।। মেসবাহ শিমুল, সিনিয়র করেসপন্ডেন্ট।।
কালিয়াকৈর, গাজীপুর থেকে ফিরে: ‘কি অপূর্ব বর্ষার দৃশ্য দেখিলাম সেই অরণ্য-প্রান্তরে! মেঘে মেঘে দিগন্তের শৈলমালা নীল, থমকানো কালো বিদ্যুৎগর্ভ মেঘে আকাশ ছাইয়া আছে, ক্বচিৎ পথের পাশের শাল কি কেঁদ শাখায় ময়ূর পেখম মেলিয়া নৃত্যপরায়ণ, পাহাড়ি ঝরণার জলে গ্রাম্য বালক-বালিকা মহা উৎসাহে শাল-কাটির ও বন্য বাঁশের ঘুনি পাতিয়া কুচো মাছ ধরিতেছে, ধূসর শিলাখণ্ডও ভিজিয়া কালো দেখাইতেছে, তাহার ওপর মহিষের রাখাল কাঁচা শালপাতার লম্বা বিড়ি টানিতেছে। শান্তস্তব্ধ দেশ-অরণ্যের পর অরণ্য, প্রান্তরের পর প্রান্তর, শুধুই ঝরণা, পাহাড়ি গ্রাম, মরুম-ছড়ানো রাঙামাটির জমি, ক্বচিৎ কোথাও পুষ্পিত কদম্ব বা পিয়াল বৃক্ষ।’
ভাদ্রের মাঝামাঝি সময়। তাই হয়তো কালিয়াকৈরের জঙ্গলে বিভূতিভূষণ বন্দোপাধ্যায়ের আরণ্যক উপন্যাসের উপরিউক্ত বর্ণনার মিল পাওয়া যাবে না। কেন না সেখানে লবটুলিয়া, নাঢ়া আর ফুলকিয়া বইহার নেই। নেই পাহাড়ি ঝরণা কিংবা বুনো মহিষের দল। কিন্তু কিছুটা হলেও সেখানে এখনো প্রকৃতি রয়েছে। রয়েছে বন-জঙ্গল। তবে এই নির্মল প্রকৃতি কতদিন থাকবে তা নিয়ে প্রশ্ন দেখা দিয়েছে স্থানীয়দের মনে।
স্থানীয়রা বলছেন, দিনে দিনে কমছে এ এলাকার প্রাকৃতিক বনাঞ্চল। গজারি গাছগুলো মেরে ফেলা হচ্ছে পরিকল্পিতভাবে। সেইসঙ্গে ভূমি দস্যুদের দখল আর সরকারি উদ্যোগে আকাশমনির বাগান করায় বিরূপ প্রকৃতি হয়ে উঠছে।
কালিয়াকৈর বন বিভাগের রেঞ্জার এ কে এম আজহারুল ইসলাম জানিয়েছেন সেখানে অংশীদারিত্বমূলক আকাশমনির বাগান রয়েছে মোট ৪১টি। যে গুলো ১০ বছর মেয়াদে সরকারের সঙ্গে চুক্তিতে করা। সরকার গাছের চারা রোপণ করছে আর স্থানীয় জমির মালিক কিংবা যারা দেখাশুনা করছেন। ১০ বছর পর পুরো বাগান কেটে ফেলা হয়। এবং সরকার তিন ভাগের একভাগ আর জমির মালিকরা দুই ভাগ কাঠ পেয়ে থাকেন। যে কাঠ টেন্ডারের মাধ্যমে সরকারই বিক্রি করে থাকে।
স্থানীয় রফিক হোসেন নামের ভ্যানচালক বলেন, এ এলাকার ৪১টি আকাশমনির প্লটের মধ্যে তাদেরও একটি রয়েছে। তিন বছরে তাদের বাগানের আকাশমনি গাছ অনেক বড় হয়েছে। দশ বছর পর বিক্রির সময়ে তারা মোটা অংকের টাকা পাবেন বলে ধারণা করছেন। মূলত দ্রুত বড় হয় বলেই এই গাছ লাগানো হচ্ছে বলে জানান রফিক।
স্থানীয় একটি সূত্র বলছে, কিছু দুস্কৃতিকারী বনের গজারি গাছ মেরে ফেলছে। বন বিভাগের কর্মকর্তাদের চোখ ফাঁকি দিয়ে জঙ্গলের গাছগুলোর গোড়ায় বিষাক্ত কেমিক্যাল ঢালছে এসব দুবৃত্ত। ফলে গাছগুলো মরে যাচ্ছে। তাদের এমন অভিযোগের সত্যতাও পাওয়া গেছে বনের বিভিন্ন স্থানে। বিশেষ করে চন্দ্রা মোড় থেকে সোহাগপল্লী রোডে যেতে যেতে এমন অনেক গজারি গাছ চোখে পড়েছে যেগুলো দাঁড়িয়ে আছে ঠিকই কিন্তু নেই কোনো ডাল-পাতা। কোনো কোনো গাছে বেঁধেছে উইপোকার বাসা।
উইকিপিডিয়ার দেওয়া তথ্য মতে, আকাশমনি- (ইংরেজি: Auri বা Earleaf acacia বা Earpod wattle বা Northern black wattle বা Papuan wattle বা Tan wattle) (Acacia auriculiformis) হচ্ছে Fabaceae পরিবারের একটি দ্রুত বর্ধনশীল গাছ। এটি অস্ট্রেলিয়া, ইন্দোনেশিয়া ও পাপুয়া নিউ গিনির স্থানীয় প্রজাতি। এটি ৩০ মিটার পর্যন্ত লম্বা হতে পারে। আকাশমনির প্রতি কেজিতে ৪৭,০০০ বীজ থাকে।
দ্রুত বৃদ্ধিসম্পন্ন এই বৃক্ষ রাস্তার দুইপার্শ্বে শোভাবর্ধনকারী অ্যাভিনিউ ট্রি হিসেবে লাগানো হয়। কান্তাবর্ণা ঝুলন্ত মঞ্জরির শ্রীতে মুগ্ধ হয়ে রবীন্দ্রনাথ এই গাছের নাম দিয়েছিলেন সোনাঝুরি। সত্যিই সুন্দর এর পুষ্পমঞ্জরি। এই গাছের পাতা অনেকেই দেখেন নাই। এই গাছের যেটাকে আমরা অনেকেই পাতা বলি সেটি আসলে পাতা নয়, এটি মূলত পর্ণবৃন্ত। বোটা যখন রূপান্তরিত হয়ে পাতার মত দেখায় তখন তাকে পর্ণবৃন্ত বলা হয়। এই গাছটি যখন চারা অবস্থায় থাকে তখন এর যৌগিক পাতা দেখা যায়। পরবর্তীতে এর পাতা ঝরে যায়। বয়স্ক গাছে শুধু চর্মবৎ পর্ণবৃন্তই দেখা যায়।
পরিবেশবাদীরা বলছেন, বাংলাদেশের পরিবেশের জন্য বিদেশি এ আকাশমনি গাছ অত্যন্ত ক্ষতিকর।
তারা বলছেন, এই গাছ মাটির গভীর থেকে প্রচুর পানি টেনে নেয়। যার কারণে আশেপাশের অন্য গাছ লাগানো হলে তারা পানির অভাবে বড় হতে পারে না এবং যতটুকু ফলন হওয়ার তার চেয়ে অনেক কম হয়।
আজ শুক্রবার রাজধানীতে এক সংবাদ সম্মেলন করে এই পরামর্শ দেয় বাপা। এ সময় বলা হয়, এই তিনটি গাছের পাতা ও ফুলের রেণু প্রাণীদেহের জন্যও অত্যন্ত ক্ষতিকর। ফলে এসব গাছে পাখিও বাসা বাঁধে না।
২০১৭ সালের ১৯ এক সংবাদ সম্মেলনে বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন- বাপা জানায়, ভূতাত্ত্বিকভাবে এক এক দেশে এক এক রকম ইকোসিস্টেম দেখা যায়। বাংলাদেশের ইকো সিস্টেমের জন্য যে সকল বনজ, ফলজ, ভেষজ ও ঔষধি গাছ থাকার কথা তা আবহমান কাল ধরে ছিল ভরপুর। কিন্তু বর্তমানে এসব গাছ বিলুপ্তির পথে। মানুষ বিদেশি গাছ লাগানোর দিকে ঝুঁকে পড়ছে। যেটা বাংলাদেশের মাটির উর্বরতা, ওজন স্তর নষ্ট, অসহনীয় তাপমাত্রা, জলজ প্রাণীর অভয়াশ্রম নষ্ট, প্রাকৃতিক পরিবেশ বিপর্যয়সহ জীববৈচিত্র্য ধ্বংস করছে। এ সময় আকাশমনিসহ ইউক্যালিপটাস ও ম্যালেরিয়া গাছ না লাগাতে নাগরিকদের প্রতি আহ্বানও জানানো হয় ওই সংবাদ সম্মেলনে।
বাপার সাধারণ সম্পাদক আব্দুল মতিন বলেন, আকাশমনি গাছ অবশ্যই বাংলাদেশের প্রকৃতি ও পরিবেশের জন্য ক্ষতিকর। আপনি যদি গাছ লাগান সেটা অবশ্যই হতে হবে পত্রবৃহৎ ও পাতাবহুল। লাগানো গাছের সঠিক পরিচর্যা নিলে গাছ আপনাকে পরিচর্যা করবে, তীব্র গরমে গাছের নিচে তাপমাত্রা বাইরের তাপমাত্রার চেয়ে ৩-৪ ডিগ্রি কম থাকে। যার নিচে দাঁড়ালে আপনার ঠান্ডা লাগবে।
তিনি আরও বলেন, শুধু গাছ লাগালেই হবে না, সেটা হতে হবে পরিবেশ উপোযোগী। সরকার কেনো পরিবেশবান্ধব গাছ না লাগিয়ে বিদেশি ক্ষতিকর গাছ লাগাচ্ছে এটা আমি বুঝতে পারছি না।
সারাবাংলা/এমএস/এমআই