র্যাব পরিচয়ে অপহরণের অভিযোগ, টাকা দিয়েও ফেরত পাননি ছেলেকে
২৮ আগস্ট ২০১৮ ১৯:১৮ | আপডেট: ২৯ আগস্ট ২০১৮ ০৯:০৪
।। সিনিয়র করেসপন্ডেন্ট ।।
ঢাকা: গত ১০ জুন রাত আনুমানিক পৌনে ১১টার দিকে মিরপুর মডেল থানার ২ নম্বর সেকশনের ৩ নম্বর রোডের চ ব্লকের ১৯৩ এর ১ নং বাসার সামনে থেকে মোহন মিয়া নামে এক লোককে র্যাব পরিচয়ে তুলে নিয়ে যায়।
ওই দিন রাতেই ছেলে নিখোঁজের ঘটনায় বাবা জমশের আলী মিরপুর মডেল থানায় একটি সাধারণ ডায়েরি (জিডি) করেন। এরপর ঘটনার দুই মাস পার হলেও হদিস মেলেনি ছেলের।
জমশের আলীর অভিযোগ, হাফিজুর রহমান নামে র্যাবের একজন সদস্য বাসায় বলেছিলেন যে, তার ছেলে র্যাব-৪ এর কাছে আছে। ওই এলাকার ফর্মা বাবু নামে এক লোকের সঙ্গে যোগাযোগ করতে বলেন ওই র্যাব সদস্য।
তার কথা মতো ফর্মা বাবুর সঙ্গে যোগাযোগ করলে ফর্মা বাবু বলেন, তিন লাখ টাকা দিতে হবে। টাকা দিলে আপনার ছেলেকে ওরা ছেড়ে দেবেন। পরে দর কষাকষি করে দুই লাখ টাকা ঠিক হয়। এরপর একদিন ৮ জন লোকের উপস্থিতিতে বাবুকে ২ লাখ টাকা নগদ বুঝিয়ে দেয়। ১৫ থেকে ২০ দিনেও ছেলেকে না পেলে তার কাছে টাকা ফেরত চাওয়া হয়। এরপর তিনি নানা টালবাহানা শুরু করেন বলে জানান জমশের আলী।
মঙ্গলবার (২৮ আগস্ট) সকাল ১১টার দিকে বাংলাদেশ ক্রাইম রিপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের (ক্র্যাবে) কার্যালয়ে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে অপহরণ হওয়া মজনু মিয়ার বাবা জমশের আলী সাংবাদিকদের কাছে এসব অভিযোগ করেন। এ সময় মোহন মিয়ার মা নাছিমা বেগম, স্ত্রী শাহানাজ আক্তার, ছেলে সাজিদ হোসেন শান্ত (১১) ও মেয়ে শান্তা আক্তার পুতুল (৯) উপস্থিত ছিলেন।
জমশের আলী বলেন, ১০ জুন ছেলেকে নিয়ে যাওয়ার সময় আমরা সবাই উপস্থিত ছিলাম। কয়েকজন এসে মোহনকে নিয়ে যাওয়ার সময় জানতে চাই, ওর অপরাধ কী, আর আপনারা কারা? তখন তারা বলেন, আমরা র্যাবের লোক। আবার কেউ বলেন, আমরা ডিবির লোক। ওর বিরুদ্ধে অভিযোগ আছে তাই নিয়ে যাচ্ছি।
এরপর তারা একটি মোটরসাইকেলে বসিয়ে নিয়ে যায়। বাকি লোকজন একটা সাদা মাইক্রোবাসে করে চলে যায়। রাতে থানায় গিয়ে জিডি করি। এ ঘটনার কযেকদিন পর ১৭ জুন (ঈদের পরদিন) হাফিজুর রহমান নামে এক ব্যক্তি এসে ফোন করে ডেকে নেন আমাকে। তিনি নিজেকে র্যাবের সদস্য বলে পরিচয় দেন। তখন তিনি বলেছিলেন, আপনার ছেলে র্যাব-৪ আছে। চিন্তা করবেন না। একটা চিঠি ও ছবি দেখিয়ে বলেন, দেখেন তো আপনার ছেলের লেখা কি না? তখন লেখা ও ছবি দেখে নিশ্চিত হই, লেখাগুলো আমার ছেলের।
জমশের আলী বলেন, এরপর দুই তিন দিন এসেছিলেন আমার কাছে। একদিন লুঙ্গি ও গামছা নিয়ে গেছেন। শেষের দিন বলেন, আপনার ছেলে র্যাবের কাছে নেই। আপনি ফর্মা বাবুর সাথে যোগাযোগ করেন, পেয়ে যাবেন। তখন আমি দিশেহারা হয়ে যাই। অবশেষে স্থানীয় ফর্মা বাবুর সঙ্গে যোগাযোগ করলে দুই লাখ টাকা চুক্তি হয় ছেলেকে বের করে দেওয়ার জন্য।
দীর্ঘদিনেও ছেলেকে না পেলে বাবুর কাছে টাকা ফেরত চাই। তখন তিনি নিজ দোকান বন্ধ করে বেশ কয়েকদিন লাপাত্তা থাকেন। এরপর একদিন আমার বাসায় পোশাক পরিহিত ও সাদা পোশাকে র্যাবের লোকজন রেড দিতে আসে। আমি বাসায় ছিলাম না। র্যাবের লোকজন নাকি শুধু আমাকেই খোঁজ করেন। এখন ফর্মা বাবু দিব্যি দোকান খুলে ব্যবসা করছেন। টাকা চাইলে বলেন, টাকাতো র্যাবকে দিয়েছি। তারা ফেরত দিচ্ছে না। তখন ছেলেকে ফেরত চাইলে বলেন, আমি কিভাবে ছেলেকে দেবো। যারা নিয়ে গেছে তাদের কাছে গিয়ে ছেলেকে ফেরত চান।
জমশের আলী অনেক কষ্ট করে গ্রামীণ ফোন অফিস থেকে এক লোকের মাধ্যমে হাফিজুর রহমানের বিস্তারিত তথ্য সংগ্রহ করেছেন। তার গ্রামীন মোবাইল নম্বর রেজিস্ট্রেশনের সময় যে ছবি ব্যবহার করা হয়েছে তাতে র্যাবের পোশাক পরিহিত ছবি রয়েছে। সেই অনুযায়ী তার বাড়ি খুলনার খালিশপুরে। তার পিতার নাম এম ডি মাইন আলী মন্ডল, মাতা মৃত- মোছা. ছকিনা বেগম। তার জন্ম তারিখ ৭ সেপ্টেম্বর ১৯৭৫। তার মোবাইল নম্বর ০১৭৯১১৬০৮৬৬।
জমশের আলী আরও বলেন, স্থানীয় আজিজুল হক শ্যামল নামে এক ব্যক্তির সঙ্গে আমার পুর্বের শত্রুতা রয়েছে। আমার সোয়া দুই কাঠা জমির ওপর টিনশেড ঘর রয়েছে। আজিজুল এর আগে লোকজন নিয়ে দাবি করেছিল ওই জমি তার। আসলে তিনি জবরদখল করতে এসেছিলেন। এখন তিনি না পেয়ে আমার ছেলেকে অপহরণ করিয়েছে প্রশাসনের কাউকে দিয়ে। অবিলম্বে আমার ছেলেকে জীবিত ফেরত চাই। একদিকে একমাত্র ছেলেকে হারিয়ে পরিবারের সবাই পাগল প্রায় অন্যদিকে নানাভাবে হয়রানি করা হচ্ছে।
সংবাদ সম্মেলনে মোহন মিয়ার ১১ বছরের ছেলে সাজিত হোসেন শান্ত বলেন, আমার বাবাকে ফেরত চাই। বাবাকে ছাড়া আমরা কি করবো। কেমনে বেঁচে থাকবো। পড়াশুনাও মনে হয় বন্ধ হয়ে যাবে।
মোহন মিয়ার ৯ বছরের মেয়ে পুতুলেরও দাবি, বাবাকে ফিরিয়ে দেওয়া হোক। র্যাব আঙ্কেলদের বলবো-আপনারা আমার বাবাকে ফেরত দিন। পুলিশকেও বলবো-আপনারাও আমার বাবাকে খুঁজে বের করেন।
মোহন মিয়ার স্ত্রী শাহানাজ বলেন, দুইটা অবুঝ শিশুকে নিয়ে কিভাবে কি করবো বুঝে উঠতে পারছি না। দুই মাস পার হয়ে গেলেও মোহনের কোনো খোঁজ মিলছে না। আমরা হতাশ হয়ে পড়ছি। সব জায়গাতে গিয়েছি। কোথাও তার খোঁজ মিলছে না। এ সময় পরিবারের সবাই কান্নায় ভেঙ্গে পড়েন।
মোহনের বাবা জমশের আলীর সরবরাহ করা চিঠিতে যা লেখা আছে-শাহানাজ (তার স্ত্রী) আমারে র্যাব ধরে আনার পর আমারে অনেক মারধর করছে। আমি জ্ঞান হারিয়ে ফেলেছি। আমারে কাপড় দিয়ে চোখ বেঁধে অন্ধকার রুমে রেখেছে। আমি বলি আমার কাছে কিছুই নাই। আমারে বাইরের মেডিকেলে নিয়েছিল। আমি ফোন করলে তোমাদের ফোন বন্ধ পাই। আমারে মারে আর কয় দুই লাখ টাকা দিলে মারা বন্ধ করবে। আমি বলি আমার কাছে কোনো টাকা নেই। এরপর প্লাস দিয়ে নখ চিপে ধরে। নকে সুই ফুটায় দেয়। আমার পায়ের তলা বাইড়াইয়া কিছু রাখে নাই। ফরিদ কাকারে দিয়ে বাবারে বইলা দেখো কিছু করা যায় কি না। ১০ দিন হইয়া গেলো। আমার কাছে কিছু পায়নি। আমিও কিছুই বলি নাই। তাহলে আমারে কেনো র্যাব আটক করে রাখছে।তোমরা কি ঘরে বসে আছো? কোনো মানুষকে ধরে আবার ছাড়ে, আমি ১০ দিন আটকা আছি কেন? আমার পুতুল (মেয়ে) মা কেমন আছে? যে ভাই চিঠিটা নিয়ে যাবে সেই ভাইকে ৫০০ টাকা দিয়ে দিও। এই ভাই আমার অনেক উপকার করেছে। এই প্রথম র্যাব অফিস থেকে বাইরে কোনো চিঠি বা মোবাইল ফোন থেকে কল করা গেছে। আমাকে তোমরা বের করো। আমি কি সারা বছর র্যাব অফিসে আটকা থাকবো। (তার লেখা চিঠির ভাষা পড়ে বোঝা খুব কষ্টকর, তার লেখাতে এই সারমর্মই উঠে এসেছে) এ ছাড়া তিনি ছেলেকে নিয়ে যাওয়ার সিসিটিভি থেকে সংগ্রহ করা ফুটেজও সরবরাহ করেন।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে র্যাব-৪ এর সিও (কমান্ডিং অফিসার) অ্যাডিশনাল ডিআইজি চৌধুরী মঞ্জুরুল কবির সারাবাংলাকে বলেন, আমার জানা মতে হাফিজুর রহমান নামে র্যাব-৪ এ কেউ নাই। এ সংক্রান্ত কোনো অভিযোগ পেয়েছেন কি না জানতে চাইলে তিনি বলেন, এরকম কোনো অভিযোগ কেউ দেয়নি।
অন্যদিকে ফর্মা বাবুর বিরুদ্ধে পুলিশ এখনো কোনো অ্যাকশন নেন নাই। এ ব্যাপারে জানতে চাইলে মিরপুর মডেল থানার পুলিশ পরিদর্শক (তদন্ত) ওয়াহেদুজ্জামান সারাবাংলাকে বলেন, এ ব্যাপারে এখনও কোনো ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়নি। বিষয়টি তদন্ত চলছে বলে জানান তিনি।
সারাবাংলা/ইউজে/এমআই