না।
প্রতিজ্ঞা হোক, আমার বাচ্চা যেন বাড়ে বুদ্ধি ও মননে!
শুভ কামনা!
লেখক- আবাসিক মেডিকেল অফিসার, ঢাকা শিশু হাসপাতাল।
অলংকরণ- আবু হাসান
সারাবাংলা/আরএফ