থিসিস নকলের হিড়িক: রাবি শিক্ষার্থীদের ভরসা ফটোকপির দোকান!
৯ সেপ্টেম্বর ২০১৮ ০৮:২৯
।। আবু সাঈদ সজল, রাবি করেসপন্ডেন্ট ।।
রাবি: স্নাতকোত্তর পর্যায়ের শিক্ষার গুরুত্বপূর্ণ একটি ধাপ থিসিস পেপার। কিন্তু এই থিসিস পেপার তৈরিতে অসদুপায় অবলম্বনের অভিযোগ উঠেছে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের বেশ কয়েকজন শিক্ষার্থীর বিরুদ্ধে।
জানা গেছে, আগের ব্যাচগুলোর শিক্ষার্থীদের থিসিস পেপার হুবহু অনুকরণ করে বা আংশিক পরিবর্তন করে নিজের গবেষণা বলে চালিয়ে দিচ্ছেন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের অনেক শিক্ষার্থী। এতে একদিকে গুরুত্ব হারাচ্ছে গবেষণা কার্যক্রম, অন্যদিকে এর নেতিবাচক প্রভাব বিশ্ববিদ্যালয়ের সার্বিক শিক্ষা ব্যবস্থার ওপর পড়ছে বলে মত দিচ্ছেন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, বিশ্ববিদ্যালয় আইন বিভাগের ২০১০-১১ শিক্ষাবর্ষের স্নাতকোত্তর পর্যায়ে প্রায় ১০ জন শিক্ষার্থীর বিরুদ্ধে থিসিস জালিয়াতির অভিযোগ ওঠে। বিষয়টি দায়িত্বপ্রাপ্ত সুপারভাইজারের চক্ষুগোচর হলে ওই শিক্ষাবর্ষের সব শিক্ষার্থীর ফল দিতে আপত্তি জানান শিক্ষকরা। পরে দ্বিতীয়বার থিসিস করার শর্তে ক্ষমা করা হয় তাদের। এর আগে, বিশ্ববিদ্যালয়ের ফলিত গণিত বিভাগের ২০০৭-০৮ শিক্ষাবর্ষের এক শিক্ষার্থীর বিরুদ্ধেও থিসিস নকলের অভিযোগ ওঠে।
শিক্ষার্থীরা বলছেন, সময় স্বল্পতা ও মার্কস কম থাকায় গবেষণায় খুব একটা গুরুত্ব দেন না অনেক শিক্ষার্থীই। আর দশটা অ্যাসাইনমেন্টের মতোই থিসিসের কাজ শেষ করেন তারা। সে কারণেই ফটোকপির দোকান বা বিভাগের সিনিয়র শিক্ষার্থীদের গবেষণাপত্র পুরোটা বা আংশিক অনুকরণ করেই তারা থিসিস পেপার তৈরি করেন। আবার শিক্ষকদের তদারকির অভাবে গবেষণাপত্রে কী কী বিষয় থাকবে, সে বিষয়ে অনেক শিক্ষার্থীই ঠিকমতো জানেন না।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক কয়েকজন শিক্ষার্থী অভিযোগ করে বলেন, গবেষণা কী, সে বিষয়ে জানেন না অনেকেই। তবে শিক্ষকদের দাবি, অধিকাংশ শিক্ষার্থীই গবেষণার জন্য পরিশ্রম করতে চান না। তাই গবেষণায় জালিয়াতির আশ্রয় নেন তারা।
এ বিষয়ে বিশ্ববিদ্যালয় আইন অনুষদের ডিন আবু নাসের মো. ওয়াহিদ সারাবাংলাকে বলেন, ‘অনেক ক্ষেত্রে শিক্ষকদের দেওয়া টপিক পরিবর্তন করেন শিক্ষার্থীরা। ক্লাস অ্যাসাইনমেন্টের মতো কিছু একটা মনে করেন অনেকে। তাছাড়া ঢালাওভাবে মাস্টার্সের সব শিক্ষার্থীর ওপর থিসিসও অনেক ক্ষেত্রে প্রভাব ফেলে।’
এদিকে, একই বিষয়ে দ্বিতীয়বার গবেষণা হওয়ার বিষয়টিও উল্লেখ করেন অনেক গবেষক। এ প্রসঙ্গে গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের সাবেক সভাপতি ড. প্রদীপ কুমার পান্ডে সারাবাংলাকে বলেন, ‘একই বিষয়ে বারবার গবেষণা হলে শিক্ষার্থীরা আগের গবেষণা থেকে অনুকরণ করার সুযোগ পান। গবেষণাজাতীয় সব কাজে এভাবে অনুকরণ করেন তারা।’
গবেষণা জালিয়াতি বন্ধের বিষয়টি উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘বর্তমানে বিভিন্ন প্রযুক্তি এসেছে, যা দিয়ে গবেষণা জালিয়াতি হচ্ছে কি হচ্ছে না, সেটা পরীক্ষা করা যায়— সেটা ইংরেজি হোক বা বাংলা। বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন যদি বিশ্ববিদ্যালয়ে বা বিভাগ পর্যায়ে এসব প্রযুক্তি সরবরাহ করেন এবং সেগুলো নিজস্ব তত্ত্বাবধায়নে রাখেন, তাহলে হয়তো গবেষণা জালিয়াতি রোধ করা সম্ভব।’
বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন স্থানে আগের গবেষণাপত্রের সহজলভ্যতাকেও দায়ী করেন অনেকে। খোঁজ নিয়ে জানা যায়, পুরনো গবেষণাপত্রগুলো শিক্ষার্থীরা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফটোকপির দোকানগুলো থেকে সংগ্রহ করছেন। সর্বনিম্ন ৩শ টাকাতে বিক্রি হয় এসব গবেষণাপত্রের সফট কপিও। চাহিদার সঙ্গে গবেষণাপত্র মিলে গেলে টাকা বাড়তে থাকে। সেক্ষেত্রে ৫শ টাকা বা অনেক ক্ষেত্রে হাজার টাকায় বিক্রি হয় একেকটি গবেষণাপত্র।
অনুসন্ধানে জানা যায়, থিসিসের পুরাতন কপি বিশ্ববিদ্যালয় স্টেডিয়াম মার্কেট ও পরিবহন মার্কেটের দোকানগুলো থেকে সংগ্রহ করেন শিক্ষার্থীরা। এরকম ১৪ থেকে ১৫টি দোকানে পুরনো গবেষণাপত্রগুলো পাওয়া যায়। এর মধ্যে কিছু কিছু দোকানে গিয়ে গোপনে সন্ধান করতে হয় পুরনো গবেষণাপত্রের। আর কোনো কোনো দোকানের সামনে রীতিমতো বড় বড় অক্ষরে ছাপানো নোটিশ থাকে— ‘এখানে পুরনো থিসিস পেপার পাওয়া যায়’!
কয়েকটি দোকানে খোঁজ নিয়ে জানা যায়, থিসিস পেপারের ক্যাটালগ রয়েছে তাদের কাছে। তথ্যের প্রয়োজনে এ প্রতিবেদক একটি দোকানে গিয়ে জানতে চান, পুরনো থিসিস পেপার পাওয়া যাবে কিনা। জানতে চাইলেই জবাব, ভেতরে আসুন। কোন বিষয়ের থিসিস পেপার লাগবে? ক্যাটালগ আছে, শিরোনাম দেখে খুঁজে নিন। চাইলে হার্ড কপি ছাড়া সফট কপিও পাওয়া যাবে।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, থিসিস গবেষণা রয়েছে এমন প্রায় সব বিভাগেই গবেষণা জালিয়াতি হয়ে থাকে। এর মধ্যে বিজ্ঞান অনুষদ ও ব্যবসায় শিক্ষা অনুষদের থিসিস পেপারগুলো বেশি সরবরাহ হয় এই দোকানগুলো থেকে। শিক্ষার্থীরা চার্ট ও পরিসংখ্যানগত কিছু পরিবর্তন করে পুরনো গবেষণাপত্রগুলোকে নতুন করে উপস্থাপন করে থাকেন। কোনো কোনো সময় চার্টের ধরন পাল্টে দেন কেবল। এভাবে হাতের কাছেই পুরনো গবেষণাপত্র পেয়েই গবেষণা না করে দোকানগুলো থেকে পাওয়া গবেষণাপত্র দিয়েই কাজ মিটিয়ে নেন শিক্ষার্থীরা।
এমন জালিয়াতি হলেও কোনো পদক্ষেপ নেওয়া হচ্ছে কি না— সে বিষয়ে জানতে চাইলে বিশ্ববিদ্যালয় প্রধান পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক প্রফেসর ড. মো. বাবুল ইসলাম বলেন, ‘যদি মাস্টার্সের থিসিস জালিয়াতির প্রমাণ পাওয়া যায়, তাহলে ওই শিক্ষার্থীর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হয়। সেক্ষেত্রে কমপক্ষে একবছর বহিষ্কারের আইন আছে।’
এদিকে গবেষক তৈরির প্রথম ধাপেই জালিয়াতির আশ্রয় নিয়ে গবেষণা হলে ভবিষ্যতে উন্নত গবেষণা বা নতুন জ্ঞান আদৌ তৈরি হবে কিনা, সে বিষয়ে উদ্বেগ জানিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের ইমেরিটাস অধ্যপক এ কে এম ইয়াকুব আলী সারাবাংলাকে বলেন, ‘গোটা জাতি একটি খারাপ অব্স্থা পার করছে, যার প্রভাব সমাজে এরই মধ্যে দৃশ্যমান। শিক্ষা খাতও তার ব্যতিক্রম নয়। বিশ্ববিদ্যালয়ে স্নাতকোত্তর পর্যায়েই এমন সস্তা গবেষণায় প্রকৃত জ্ঞান তলানিতে পড়ে যাচ্ছে। জ্ঞানের মূল্য কমে যাচ্ছে।’
বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের (ইউজিসি) সদস্য অধ্যাপক ড. দিল আফরোজ বেগম বলেন, ‘উচ্চ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে এটা কাম্য নয়। জাতির জন্য এটা খুবই হতাশাজনক। তবে আমাদের দেশের টপ-টু-বটম যদি দুনীতিগ্রস্ত হয়, তাহলে বিশ্ববিদ্যালয় তো আলাদা জায়গা নয়। সেই প্রভাব আমাদের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানেও একটু পড়বে, এটা অস্বাভাবিক নয়।’ উপাচার্যদের নিয়ে মঞ্জুরি কমিশনের বৈঠকে এ বিষয়টি আলোচনা করা হবে বলে আশ্বস্ত করেন তিনি।
সারাবাংলা/টিআর