Saturday 23 Nov 2024
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

মুক্তিযোদ্ধা রমা চৌধুরী আর নেই


৩ সেপ্টেম্বর ২০১৮ ০৮:৪৬
।। স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট ।।
চট্টগ্রাম ব্যুরো : ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধে বর্বর পাক সেনাদের হাতে সম্ভ্রম হারিয়েছিলেন যে দু’লাখ মা-বোন, তাদের একজন চট্টগ্রামের রমা চৌধুরী। ১৬ ডিসেম্বর মুক্তিযুদ্ধ শেষ হয়েছিল। স্বাধীন হয়েছিল দেশ। কিন্তু ষাটের দশকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সাহিত্যে স্নাতকোত্তর সম্পন্ন করা রমা চৌধুরীর যুদ্ধ ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর শেষ হয়নি।
সমাজের লাঞ্ছনা-গঞ্জনার সঙ্গে প্রতিনিয়ত যুদ্ধ করতে হয়েছে। তিন সন্তান হারানোর শোক কাটানোর যুদ্ধ করতে হয়েছে। পেটের দায়ে নিজের লেখা সাহিত্যকর্ম রাস্তায় ফেরি করে বিক্রি করার জীবনযুদ্ধ করতে হয়েছে। শেষদিকে এসে শরীরে বাসা বেঁধে থাকা রোগব্যাধির সঙ্গে যুদ্ধ করতে হয়েছে।
বেঁচে থাকার তাগিদে জীবন নিয়ে রমা চৌধুরীর গত ৪৮ বছরের যুদ্ধের অবসান হয়েছে সোমবার (০৩ সেপ্টেম্বর) ভোর ৪ টা ৪০ মিনিটে। চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের ইনটেনসিভ কেয়ার ইউনিটে (আইসিইউ) চিকিৎসাধীন রমা চৌধুরীকে দেওয়া লাইফ সাপোর্ট মেশিন খুলে নেওয়া হয়। প্রকৃতির নিয়মের কাছে হার মেনে পৃথিবী থেকে চিরবিদায় নিলেন আজন্ম যোদ্ধা রমা চৌধুরী।
মুক্তিযুদ্ধের সময় দুই ছেলে ও পরে আরও এক ছেলে হারানো রমা চৌধুরী নিজেকে বলতেন ‘একাত্তরের জননী’। এই নামে তাঁর একটি বহুল পাঠকপ্রিয়  উপন্যাসও আছে।
একাত্তরের জননীকে সন্তানের মতো করে তিন দশকেরও বেশি সময় ধরে ছায়া দিয়ে যাওয়া তাঁর বইয়ের প্রকাশক আলাউদ্দিন খোকন কান্নায় ভেঙ্গে পড়ে সারাবাংলাকে বলেন, দিদি আর নেই। ভোর ৪টা ৪০ মিনিটে চিকিৎসক তাকে মৃত ঘোষণা করেছেন।
৭৫ বছর বয়সী রমা চৌধুরী এক সন্তান জহর চৌধুরীকে রেখে গেছেন।
২০১৭ সালের ২৪ ডিসেম্বর বাসায় পড়ে গিয়ে কোমরে গুরুতর আঘাত পান রমা চৌধুরী। ওইদিনই তাকে বেসরকারি ক্লিনিক মেডিকেল সেন্টারে ভর্তি করা হয়। সেই যে বিছানায় শয্যাশায়ী হয়েছেন, আর দাঁড়াতে পারেননি আজীবন সংগ্রামী এই নারী।
গত ১৭ জানুয়ারি তাকে ভর্তি করা হয় চমেক হাসপাতালে। শারীরিক অবস্থার উন্নতি দেখে চিকিৎসকরা ছাড়পত্র দিলে গত ২৫ মার্চ তাকে নিয়ে যাওয়া হয় গ্রামের বাড়ি বোয়ালখালীতে। কিছুদিন ভালো থাকার পর আবারও তার রক্তবমি হলে ফের ভর্তি করা হয় চমেক হাসপাতালে। সরকারের পক্ষ থেকে চতুর্থ তলার মুক্তিযোদ্ধা কেবিনে তার থাকার ব্যবস্থা করা হয়।
অবস্থার অবনতি হলে গত ২৬ আগস্ট তাকে নেওয়া হয় চমেক হাসপাতালের আইসিইউতে। ২৯ আগস্ট তাকে আবারও আইসিইউতে নেওয়া হয়। ১ সেপ্টেম্বর জীবন-মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে চলে যান তিনি, ফের নেওয়া হয় আইসিইউতে। ২ সেপ্টেম্বর রাতে একেবারে শেষ অবস্থায় পৌঁছার পর লাইফ সাপোর্টের মাধ্যমে তাকে বাঁচিয়ে রাখা হয়।
রমা চৌধুরীর বাড়ি চট্টগ্রামের বোয়ালখালী উপজেলার পোপাদিয়া গ্রামে। একাত্তরের ১৩ মে তিন শিশু সন্তান নিয়ে পোপাদিয়ায় গ্রামের বাড়িতে ছিলেন রমা চৌধুরী, স্বামী ছিলেন ভারতে। ওইদিন এলাকার দালালদের সহযোগিতায় পাক হানাদার বাহিনীর লোকজন তাদের ঘরে হানা দেয়। নিজের মা আর পাঁচ বছর ৯ মাস বয়সী ছেলে সাগর ও তিন বছর বয়সী টগরের সামনেই তাকে ধর্ষণ করে এক পাকিস্তানি সৈনিক।
পাকিস্তানিদের কাছে নির্যাতিত হয়ে সমাজের লাঞ্চনায় এবং ঘরবাড়ি হারিয়ে অসহায় হয়ে পড়েন রমা চৌধুরী। দিনান্তে ভাত জুটছে না। অনাহারে, অর্ধহারে অসুস্থ হয়ে ১৯৭১ সালের ২০ ডিসেম্বর মারা যায় বড় ছেলে সাগর। ১৯৭২ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি মারা যায় দ্বিতীয় সন্তান টগর। ১৯৯৮ সালের ১৬ ডিসেম্বর বোয়ালখালীর কানুনগোপাড়ায় সড়ক দুর্ঘটনায় মারা যান তৃতীয় সন্তান টুনু।
তিন সন্তান মাটির নিচে, জুতা পরে মাটির উপরে হাঁটলে তারা ব্যথা পাবে-এমন এক আবেগ থেকে গত দুই দশক ধরে জুতা পরেননি রমা চৌধুরী।
আশির দশকের মাঝামাঝি থেকে নিজের লেখা বই ফেরি করে বিক্রি শুরু করেন রমা চৌধুরী। ২০১৭ সালের জুন পর্যন্ত তিনি নিজের নিয়মে খালি পায়ে রাস্তায় হেঁটে হেঁটে বই বিক্রি করে গেছেন। এরপর শারীরিক শক্তি হারাতে শুরু করেন।
ধুঁকে ধুঁকে জীবন পার করা এই নারী কখনও কারও কাছে সাহায্যের জন্য হাত পাতেননি। প্রচণ্ড আত্মমর্যাদাশীল এই সংগ্রামী প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সাহায্যের প্রস্তাবও ফিরিয়ে দিয়েছিলেন।
সারাবাংলা/আরডি/এসএমএন

বিজ্ঞাপন

রমা চৌধুরী

বিজ্ঞাপন

চট্টগ্রামে আগুনে পুড়ল ৫ দোকান
২৩ নভেম্বর ২০২৪ ১২:৩৪

আরো

সম্পর্কিত খবর