দুর্নীতিতে ৪র্থ অবস্থানে বিচারিক খাত
৩০ আগস্ট ২০১৮ ১৯:৪৪
।। সিনিয়র করেসপন্ডেন্ট।।
ঢাকা: দেশের সেবা খাতসমুহের মধ্যে দুর্নীতিতে শীর্ষ চারে অবস্থান করছে বিচারিক সেবাখাত। ২০১০ সালে এ খাতটি প্রথম স্থানে থাকলেও এখন এটি চারে নেমে এসেছে। এ খাতটিকে দুর্নীতি মুক্ত করতে নানামুখি উদ্যোগ নিলেও আলোর মুখ দেখছে না। এ নিয়ে সুপ্রিমকোর্ট প্রশাসন ও সিনিয়র আইনজীবীদের মধ্যে রয়েছে মিশ্র প্রতিক্রিয়া।
বৃহস্পতিবার (৩০ আগস্ট) রাজধানীর ধানমন্ডির মাইডাস সেন্টারে ‘সেবা খাতের দুর্নীতি, জাতীয় খানা জরিপ ২০১৭’ শীর্ষক এক সংবাদ সম্মেলনে এ তথ্য তুলে ধরে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি)।
টিআইবির রিপোর্টে গত বছর সবচেয়ে দুর্নীতিগ্রস্ত খাত ছিল সেবা। সেবা খাতের মধ্যে শীর্ষে আছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী সংস্থার দুর্নীতি। চতুর্থ স্থানে রয়েছে বিচারিক সেবা খাতটি। এ খাতে দুনীর্তির শিকার হয়েছে ৬০ দশমিক ৫ শতাংশ মানুষ।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে সুপ্রিমকোর্টের বিশেষ কর্মকর্তা সাইফুর রহমান সারাবাংলাকে বলেন, ‘টিআইবির রিপোর্ট পর্যালোচনা না করে আমরা কোনো মন্তব্য করব না। তবে বিচার বিভাগের গতিশীলতা ও স্বচ্ছতা আনতে সুপ্রিম কোর্ট প্রশাসন থেকে নিয়মিত ঝটিকা সফরসহ বিভিন্ন পদক্ষেপ নিচ্ছেন প্রধান বিচারপতি।’
এছাড়া বিচার বিভাগকে দুর্নীতিমুক্ত করতে হাইকোর্টের দেওয়া ১৩ দফা সুপারিশ বাস্তবায়ন করছে সুপ্রিমকোর্ট প্রশাসন।
সাইফুর রহমান বলেন, ‘১৩ দফা সুপারিশের আলোকে সুপ্রিমকোর্টের শাখাগুলোতে ঝটিকা সফর, সন্দেহজনক কর্মকর্তাদের বদলি, দক্ষ কর্মকর্তা নিয়োগ দেওয়া হচ্ছে। কারো বিরুদ্ধে অভিযোগ আসলে তাৎক্ষণিক ব্যবস্থা গ্রহণসহ বিভিন্ন পদক্ষেপ নেওয়া হচ্ছে।’
সুপ্রিমকোর্ট আইনজীবী সমিতির সভাপতি অ্যাডভোকেট জয়নুল আবেদীন সারাবাংলাকে বলেন, ‘আমি মনে করি, উচ্চ আদালত দুর্নীতির প্রতি জিরো টলারেন্সে রয়েছে। এখানে প্রধান বিচারপতিও জিরোটলারেন্সে এবং আমি আইনজীবী সমিতির সভাপতি হিসেবে জিরো টলারেন্সে আছি। তবে আমাদের টোটাল বিচার বিভাগের মধ্যে নিম্ন আদালতগুলো দুর্নীতির ঊর্ধ্বে ছিল না, এখনও নেই। এক্ষেত্রে টিআইবির যে রিপোর্ট একেবারে অমূলক এ কথা বলতে পারি না।’
তিনি বলেন, ‘দুর্নীতিরোধে একটি দেশের সরকার ব্যবস্থা এবং এ বিভাগের দায়িত্বে যে মন্ত্রণালয় রয়েছে। সেই মন্ত্রণালয়ের আরও সচেতন হওয়া দরকার। এই মন্ত্রণালয় যে ঘুষ দুর্নীতির ঊর্ধ্বে আছে তাও আমি বলতে পারব না। আমাদের হাইয়েস্ট কোর্টের বিচারকরা এখনো ঘুষ দুর্নীতির উর্ধ্বে থেকে বিচার ব্যবস্থা পরিচালনা করছেন।’
জয়নুল আবেদীন বলেন, ‘বিচারিক সেবা খাতের উন্নয়নের বিষয়ে সাবেক প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহা মাসদার হোসেন মামলার রায়ের আলোকে যেভাবে চেয়েছিলেন, সেভাবে পরিচালিত হলে আজকে প্রধান বিচারপতিকে দায়ী করা যেত। কিন্তু সেই অবস্থায় তো বিচার বিভাগ এখন নেই। এখানে নিম্ন আদালতে সরকারের হস্তক্ষেপ রয়েছে। সে জন্য এ অভিযোগ একা প্রধান বিচারপতির ওপর বর্তাবে এ কথা আমি বলতে পারি না। এখানে আইন মন্ত্রণালয় সম্পৃক্ত আছে।’
সুপ্রিমকোর্ট আইনজীবী সমিতির সম্পাদক ব্যারিস্টার মাহবুব উদ্দিন খোকন বলেন, ‘টিআইবি সঠিক রিপোর্ট দেয়নি। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী সংস্থা নয়, বিচারিক সেবাখাতই এক নম্বর হওয়া উচিৎ ছিল।’
তিনি বলেন, ‘সাধারণ মানুষ বিচার চাইতে এসে প্রতিটি জায়গায় দুর্নীতির শিকার হচ্ছে। শুধু টাকা দিয়েই দুর্নীতি হচ্ছে না। স্বজনপ্রীতি, অবিচারের মাধ্যমেও দুর্নীতি হচ্ছে।’
বিচারিক খাতটি একটি মনিটরিং ছাড়া খাত উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘এখানে কোনো মনিটরিং নেই। প্রধান বিচারপতির কোনো সচিবলায় নেই। আইন মন্ত্রণালয় বলছে তারা মনিটরিং করছে না। তাহলে মনিটরিং করছে কে? সাবেক প্রধান বিচারপতি এস কে সিনহাকে জোর করে পদত্যাগ করানোর পরে বিচার বিভাগ আরও লাগামহীন হয়ে গেছে। বিচার বিভাগে কোনো জবাবদিহিতা নেই। বিচারে স্বচ্ছতা আছে কি না সেটি দেখারও কেউ নেই। প্রধান বিচারপতি ব্যক্তিগতভাবে একা কতটা মনিটরিং করতে পারবেন।’
এখানে আইন মন্ত্রণালয় হস্তক্ষেপ করে আবার সুপ্রিমকোর্টও নিয়ন্ত্রণ করার চেষ্টা করে এই টানাহেঁচড়ার মধ্যে বিচার বিভাগ আছে। এ সুযোগে দুর্নীতিবাজরা দুর্নীতি করছে বলেও অভিযোগ করেন তিনি।
অপরদিকে আওয়ামী লীগের আইন সম্পাদক শ ম রেজাউল করিম সারাবাংলাকে বলেন, ‘শুধু বিচার বিভাগ নয়, কোনো বিভাগই দুর্নীতিমুক্ত নয়। সব ক্ষেত্রেই অনিয়ম রয়েছে। তারপরও বিচার বিভাগ দুর্নীতি মোকাবেলা করে এগিয়ে চলছে। আশা করি সামনের দিনগুলোতে বিচার বিভাগ সম্পূর্ণরূপে দুর্নীতিমুক্ত হবে।’
প্রধান বিচারপতি জোরালো পদক্ষেপে নিম্ন আদালতসহ সার্বিক ক্ষেত্রে দুর্নীতি মুক্ত হবে বলেও প্রত্যাশা করেন তিনি।
বিচারিক সেবাখাতের দুর্নীতির সঙ্গে আইন মন্ত্রণালয়ের কোনো সম্পৃক্ততা নেই উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘বিচার বিভাগে আইন মন্ত্রণালয় শুধুমাত্র একটি পোস্টবক্সের কাজ করে থাকে। বিচার বিভাগের সার্বিক সিদ্ধান্ত সবকিছুই সুপ্রিম কোর্টের জি এ কমিটি নিয়ে থাকে।’
টিআইবির রিপোর্ট অনুযায়ী ২০১৭ সালে দেশের ৬৬ দশমিক ৫ শতাংশ মানুষ দুর্নীতির শিকার হয়েছে। তিনটি খাতে সর্বোচ্চ দুর্নীতি হয়েছে। এর মধ্যে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ৭২ দশমিক ৫ শতাংশ, পাসপোর্টে ৬৭ দশমিক ৩ শতাংশ, বিআরটিএ ৬৫ দশমিক ৪ শতাংশ দুর্নীতি করেছে। এছাড়া বিচারিক সেবা খাতে দুর্নীতির শিকার হয়েছে ৬০ দশমিক ৫ শতাংশ মানুষ। দুর্নীতিতে পঞ্চম, ষষ্ঠ ও সপ্তম অবস্থানে রয়েছে ভূমি সেবা, শিক্ষা ও স্বাস্থ্য।
২০১০ সালের রিপোর্ট অনুযায়ী বিচারপ্রার্থীদের ৮৮ শতাংশ শুনানির সময় নির্ধারণ থেকে শুরু করে নথিপত্র গায়েব এবং উৎকোচ দেওয়াসহ নানা অনিয়মের শিকার হয়েছিল। নিম্ন আদালত থেকে শুরু করে উচ্চ আদালত—বিচার বিভাগের প্রতিটি স্তরে ঘুষের দৃষ্টান্ত থাকলেও জরিপে শীর্ষে ছিল উচ্চ আদালত।
সারাবাংলা/এজেডকে/একে