মুগ্ধতার মকস বিল হারাতে বসেছে সৌন্দর্য
৪ সেপ্টেম্বর ২০১৮ ০৯:১০
।। মেসবাহ শিমুল, সিনিয়র করেসপন্ডেন্ট।।
গাজীপুর, কালিয়াকৈর থেকে ফিরে: রাজধানী ঘেঁষে বয়ে চলা দূষিত, নিষ্প্রাণ তুরাগ নদ এখানে এসে নাম বদলে হয়ে গেছে বংশী নদী। নামের সঙ্গে বদলেছে চেহারাও। বংশী এখানে আরও বেশি তেজদ্দীপ্ত আর খরস্রোতা। ভাদ্রের বিকেলে পশ্চিম আকাশের সূর্য যখন অসহ্য, তখন মন ভরে যায় বংশীর প্রশস্ত বুকে চোখ বুলিয়ে। ওদিকে পশ্চিমের বাতাসে কল্যাণে বংশীর বুকে ছোট ছোট ঢেউয়ের খেলা— এই আছে তো এই নেই।
চতল সোলানা মধ্যপাড়ার এ স্থানটির একপাশে মকস বিল, অন্য পাশে বংশী নদী— দুয়ে মিলে প্রকৃতির এক অপূর্ব মিশেল গাজীপুর কালিয়াকৈরের এ বিশাল এলাকা। আর সে কারণেই রোদের তেজ পড়তে শুরু করলেই আশপাশের এলাকার মানুষের পদচারণায় মুখর হয়ে ওঠে গোটা এলাকা। এই সৌন্দর্য কতদিন তারা উপভোগ করতে পারবেন, সেই শঙ্কাও অবশ্য ঘিরে ধরতে শুরু করেছে।
উপজেলা মৎস অফিসের তথ্য অনুযায়ী, কালিয়াকৈরে রয়েছে মোট ২৩টি অভায়শ্রম। এগুলোর আয়তন ১১ দশমিক ৮ হেক্টর। এসব অভয়াশ্রমের বেশিরভাগই মকস বিল এলাকায়।
জনশ্রুতি আছে, বাংলাদেশের একদিনের খাবার নাকি মকস বিল থেকেই আহরণ করা সম্ভব ছিল একসময়। স্বচ্ছ-পরিষ্কার পানিতে এই বিলে শনি থেকে মঙ্গলবার রাতে দেশের নানা প্রান্ত থেকে জেলেরা আসতেন মাছ ধরতে। তাদের শোরগোলে আশপাশের পাঁচ-ছয়টা গ্রামের মানুষকে নির্ঘুম রাত কাটাতে হতো। কেবল মাছই নয়, এ বিলে ধানের ফলনও প্রচুর।
বিকেল হলেই বিলের মাঝখান দিয়ে বেড়িবাঁধের কয়েক কিলোমিটার এলাকায় দেখা যায় বিপুলসংখ্যক দর্শনার্থী। তারা মূলত আশপাশের এলাকার বাসিন্দা। বিকেলের একটু অবসরে প্রকৃতির কোলে কিছু সময় কাটাতেই তারা ছুটে আসেন।
উপজেলার সিনাবহ গ্রামের বাসিন্দা রুবেল আহমেদ সারাবাংলাকে বলেন, প্রতিদিন অন্তত হাজারখানেক লোক আসেন বিল দেখতে। বিলটিকে কেন্দ্র করে শাল-গজারির এ জনপদ জেগে থাকে সকাল থেকে রাত অবধি।
এ বিলে রয়েছে অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহন ব্যবস্থাও। ছোটো নৌকায় বিলের এ প্রান্ত থেকে ও প্রান্ত যেমন যাওয়া যায়, তেমনি কালিয়াকৈর-শ্রীপুরসহ বেশ কয়েকটি রুটে চলে যাত্রীবাহী লঞ্চও।
সৌন্দর্যে গাজীপুরের পুরো এলাকা অতুলনীয় হলেও এ বিলের সৌন্দর্যের মাত্রাটা একটু ভিন্ন। দর্শনার্থীদেরও তাই এ বিলের প্রতি আকর্ষণ একটু বেশিই।
উপজেলার যেকোনো স্থান থেকে ব্যাটারিচালিত রিকশা, ইজিবাইক কিংবা প্রাইভেট কারে করে যেতে যেতে যে সড়কগুলো চোখে পড়বে, তাতে চোখ আটকে যাবে যে কারও। সরু আঁকা-বাঁকা, উঁচু-নিচু আর পরিচ্ছন্ন পিচঢালা পথ বেয়ে যেতে যেতে যেন থামতে মন চায় না। শাল-গজারি কিংবা আকাশমনির বাগান পেরিয়ে মকস বিল এলাকায় পা রাখলে চোখ আটকে যায় বেড়িবাঁধের পাশে সারি সারি চরক জালে।
ওদিকে, বিকেলের সোনালি রোদ গলে গলে পড়ে বিলের পানিতে। সেই সোনালি আলোয় জেলেদের মাছ ধরার দৃশ্যকে করে তোলে অপূর্ব। স্থানীয়রা জানান, এ বিলে দেশীয় প্রজাতির নানা মাছ স্বাদে যেমন অতুলনীয়, দামেও সস্তা।
আনোয়ার হোসেন নামের একজন সৌখিন জেলে জানালেন, মূলত বিলের সুস্বাদু মাছের লোভেই এবার একটি চরক জাল কিনেছেন। বাঁশ আর জাল মিলে প্রায় ছয় হাজার টাকা খরচ হয়েছে তার। বোয়াল, শোল, পুঁটিসহ নানান জাতের যে মাছ পান, তা পরিবারের চাহিদা মিটিয়ে বিক্রিও করে থাকেন তিনি।
এ বিলের একমাত্র ফাস্টফুডের দোকান জলকুটির। বিলের ওপর ভাসমান এ রেস্টুরেন্ট এরই মধ্যে খ্যাতি পেয়েছে আশপাশের এলাকায়ও। খোলা আকাশের নিচে ছোট ছোট রুমে ভাগ করা এ রেস্টুরেন্ট নিজেই যেন একটি পর্যটন স্পট। রেস্টুরেন্টের মূল গেট দিয়ে ঢুকে সামনে যেতে যেতে দেখা মিলে দূরদূরান্ত থেকে আসা দর্শনার্থীদের। কেবল খাবারের দাম দিয়েই তারা সৌন্দর্য উপভোগ করছেন এই মায়াবী বিকেলে।
জলকুটির ফাস্টফুডের ম্যানেজার রাকিব আজাদ সারাবাংলাকে বলেন, ব্যক্তি উদ্যোগে গড়া এ ফাস্টফুডে দেশীয় সব খাবারই পাওয়া যায়। কফি, চটপটি, ফুসকাসহ সাধারণ খাবার বাদে অন্য খাবারগুলো অর্ডার দিলে তারা সরবরাহ করে থাকেন। প্রচলিত দামের চেয়ে সস্তায় তারা খাবার পরিবেশন করে বলেও জানান তিনি।
এমন অতুলনীয় সৌন্দর্যের আধার মকস বিল নিয়ে অবশ্য শঙ্কাও ছড়িয়ে পড়ছে। কতদিন এই সৌন্দর্য ধরে রাখতে পারবে এই বিল, তা নিয়েই তৈরি হয়েছে শঙ্কা। স্থানীয়রা বলছেন, উপজেলার শফিপুর, চন্দ্রা শিল্পাঞ্চলে গড়ে ওঠা দুইটি ট্যানারি, একটি অ্যালুমিনিয়াম ও দুই শতাধিক নিটিং ও ডাইং মিলের পরিত্যক্ত বিষাক্ত রাসায়নিক বর্জ্য, বিভিন্ন রঙ এবং কেরোসিন মেশানো কালো পানি এবং চন্দ্রা অ্যাপেক্স ট্যানারির লবণাক্ত পানি এ বিলে এসে পড়তে শুরু করেছে। এতে করে জমির মাটি কালো আর ফাঁপা হয়ে উঠছে। মাছের ওপরও পড়ছে নেতিবাচক প্রভাব। শুধু তাই নয়, বিল দখলেও তৎপর হয়ে উঠেছে কেউ কেউ।
কালিয়াকৈর পৌর মেয়র মুজিবুর রহমান সারাবাংলাকে বলেন, প্রভাবশালী অনেকগুলো ব্যবসায়ী গ্রুপ এরই মধ্যে মধ্যে বিলের বেশ কিছু জমি কিনে নিয়েছে। আরও অনেক ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠান এ বিলের জমি কিনতে চায়। ব্যবসায়িক গ্রুপগুলো জমি কিনলে তারা সেখানে মিল-কারখানা করবে। তখন এ বিল পড়বে অস্তিত্ব সংকটে।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে কালিয়াকৈর উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা কৃষিবিদ দিলরুবা আখতার জানান, ফসলি জমি নষ্ট হওয়া সত্ত্বেও কৃষি বিভাগের কৃষকদের সচেতন করা ছাড়া কিছুই করার নেই। শিল্পকারখানার বর্জ্যের ব্যাপারে পরিবেশ অধিদফতর ও স্থানীয় প্রশাসন জোরালো পদক্ষেপ নিলে ফসলি জমি নষ্ট হওয়ার হাত থেকে অনেকটা রক্ষা পেতে পারে।
সারাবাংলা/এমএস/এমআই/টিআর