আরপিও পাল্টে ৩৮২৯ কোটি টাকায় তড়িঘড়ির ইভিএম!
২৯ আগস্ট ২০১৮ ২০:৫৮
।। গোলাম সামদানী, স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট ।।
ঢাকা: হাতে একবছর সময় রেখে ইলেকট্রনিক ভোটিং মেশিনে (ইভিএম) ভোট নেওয়াকে অসম্ভব বললেও এখন মাত্র তিন মাস হাতে রেখে সেই প্রক্রিয়াকেই সম্ভব বলে ঘোষণা দিয়েছে নির্বাচন কমিশন (ইসি)। শুধু তাই নয়, গত জুলাইয়েও ইভিএম ব্যবহারকে অসম্ভব বলেছিলেন কমিশন সচিব। মাত্র একমাসের ব্যবধানে সেই সচিবই নিজের অবস্থান থেকে সরে এসে বলছেন, সম্ভব।
কী এমন ঘটনা ঘটল যে জাতীয় সংসদ নির্বাচনের ৩০০ আসনের এক-তৃতীয়াংশেই ইভিএম ব্যবহারের জন্য ইসি প্রস্তুতি নিচ্ছে?
সে প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে সারাবাংলার অনুসন্ধানে রেরিয়ে এসেছে নানা তথ্য।
দায়িত্বশীল একাধিক সূত্র জানিয়েছে, প্রায় চার হাজার কোটি টাকার একটি বরাদ্দ এই নির্বাচনের আগেই খরচ করতে হবে— এমন বিষয় এখানে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে। অধিকাংশ রাজনৈতিক দলের ভিন্নমত থাকলেও ক্ষমতাসীন দলের প্রত্যাশা পূরণের লক্ষ্যে কমিশন এ সিদ্ধান্ত নিতে যাচ্ছে বলেও মনে করছে সংশ্লিষ্ট একটি মহল।
এছাড়াও কমিশনের ভেতরেও এ নিয়ে রয়েছে মতবিরোধ। একাধিক কমিশনার সারাবাংলাকে জানিয়েছেন, তারা এখনও ইভিএম ব্যবহারের বিষয়টি জানেন না। হঠাৎ করেই নির্বাচনে ইভিএম ব্যবহারের কথা সামনে এসেছে। তড়িঘড়ি করে ইভিএম ব্যবহারের সিদ্ধান্ত কমিশনকে বিতর্কের মুখে ফেলবে বলেও মনে করছেন তারা।
কমিশনারদের একজন বলেছেন, এত তড়িঘড়ি করে এই পদ্ধতি ব্যবহারের পক্ষে নন তিনি। প্রয়োজনে কমিশন বৈঠকে এ সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে কথাও বলবেন।
সংশ্লিষ্ট বিষয়ে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এমন তড়িঘড়ি করে নেওয়া সিদ্ধান্তে যথেষ্ট সন্দেহের অবকাশ রয়েছে। তারা এই স্বল্প সময়ের মধ্যে একশ আসনের জন্য দেড় লাখ ইভিএম প্রস্তুত করা কতটা সম্ভব, সে নিয়েও প্রশ্ন তুলেছেন। এমনকি মেশিন সংগ্রহ সম্ভব হলেও তার ব্যবহারে জন্য দক্ষ জনবল তৈরি, তাদের জন্য প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা কিংবা নিরবচ্ছিন্ন ভোটগ্রহণের নিশ্চয়তা বিধানেও যে সময় প্রয়োজন, তা এখন নেই বলেও মনে করছেন তারা।
‘বিভিন্ন স্থানীয় সরকার নির্বাচনে পরীক্ষামূলকভাবে ইভিএম ব্যবহার করা হবে। জাতীয় নির্বাচনের যে সময় রয়েছে, এই সময়ের মধ্যে ইভিএম প্রস্তুত করা সম্ভব নয়,”— ২০১৭ সালের ১৫ নভেম্বর নির্বাচন কমিশনের একটি কর্মসূচিতে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে এমনটাই বলেছিলেন প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) কে এম নুরুল হুদা।
এরপরও বিভিন্ন সভা-সেমিনারে সিইসিসহ একাধিক কমিশনার বলেছেন, জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ইভিএম ব্যবহারের কোনো পরিকল্পনা তাদের নেই।
অথচ সংসদ নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার যখন মাত্র দুই মাস বাকি, এমন একটি সময়ে হঠাৎ করেই সংসদ নির্বাচনে ইভিএম ব্যবহারের কথা বলছে নির্বাচন কমিশন। এ জন্য গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশে (আরপিও) পরিবর্তন আনার কথাও বলা হয়েছে।
জানা গেছে, বৃহস্পতিবার (৩০ আগস্ট) ইসির সভায় আরপিওতে পরিবর্তন এনে সংসদ নির্বাচনের আগেই ইভিএম ব্যবহারের বিষয়টি সংযোজন করতে যাচ্ছে ইসি। তবে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেওয়ার আগে এরই মধ্যে ইভিএম কেনার লক্ষ্যে প্রকল্প পাস করিয়ে নেওয়ার প্রক্রিয়াও শুরু করেছে সাংবিধানিক এই সংস্থাটি।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে ইসি সচিব হেলালুদ্দীন আহমেদ সারাবাংলাকে বলেন, ‘আগামী একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে একশ আসনে ইলেকট্রনিক ভোটিং মেশিন ব্যবহারের পরিকল্পনা রয়েছে। এরই মধ্যে দেড় লাখ ইভিএম কেনার জন্য একটি প্রস্তাবনা পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়েছে।’
ইভিএম ব্যবহারের আগে আরপিওতে পরিবর্তন আনতে হবে— ইসি সচিব বিষয়টি স্বীকার করে নিয়ে বলেন, সে লক্ষ্যেই ৩০ আগস্ট কমিশন সভায় আরপিওতে পরিবর্তন সংক্রান্ত বিষয় নিয়ে আলোচনা হবে।
তিনি আরও জানান, বৈঠকে সিদ্ধান্ত হলে পরে আইন মন্ত্রণালয়ে ভেটিংয়ের জন্য পাঠানো হবে। তারপর মন্ত্রিসভায় অনুমোদনের পর তা সংসদে উত্থাপিত হবে। আর নির্বাচনের আগে আইন পাস, রাজনৈতিক দলগুলোর মতামত— সবকিছু ঠিক থাকলে আগামী সংসদ নির্বাচনে এক-তৃতীয়াংশ আসনে ইভিএম ব্যবহার করা সম্ভব হবে বলে মত দেন তিনি।
জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে আরপিও সংশোধন হবে না— গত জুলাইয়ে ইসি সচিবের দেওয়া এমন একটি বক্তব্যের প্রসঙ্গ টেনে আনলে তিনি সারাবাংলাকে বলেন, ‘আমি আগে বলেছিলাম, সংশোধন হবে না। আরপিও সংশোধন হচ্ছেও না। আরপিওতে নতুন করে কিছু বিষয় সংযোজন হচ্ছে। তার মাধ্যমেই জাতীয় নির্বাচনে ইভিএম ব্যবহার নিশ্চিত করা হবে।’
সংশোধন আর সংযোজন— দুইটি ভিন্ন বিষয়, বলেন ইসি সচিব হেলালুদ্দিন আহমেদ।
তিনি বলেন, স্থানীয় সরকার নির্বাচনে ইভিএম ব্যবহারের বিধান রয়েছে। সংসদ নির্বাচনেও যেন ইভিএম ব্যবহার করা যায়, আরপিওতে তা নতুনভাবে সংযোজন করা হচ্ছে।
এদিকে, একাধিক দায়িত্বশীল সূত্র সারাবাংলাকে বলছে, সরকারের কাছ থেকে ৩ হাজার ৮২৯ কোটি টাকার একটি বাজেট বরাদ্দ নেওয়ার পর এখন মাত্র তিন মাসে সে টাকা খরচ করতেই তড়িঘড়ি করে এই প্রকল্প বাস্তবায়নের উদ্যোগ নিয়েছে নির্বাচন কমিশন। এ ই প্রকল্পের সম্ভাব্যতাও যাচাই করা হয়নি।
সূত্র জানিয়েছে, সম্ভাব্যতা যাচাই ছাড়াই এরই মধ্যে প্রকল্প অনুমোদনের জন্য পরিকল্পনা কমিশনের দ্বারস্থ হয়েছে নির্বাচন কমিশন। ওদিকে, পরিকল্পনা কমিশন প্রকল্প প্রস্তাবে অনেক বিষয় অস্পষ্ট থাকায় তার ব্যাখ্যা চেয়ে পাঠিয়েছে বলেও সূত্রটি নিশ্চিত করেছে।
এমনকি প্রকল্পের প্রয়োজনীয়তা নিয়েও প্রশ্ন তুলেছে পরিকল্পনা কমিশনের প্রকল্প মূল্যায়ন কমিটি।
সূত্র জানায়, ইভিএম ব্যবহারে ৩০ জনকে বিদেশ থেকে প্রশিক্ষণ দিয়ে আনা, ৩ হাজার ১১০ জনকে স্থানীয়ভাবে প্রশিক্ষণ দেওয়া ও ২০৪ জন পরামর্শক নিয়োগের কথা রয়েছে এই প্রকল্প প্রস্তাবে। এসব বিষয়ে ব্যাখ্যা জানতে চেয়েছে পরিকল্পনা কমিশন।
তাছাড়া সংসদ নির্বাচনে ইভিএম ব্যবহার করতে হলে ভোটের কয়েক মাস আগে ভোটারদের প্রশিক্ষণ দিতে হবে। আবার ইভিএমে ভোট নেওয়ার জন্যও প্রয়োজনীয় দক্ষ জনবলও ইসির নেই। এ অবস্থায় সংসদ নির্বাচনে ইভিএম ব্যবহার এবং দেড় লাখ ইভিএম কেনার প্রকল্প নিয়ে সিইসিসহ পাঁচ কমিশনারের মধ্যে চরম মতবিরোধ দেখা দিয়েছে।
পাঁচ কমিশনারের মধ্যে দু’জন সারাবাংলাকে জানিয়েছেন, তারা এ বিষয়ে কিছুই জানেন না। তারা বলেছেন, সিইসি ও সচিব তাদের অন্ধকারে রেখে অনেক কিছু করছেন।
একজন কমিশনার নাম প্রকাশ না করার শর্তে সারাবাংলাকে জানান, আরপিও সংশোধনের বিষয়ে তিনি ‘নোট অব ডিসেন্ট’ দেওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছেন।
ইসি সূত্র জানায়, একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ১০০ আসনের জন্য প্রায় দেড় লাখ ইভিএম দরকার হবে। অথচ এই মুহূর্তে বড় আসরে ইভিএম ব্যবহার করতে প্রয়োজনীয় প্রস্তুতি ও কারিগরি সামর্থ্য ইসির নেই।
এই মুহূর্তে তিন হাজার ৮২৯ কোটি টাকার ইভিএম প্রকল্প নিয়ে দুর্নীতি হওয়ারও আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন অনেকেই। তারা এই প্রকল্প বাস্তবায়নের পূর্ণ স্বচ্ছতা নিশ্চিত করার ওপর জোর দিচ্ছেন।
আরও পড়ুন-
আরপিওতে সংযোজন হচ্ছে ইভিএম ব্যবহার
ডিসেম্বরে জাতীয় নির্বাচন, ১০০ আসনে ‘ইভিএম ব্যবহার’
সারাবাংলা/জিএস/এমএম