‘মেয়েডারে বলে আসিছি আমি আর ফিরব না’
৩১ ডিসেম্বর ২০১৭ ১৩:৪৩
সিনিয়র করেসপন্ডেন্ট
ঢাকা : ‘আমার মেয়েডা অসুস্থ। এবার এসএসসি পরীক্ষা দেবে। ঢাকায় আসার সময় ওর মাথায় হাত রেখে বলে আসিছি, আমি আর ফিরব না। তুই তোর বাবারে নিয়ে থাকিস।’
রাজধানীর জাতীয় প্রেস ক্লাবের সামনে বসে সারাবাংলার এ প্রতিবেদকের কাছে কথাগুলো বলছিলেন, খুলনার তেরখাদা উপজেলার পাতলা গ্রামের সাগরিকা মজুমদার। তিনি সেখানকার সোনারতরী নিম্ন মাধ্যমিক বালিকা বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক।
টানা পাঁচদিন ধরে প্রেস ক্লাবের সামনের ফুটপাতে অবস্থান ধর্মঘট করে আসছেন তিনি। তীব্র শীত আর মশার উপদ্রব। সেইসঙ্গে ধুলোবালিতে মাখা এক নিরাপত্তাহীন জীবন কাটাচ্ছেন তিনি। অথচ এই সময়ে পরিবারের সঙ্গে থাকা আর বিদ্যালয়ে পাঠদান করাই তার একমাত্র স্বপ্ন। কিন্তু সে স্বপ্ন আজ এই শহরের বিষাক্ত ধুলোয় মলিন হয়ে গেছে।
নন-এমপিও শিক্ষা প্রতিষ্ঠান শিক্ষক-কর্মচারী ফেডারেশনের ডাকে স্বীকৃতিপ্রাপ্ত শিক্ষা-প্রতিষ্ঠান এমপিওভুক্তির দাবিতে অবস্থান ধর্মঘট রোববার পঞ্চমদিনে এসে দাঁড়িয়েছে ‘আমরণ অনশন’-এ। এর মধ্যদিয়ে হয় দাবি আদায়, না হয় লাশ হয়ে ফিরতে চান পরিবারের কাছে; যার জন্য প্রস্তুত সাগরিকা মজুমদার।
তিনি জানান, ২০০৪ সালে প্রতিষ্ঠিত সোনারতরী স্কুলে তিনি শুরু থেকেই প্রধান শিক্ষকের দায়িত্ব পালন করে আসছেন। স্কুলে ছাত্রীদের কাছ থেকে কোনো টাকা নেওয়ার সুযোগ তো নেই বরং বিভিন্ন অনুষ্ঠানে শিক্ষকদের কাছ থেকে টাকা তুলে খরচ করতে হয়। পাঠদানের অনুমতি আছে, স্বীকৃতি আছে, কেবল নেই এমপিও। তাই একটি টাকাও পান না স্কুল থেকে। এ অবস্থায় পরিবার নিয়ে চরমভাবে হিমশিম খাচ্ছেন তিনি।
দুই সন্তানের মধ্যে মেয়ে পুণম বিশ্বাস ছোটো। এবার এসএসসি পরীক্ষার্থী। অজ্ঞাত এক রোগে ভুগছে সে। একথা বলতেই দুচোখ বেয়ে লোনাজল গড়িয়ে পড়ে। তবুও সাগরিকা বলেজান তার দুঃখের কাহিনী। ‘বেশকিছুদিন আগে মেয়েটা হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়ে। খুলনায় চিকিৎসা করাই। কিন্তু তারা কিছুই বলতে পারেননি। এরপর ঢাকায় নিয়ে আসি। কিন্তু কোনো রোগই শনাক্ত করতে পারেন না তারা। ভিটেমাটির কিছু খুইয়ে ভারতের ভেলোরে নিয়ে যাওয়ার প্রস্তুতি নিই। কিন্তু পাসপোর্টে একটু সমস্যার কারণে নিয়ে যেতে পারিনি। আসার আগে ও খুব অসুস্থ ছিল। কিন্তু কী করব কিছু করার নেই। আমি চলে আসিছি। আসার সময় মেয়েডার মাথায় হাত রেখে বলে আসিছি আমি আর ফিরে আসব না, তুই তোর বাবারে নিয়ে থাকিস। কাঁদতে কাঁদতে খেই হারিয়ে ফেলেন সাগরিকা মজুমদার।
কীভাবে চলছে সংসার-এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, তিন থেকে চার বিঘা জমি আছে। মাছের ঘের আছে- এ কথা বলতেই যেনে একটু স্বস্তির নিঃশ্বাস ছাড়েন তিনি। বলেন-‘একটু ঘের আছে বলেই তো এখনো বেঁচে আছি। ওর বাবা তো কিছু করে না একটু ঘের করে। কোনো রকম দিন যায়। কিন্তু মাঝে মাঝে যে মাছ ছাড়ি, তা পাই না। আবার মাছে মড়ক ধরে। তখন তো হাঁড়ি কলসি সব নিয়ে মরতি হয়।’
কেমন আছে মেয়ে পুনম আর কীভাবেই বা এখানে থাকছেন এমন প্রশ্নে বড় অসহায়ের মতো বলেন সাগরিকা। বলেন, সংসার যে কীভাবে চলছে, জানি না। শুধু মেয়েডার খোঁজ খবর একটু নেই ফোন করে। বেশি কিছু জানতে চাই না। এতে কষ্ট বাড়ে, অস্থিরতা বাড়।
মেয়েডা জানতে চায়, মা কি কর? কি খাও? কই ঘুমাও। আমি ওরে খোলসা করে কিছু বলি না। বলি, এহন রাখ, পরে আবার ফোন দিব।
বলেন, কষ্টের কথা, লজ্জার কথা বলতে বাঁধে। কীভাবে বলি। ঢাকায় রাস্তায় ঘুমাই। আশপাশের ছোটো ছোটো হোটেল গিয়ে খাই। কি খাই তা বলব না। বুঝে নেবেন। একটাকা ইনকাম নাই। কতদিন আর চলে।
সারাবাংলা/এমএস/একে