হিজড়া বাকীর বদলে যাওয়ার গল্প
৯ সেপ্টেম্বর ২০১৮ ০৮:৫৮
।। সোহেল রশীদ, ডিস্ট্রিক্ট করেসপন্ডেন্ট ।।
রংপুর: আবদুর রহমান বাকী। তার শৈশব আর দশটা ছেলে শিশুর মতো ছিল না। মেয়ে শিশুদের সঙ্গে পুতুল খেলা নিয়েই কাটে তার শৈশব। কৈশোরে সঙ্গী হন যাত্রাদলের। পরিবারের বাধা উপেক্ষা করে যাত্রাদলে অভিনয় করতেন মেয়ে চরিত্রে। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে পরিবর্তন আসে বাকীর আচার-আচরণে। পরিবর্তন হয় শারীরিক গঠনেরও। কেবল সমাজ নয়, পরিবার থেকেও মিলতে থাকে গঞ্জনা। ঘর ছাড়তে বাধ্য হন বাকী। হয়ে ওঠেন সমাজের কাছে উপহাসের পাত্র তৃতীয় লিঙ্গের মানুষ হিজড়া হিসেবে। তবে নিজের এই পরিচয়কে চ্যালেঞ্জ হিসেবে নেন বাকী। নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করার তীব্র আকাঙ্ক্ষা থেকে উপজেলা স্টাফ কোয়ার্টারে কিছুদিন ঝাড়ুদারের কাজ করেছেন। এখন হোটেল দিয়ে নিজেই অন্যদের কর্মসংস্থানের সুযোগও তৈরি করেছেন।
তৃতীয় লিঙ্গের আবদুর রহমান বাকী রংপুরের পীরগঞ্জ উপজেলার বাসিন্দা। পীরগঞ্জ সদর ইউনিয়নের গঙ্গারাম গ্রামের মৃত আবদুল জলিলের ছেলে তিনি। পিতাহারা পরিবারের দুই ছেলে ও তিন মেয়ের মধ্যে বাকী সবার বড়। হিজড়া হিসেবে বেড়ে উঠে একসময় পরিবার ছাড়তে হলেও পরে নিজের যোগ্যতাতেই পরিবারকে দিয়েছেন অবলম্বন।
হিজড়া শব্দের বেড়াজালে থাকা অবহেলিত বাকী অন্য হিজড়াদের মতো নয়। কিছু করার সুযোগ না পেয়ে অনেক হিজড়াই যখন অন্যদের জিম্মি করে উপার্জনের পথ খোঁজেন, তখন বাকীর মনে ছিল কিভাবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করা যায়। কাউকে জিম্মি টাকা নেওয়াটাকে খারাপ মনে হতো বাকীর চোখে। তাই কাজ খুঁজতে থাকেন তিনি। একসময় নিজের গ্রাম ছেড়ে পাড়ি জমান রংপুর শহরে। পীরগঞ্জ সদর উপজেলা সরকারি স্টাফ কোয়ার্টারে ঝাড়ুদারের কাজ পান। তার ব্যবহারে মুগ্ধ সরকারি কর্মকর্তারা তাকে দিয়ে রান্নার কাজও করান। এভাবেই সরকারি স্টাফ কোয়ার্টারে ১৮টি বছর কাটে বাকীর। ওই সময়ে পরিবারের একমাত্র উপার্জনকারী হয়ে ওঠেন তিনি।
তবে এর মধ্যেও নিজের কিছু করার ইচ্ছাটা ছিল তার। সেই ইচ্ছা থেকেই বাকী পীরগঞ্জ কলেজ রোডে শুরু করেন হোটেল ব্যবসা। হোটেলের নাম দিয়েছেন ‘আদর-সোহাগ হোটেল’। সেখানে চার জনের কর্মসংস্থান হয়েছে। প্রতিদিন তাদেরকে ১২শ টাকা করে হাজিরা দেন। ছয় বছরেরও বেশি সময় ধরে সেই হোটেলের সেবাতেও মুগ্ধ স্থানীয়রা।
অর্থনৈতিকভাবে সাবলম্বী বাকী এখন মডেল। কাজ দিয়ে মানুষের মন জয় করা বাকী এরই মধ্যে কৃষি জমি কিনেছেন গ্রামে। নিজের উপার্জিত টাকায় বিয়ে দিয়েছেন ছোট ভাই-বোনদের।
পীরগঞ্জের কলেজ রোডে কবি হেয়াত মামুদ কিন্ডার গার্টেনের সামনে ‘আদর-সোহাগ হোটেলে’ কথা হয় বাকীর সঙ্গে। ৪৮ বছর বয়সী বাকী জানান, সরকারি স্টাফ কোয়ার্টারে কাজ করার সময় কর্মকর্তাদের কাপড় ধোয়ার কাজ করে দিতেন। কর্মকর্তারা খুশি হলে মাঝেমধ্যে দুয়েকশ টাকা দিতেন। সামান্য বেতনের সঙ্গে এই বখশিশটুকু দিয়ে অনেক কষ্টে দিন কাটাতে হতো তাকে। এর মধ্যেও সময় পেলে প্রায়ই ছুটে যেতেন মঞ্চে।
বাকী বলেন, ‘আমি পরিবার ও সমাজের বোঝা হইনি। জীবনের সঙ্গে সংগ্রাম করেছি। সামান্য বেতনে সরকারি স্টাফ কোয়ার্টারে কাজ করে নিজেকে বদলে নিয়েছি। সামান্য বেতন থেকেও সাহায্য করেছি পরিবার-পরিজনকে। হিজড়াদের সবাই অবহেলা করলেও আমি চেষ্টা করেছি আমাদের সম্পর্কে মানুষের মনোভাব বদলাতে। আমার সেই চেষ্টা অনেকটাই সফল।’ বর্তমানে হিজড়াদের জন্য সরকারের দেওয়া ভাতা সুবিধা পাচ্ছেন বলে জানান তিনি।
এদিকে, বাকীর হোটেল খাবার খেতে আসা পল্লী বিদুৎ সমিতির পীরগঞ্জ জোনাল অফিস কর্মচারী ইয়াজুল হক বলেন, প্রতিদিন একবেলা হলেও এখানে আমি খেতে আসি। হোটেলের পরিবেশ ও রান্না মানসম্মত। এখানে পীরগঞ্জের বেশিরভাগ সরকারী কর্মকর্তা-কর্মচারীরা দুপুরের খাবার খেতে আসেন। বাকী তার আচরণ আর কঠোর পরিশ্রম দিয়ে সবার মন জয় করে নিয়েছেন।
সারাবাংলা/টিআর