হুইল চেয়ারে আদালতে খালেদা জিয়া
৫ সেপ্টেম্বর ২০১৮ ১৭:০৪
।। আব্দুল জাব্বার খান, সিনিয়র করেসপন্ডেন্ট।।
ঢাকা: জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট দুর্নীতি মামলায় দণ্ডপ্রাপ্ত খালেদা জিয়া সাতমাস পর কেন্দ্রীয় কারাগারে স্থাপিত অস্থায়ী বিশেষ আদালতে হাজিরা দিয়েছেন। হুইল চেয়ারে কারাগার থেকে তাকে প্রশাসনিক ভবনের ৭ নম্বর কক্ষের আদালতে আনা হয়।
দুপুর সোয়া ১২টার দিকে খালেদা জিয়াকে কারাগারের ভেতর থেকে হুইল চেয়ারে করে কেন্দ্রীয় কারাগারের মূল ফটকের পরে ডান পাশে স্থাপিত অস্থায়ী আদালতে তাকে হাজির করা হয়। কারা পুলিশের কয়েকজন নারী সদস্য বিএনপি চেয়ারপারসনকে হুইল চেয়ারে করে নিয়ে আসেন।
এ সময় খালেদা জিয়ার পরনে ছিল গোলাপি রঙের শাড়ি। তবে কোমর থকে পা পর্যন্ত সাদা কাপড় দিয়ে ঢাকা ছিল।
খালেদা জিয়ার বামহাত সাদা কাপড়ের ভিতরে আর ডান হাত দিয়ে হুইল চেয়ারের হাতল ধরে ছিলেন। বিচারকাজ চলাকালে আদালতে বসে থাকা খালেদা জিয়া কিছুটা কাঁপছিলেন। খালেদা জিয়ার ডান হাতে ছিল টিস্যু পেপার। প্রয়োজনে ডান হাত নাড়াচাড়া করেছেন তিনি।
তবে খালেদা জিয়ার বাম হাত ছিল নিষ্ক্রিয়। পৌনে এক ঘণ্টা আদালত চলাকালে একটিবারের জন্য তিনি তার বাম হাত নাড়াতে পারেননি। আদালত চলাকালে পুরো সময়টি তিনি হুইল চেয়ারেই বসেছিলেন।
কারাগারে আসার পর উন্নত চিকিৎসা না পেয়ে শারীরিকভাবে আরও অসুস্থ হয়ে পড়েছেন বলে দাবি করেছেন তার আইনজীবী ও বিএনপি নেতারা।
সে কারণে জিয়া চ্যারিটেবল ট্রাস্ট দুর্নীতির মামলার ‘১৪ থেকে ১৫টি শুনানিতে’ খালেদা জিয়া হাজির হননি বলে জানিয়েছেন রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী মোশাররফ হোসেন কাজল। সর্বশেষ গত ৭ আগস্ট মামলাটি যুক্তিতর্ক শুনানিতেও ‘অসুস্থ’ খালেদা জিয়া উপস্থিত হননি।
এ পরিস্থিতিতে মামলার কার্যক্রম এগিয়ে নিতে পুরাতন কেন্দ্রীয় কারাগারেই আদালত স্থাপনের আবেদন জানানো হয় বলে জানান মামলার রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী মোশাররফ হোসেন কাজল। সেই আবেদন অনুযায়ী কারাগারে আদালত স্থানান্তরের গেজেট প্রকাশ করে আইন মন্ত্রণালয়।
বকশিবাজারের অস্থায়ী আদালতের কার্যক্রম কারাগারের ভেতরে আনার সিদ্ধান্ত মঙ্গলবারই চূড়ান্ত হয়। সে জন্য সকাল থেকে দুদকের আইনজীবী, সাংবাদিক ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা অস্থায়ী আদালতে উপস্থিত হন। কিন্তু খালেদা জিয়া উপস্থিত হবেন কি হবেন না তা নিয়ে সবার মধ্যে নানা কৌতূহল দেখা যায়। শুরুর দিকে কেউ নিশ্চিত করে বলতে পারছিলেন না খালেদা জিয়া আদালতে আসবেন কি আসবেন না?
অবশেষে সোয়া ১২টার দিকে কারাগারের ভেতরে যে ভবনে খালেদা জিয়াকে রাখা হয়েছে সেখান থেকে হুইল চেয়ারে করে মূল ফটকের পাশে অবস্থিত প্রশাসনিক ভবনে নিয়ে আসা হয়।
খালেদা জিয়ার হুইল চেয়ার ঘিরে ছিলেন পাঁচজন নারী কারারক্ষী। গৃহকর্মী ফাতেমাও এ সময় তার সঙ্গে ছিলেন। প্রশাসনিক ভবনের ভেতরের অংশের রাস্তা দিয়ে তাকে নিয়ে আসা হয়। এ সময় মূল ফটকের ভেতরে বড় লোহার ফটকও খুলে দেওয়া হয়। আদালত কক্ষে এসময় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারাসহ বিভিন্ন সংস্থার কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন। তবে খালেদা জিয়ার কোনো আইনজীবী উপস্থিত ছিলেন না।
আদালতের অবস্থান: পুরাতন কেন্দ্রীয় কারাগারের মুল ফটকের পর হাতের ডান পাশে কয়েকটি রুম নিয়ে এ অস্থায়ী আদালত তৈরি করা হয়েছে। জেল পুলিশের কার্যালয় হিসেবে ব্যবহৃত সাত নম্বর কক্ষকে আদালতের আদলে তৈরি করা হয়েছে।
কক্ষের একেবারের পূর্ব মাথায় বিচারকের চেয়ার বসানো হয়েছে। এরপর এজলাসের বাম পাশে আসামিদের কাঠগড়া, তার একটু সামনে ডান পাশে প্রসিকিউশন পক্ষ তার বিপরীত পাশে খালেদা জিয়ার জন্য একটি চেয়ার ও একটি টি টেবিল রাখা। এরপরেই ডিফেন্স পক্ষের আইনজীবীদের বসার জায়গা করা হয়েছে। সাংবাদিক ও নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্যদের জন্য আদালতের সঙ্গে সংযুক্ত পাশের দুটি রুমে বসার ব্যবস্থা করা হয়েছে। তবে ওইসব রুম থেকে বিচারককে সরাসরি দেখা যায় না।
জানা যায়, যে স্থানে কারাগার স্থাপন করা হয়েছে সেটি জেল পুলিশের কার্যালয় ছিল। পুরাতন এ রুমগুলোকে নতুন করে রং করে এটি তৈরি করা হয়েছে। ছয় নম্বর রুমকে বিচারকের খাসকামরা করা হয়েছে।
আদালতের কার্যক্রম: খালেদা জিয়া আদালতে প্রবেশের ১০ মিনিট পর খাসকামরা থেকে এজলাসে আসেন বিশেষ জজ আদালতের বিচারক ড. আখতারুজ্জামান।
বিচারক তার এজলাসে বসার পর দুদকের আইনজীবী মোশাররফ হোসেন কাজল মামলার কার্যক্রম শুরুর জন্য আদালতের কাছে আবেদন করেন। কারাগারের এ জায়গায় আদালত স্থানান্তরের বিষয়ে গেজেট প্রকাশের বিষয়টিও উল্লেখ করেন।
তিনি বলেন, ‘গেজেট প্রকাশের পর বেগম খালেদ জিয়ার আইনজীবী সানাউল্লাহ মিয়ার বাসায় গেজেটের একটি কপি রাতেই পৌঁছে দিয়েছি। ব্যক্তিগতভাবেও তাদের সঙ্গে কথা বলেছি। কিন্তু তারা আজকে আসেননি। যেহেতু আসামিরা আছেন মামলার কার্যক্রম শুরু করা যায়। এটা প্রকাশ্য আদালত।’
এ সময় ডকে থাকা এ মামলার দুই আসামি জিয়াউল ইসলাম ও মনিরুল ইসলাম খানের সঙ্গে বিচারক কথা বলেন। তাদের আইনজীবীরা কেন আসেননি।
পরে আদালত বলেন, ‘তাহলে এক ঘণ্টা সময় দেই। আইনজীবীরা আসুক।’
এ সময় খালেদা জিয়ার পক্ষে কথা বলার সুযোগ চান ঢাকা আই্নজীবী সমিতির সভাপতি গোলাম মোস্তফা খান।
তিনি বলেন, মাননীয় আদালত আজকে আমি পর্যবেক্ষণ করতে এসেছি। এই মামলায় যারা বিজ্ঞ আইনজীবী আছেন তারা আজকে আসেননি। কারণ গেজেট হয়েছে রাতে। গেজেট সম্পর্কে আমরা ওয়াকিবহাল ছিলাম না। টিভির স্ক্রলে আমরা দেখেছি। আর আমি যখন এখানে এসেছি তখন মোবাইল জমা দিয়ে আসতে হয়েছে। আইনজীবীদের সঙ্গে কোনো যোগাযোগ করারও সুযোগ হয়নি। তাই তারা এখন কে কোথায় আছে সেটা জানি না।
এ সময় তিনি আদালতের অবস্থান নিয়ে বলেন, ‘এখানে এমন একটি জায়গায় আদালত স্থাপন করা হয়েছে। যেখানে মাত্র ৫০ ফিট বাই ২০ ফিট মাপের একটি রুম। এখানে ১০ জনের বসার জায়গা নেই। সার্বিকভাবে আমি বলব কোর্টের পরিবেশগত অবস্থা ভালো নয়। সব আইনজীবী এল এখানে দাঁড়ানোর জায়গা থাকবে না।
তিনি আরও বলেন, ‘বেগম খালেদা জিয়া দেখেন কেমন অসুস্থ। তাকে হুইল চেয়ারে করে আনা হয়েছে। তাই সার্বিক অবস্থা বিবেচনা করে এ মামলাটি বর্তমান অবস্থায় রেখে নতুন তারিখ দিলে ভালো হবে।’
এ সময় বেগম খালেদা জিয়া অসুস্থতার কথা উল্লেখ করে বলেন তিনি আর আসবেন না।
তিনি বলেন, ডাক্তার বলেছেন বেশিক্ষণ পা ঝুলিয়ে বসে থাকতে পারবে না। তাতে পা ফুলে যাবে।
খালেদা জিয়া বলেন, ‘এখানে ন্যায়বিচার নেই। যা ইচ্ছে তাই সাজা দিতে পারেন। যত ইচ্ছে সাজা দিতে পারেন। আমি অসুস্থ। আমি বারবার আদালতে আসতে পারব না। আর এভাবে বসে থাকলে আমার পা ফুলে যাবে। আমার সিনিয়র কোনো আইনজীবী আসেনি। এটা জানলে আমি আসতাম না।’
পরে বিচারক বলেন, ‘কিন্তু এদের জামিনের আবেদন দিতে হবে না?’
তখন এই আইনজীবী বলেন, ‘বর্তমান অবস্থায় রেখে দেওয়ার জন্য আদেশ দিতে পারেন আপনি।’
পরে বিচারক বলেন, ‘তাহলে আমি সিদ্ধান্ত দেই আগামী ১২ এবং ১৩ সেপ্টেম্বর মামলার নতুন তারিখ।’
এর আগে জামিনে থাকা আসামিদের পক্ষে জামিন আবেদন দিতে হবে বলেও উল্লেখ করেন বিচারক। পরে তিনি এসলাস ছেড়ে উঠে যান।
আদালতে দুদকের আইনজীবী মোশাররফ হোসেন কাজলের সঙ্গে মহানগর আদালতের প্রধান পিপি অ্যাডভোকেট আব্দুল্লাহ আবু, হাইকোর্টের ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল এ এম আমিন উদ্দিন মানিক, অতিরিক্ত পিপি শাহ আলম, রিজাউর রহমান রুমেল, তাপস কুমার পাল উপস্থিত ছিলেন।
সারাবাংলা/এজেডকে/একে