শনাক্ত হওয়ার ৮ মাসেও ধরা পড়েনি মনজিলের হত্যাকারী
৭ সেপ্টেম্বর ২০১৮ ০৯:১৪
।। উজ্জল জিসান, সিনিয়র করেসপন্ডেন্ট ।।
ঢাকা: রাজধানীর বাড্ডার আফতাব নগরে নিজ ফ্ল্যাটে তরুণ ব্যবসায়ী মনজিল হককে গলা কেটে হত্যার পর আট মাস পেরিয়ে গেলেও পুলিশ এখনও কাউকে গ্রেফতার করতে পারেনি। শুধু তাই নয়, খুনিকে শনাক্ত করার পরও গ্রেফতার করতে পারেনি বাড্ডা থানা পুলিশ।
বাড্ডা থানা পুলিশের একজন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে সারাবাংলাকে বলেন, মনজিল হত্যার ১০ দিনের মাথায় পুলিশ হত্যাকারীকে শনাক্ত করেছিল। মনজিলের সৎ ভাই ইয়াসীন এই হত্যার প্রধান পরিকল্পনাকারী এবং হত্যার দিন সে নিজেও ছুরি চালিয়েছে। হত্যার পর যে চার তরুণ আফতাব নগরের মনজিলের ফ্ল্যাট থেকে বেরিয়ে গিয়েছিল তাদের মধ্যে ইয়াসীন একজন। কিন্তু মামলার বাদী মনজিলের চাচা ফারুক চাননি যে, মনজিলের হত্যাকারী ইয়াসীন পুলিশের হাতে ধরা পড়ুক।
ওই পুলিশ কর্মকর্তা বলেন, মনজিলের চাচা ও সৎ মা পুলিশের কাছে ধরনা দিয়ে বলেছেন, ‘বংশ থেকে এক ছেলে চলে গেছে। আমরা আরেক ছেলেকে হারাতে চাই না। ইয়াসীন ধরা পড়লে নিশ্চিত ফাঁসি হয়ে যাবে। আমাদের বংশ নির্বংশ হয়ে যাবে। আমরা তা চাই না।’ মনজিলের চাচা ও সৎ মায়ের এমন বক্তব্যের কারণেই পুলিশ ইয়াসীনকে গ্রেফতার করেনি।
বাড্ডা থানার ওই কর্মকর্তা আরও বলেন, ‘ইয়াসীনকে জানুয়ারিতে ভারত পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু মাসখানেক আগে আবার ঢাকা চলে এসেছেন। এখন দক্ষিণ বনশ্রীতে পরিবারের সদস্যদের সঙ্গেই থাকছেন। পুলিশ সে খবরও পেয়েছে। মামলাটি বর্তমানে তদন্ত করছে সিআইডি।’ তাই বাড্ডা থানা পুলিশ ইয়াসীনকে গ্রেফতারে ততটা গুরুত্ব দিচ্ছে না বলেও জানান তিনি।
পুলিশ সূত্রে জানা গেছে, মনজিল হত্যার কিছুদিন পর মামলাটি তদন্তের জন্য ডিবিতে পাঠানো হয়। ডিবির কর্মকর্তাদের কাছেও চাচা ফারুক ও মা লায়লা ইয়াসমীন লিপি ধরনা দেন। গোয়েন্দা পুলিশের কর্মকর্তারাও মনজিল হত্যায় ইয়াসীনের জড়িত থাকার প্রমাণ পান।
মনজিল হত্যার এক সপ্তাহের মাথায় ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের এক সহকারী কমিশনার সারাবাংলাকে বলেন, মনজিল হত্যার পর গোয়েন্দারা ইয়াসীনকে খুঁজে না পেলেও হত্যার দুই দিন পর তা চালু হয়। দিন সাতেক পর ওই মোবাইল থেকে মায়ের সঙ্গে তার কথা হয়। সে সময় ইয়াসীনের মা তাকে পরিস্থিতি স্বাভাবিক হওয়ার আগ পর্যন্ত পালিয়ে থাকতে বলেন। ওই গোয়েন্দা কর্মকর্তা জানান, ইয়াসীন যশোর থেকে তার মায়ের সঙ্গে কথা বলেছিল।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে নিহত মনজিলের চাচা ফারুক হোসেন সারাবাংলাকে বলেন, ‘ভাতিজা হত্যার বিচার চাই। কারা, কেন আমার ভাতিজাকে খুন করেছে, তা এখনও জানতে পারিনি। পুলিশও কোনো খোঁজ নিচ্ছে না।’
ইয়াসীনকে না ধরার জন্য পরিবার থেকেই পুলিশকে অনুরোধ করা হয়েছে— সে বিষয়ে জানতে চাইলে ফারুক বলেন, ‘আমরা চাইব না কেন? অবশ্যই চাই, খুনি ধরা পড়ুক। মেয়েটি ধরা পড়েছিল। তাকে কেন ছেড়ে দেওয়া হয়েছে, তা জানি না। ইয়াসীন যে খুন করেছে, তা কে বলেছে? এমনিতে তো বললে হবে না। আর ইয়াসীন খুন করেছে, তা প্রমাণিত হলে অবশ্যই ইয়াসীনের বিচারও চাই।’
ইয়াসীন কোথায় থাকে, সেটা জানেন না এবং তার সঙ্গে অনেকদিন সাক্ষাৎ হয়নি বলেও দাবি করেন ফারুক। মনজিলের ফ্ল্যাটটি এখন কার হেফাজতে আছে, জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘ওর (মনজিল) বাসার চাবি আমার কাছেই আছে। তবে সেখানে যাওয়া হয় না। পুলিশ দুয়েকদিন ওই বাসাতে গিয়েছিল।’
যদিও মনজিলের ফ্ল্যাটে গিয়ে দেলে বিভিন্ন তথ্য। সেখানকার দারোয়ান জানান, মনজিল খুনের সময় অন্য দারোয়ান কাজ করত, তিনি এসেছেন মাস তিনেক আগে। ওই দারোয়ান বলেন, ‘প্রতিমাসে ফ্ল্যাট মালিক সমিতির মিটিংয়ে হাজির হন ফারুক হোসেন। ভবনের মাসিক সার্ভিস চার্জ দিয়ে চলে যান। মাঝে-মধ্যে ফ্লাট খুলেও দেখেন তিনি।’
এদিকে, ইয়াসীনের বিষয়ে জানতে চাইলে তার মা লায়লা ইয়াসমীন লিপি সারাবাংলাকে বলেন, ‘ইয়াসীন কোথায় থাকে, তা জানি না। এক ছেলে খুন হয়েছে, আরেক ছেলেকে খুঁজে পাচ্ছি না। পুলিশও কিছু বলছে না।’
মনজিল হত্যার পেছনে ইয়াসীনের জড়িত থাকা ও ইয়াসীনের পরিবারের সঙ্গে থাকার বিষয়ে জানতে চাইলে লিপি বলেন, ‘ইয়াসীন খুন করেছে, তার প্রমাণ কী? কেউ একজন বললেই হবে? ছেলে কোথায় থাকেন তা জানি না।’
এ প্রসঙ্গে বাড্ডা থানার সেই পুলিশ কর্মকর্তার কাছে আবারও জানতে চাওয়া হলে তিনি বলেন, একজন মা কিভাবে এতটা স্বাভাবিক থাকতে পারে? এক ছেলে খুন হয়েছে, সে অবস্থায় আরেক ছেলেকে খুঁজে না পেলে তো তার স্বাভাবিক থাকার কথা না। অথচ তিনি স্বাভাবিক জীবনযাপন করছেন। এর অর্থ, ইয়াসীনের সঙ্গে তার সার্বক্ষণিক যোগাযোগ রয়েছে। ছেলে বিদেশে কিছুদিন পালিয়ে ছিলেন। এখন দেশেই আছেন।
ডিবি সূত্রে জানা গেছে, মনজিলের নামে থাকা আফতাব নগরের ফ্ল্যাট ও কুমিল্লার হোমনায় প্রায় একশ বিঘা সম্পত্তির লোভে ইয়াসীন খুন করেছে বলে অনেকটাই গোয়েন্দা নিশ্চিত হয়েছে। এখন ইয়াসীনকে গ্রেফতার করতে পারলেই বাকি তথ্য বের হয়ে আসবে। কিন্তু কেন তাকে গ্রেফতার করা হচ্ছে না, তা কেউই বলতে পারছেন না। মামলাটি এখন তদন্ত করছে অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি)।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে সিআইডির তদন্ত কর্মকর্তা আশরাফুল ইসলাম সিআইডির মিডিয়া শাখায় যোগাযোগ করতে বলেন।
সিআইডির মিডিয়া শাখার সহকারী পুলিশ সুপার (এএসপি) শারমিন জাহান বলেন, ঘটনা যাই হোক, মামলা হয়েছে। আসামিকে অবশ্যই গ্রেফতার করা হবে। আর তদন্ত কর্মকর্তার কোনো গাফিলতি থাকলে সেটাও দেখা যাবে।
প্রসঙ্গত, গত বছরের ১২ ডিসেম্বর রাজধানীর বাড্ডার আফতাব নগরে নিজ ফ্ল্যাটে খুন হন তরুণ ব্যবসায়ী মনজিল হক (৩০)। তিনি বাড্ডায় গাড়ি মেরামতের একটি ওয়ার্কশপের মালিক ছিলেন। দুর্বৃত্তরা রশি দিয়ে পা বেঁধে গলা কেটে তাকে হত্যা করে। তার দুই হাতেও ছুরিকাঘাতের চিহ্ন পায় পুলিশ। পুলিশ ওই বাসা থেকে রক্ত মাখা দু’টি ছুরি উদ্ধার করে।
পুলিশ ও প্রতিবেশীরা জানান, ফ্ল্যাটটিতে মনজিল একাই থাকতেন। মাঝে-মধ্যে সেখানে তার বন্ধুরা আড্ডা দিতেন। তার গ্রামের বাড়ি কুমিল্লার হোমনায়। এর ছয় মাস আগে মনজিলের বাবা মাইনুল হক মারা যান। তার বাবা দুই বিয়ে করেছিলেন। এর মধ্যে মনজিল ছিল প্রথম স্ত্রীর একমাত্র সন্তান। দ্বিতীয় স্ত্রীর এক ছেলে ও তিন মেয়ে রয়েছে। মনজিলের বাবা মারা যাওয়ার আগে দু’টি ফ্ল্যাট কিনে একটিতে মনজিলকে থাকতে দেন, অন্যটি দ্বিতীয় স্ত্রীকে দেন।
সারাবাংলা/ইউজে/টিআর