Friday 22 Nov 2024
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

দিনে আত্মহত্যা ২৮ জনের, গ্রামে ও নারীদের মধ্যে প্রবণতা  বেশি!


১০ সেপ্টেম্বর ২০১৮ ০৮:৩১

।। জাকিয়া আহমেদ, স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট ।।

ঢাকা : রাজধানীর নারিন্দা শরৎগুপ্ত রোডে গত ২ সেপ্টেম্বর গলায় ফাঁস দিয়ে আত্মহত্যা করেন গৃহবধূ অর্থি দাস (২৫)। পুলিশ সূত্রে জানা যায়, স্বামীর সঙ্গে অভিমান করে ঘরের দরজা বন্ধ করে ফ্যানের সাথে গলায় ওড়না পেঁচিয়ে ফাঁস দেন তিনি।

একইদিন রাজধানীর যাত্রাবাড়ী সুতিখালপাড় এলাকায় আনিকা আক্তার (১৭) নামে এক কলেজছাত্রী গলায় ফাঁস দিয়ে আত্মহত্যা করেন। সকাল ৬টার দিকে তাকে উদ্ধার করে মুমূর্ষু অবস্থায় স্থানীয় একটি হাসপাতালে নেওয়া হয়। সেখান থেকে তাকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতালে নিয়ে এলে চিকিৎসকরা তাকে মৃত বলে ঘোষণা করেন।

এর আগে, গত ৩১ আগস্ট হবিগঞ্জের মাধবপুরে নিজের দুই সন্তানকে গলা কেটে হত্যা করার পর আত্মহত্যা করেন মা। পুলিশের দাবি, দুই সন্তানকে হত্যার পর মা নিজে ঘরের সিলিং ফ্যানের সঙ্গে ফাঁস লাগিয়ে আত্মহত্যা করেছেন।

পুলিশ সদর দফতর ও জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটের হিসাব অনুযায়ী, দেশে প্রতিদিন গড়ে ২৮ জন আত্মহত্যা করেন। সে হিসেবে প্রতিবছর বাংলাদেশে প্রায় ১০ হাজার মানুষ আত্মহত্যার পথ বেছে নেন। অন্যদিকে, বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থা থেকে জানা যায়, পৃথিবীতে যত মানুষ আত্মহত্যার মাধ্যমে মানুষ মৃত্যুবরণ করেন তার মধ্যে ২ দশমিক ০৬ শতাংশ বাংলাদেশি। প্রতিবছর দেশে প্রতি লাখে ৭ দশমিক ৮ শতাংশ মানুষ আত্মহত্যা করেন।  প্রতিবছর এ সংখ্যা বেড়েই চলেছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার প্রতিবেদন অনুযায়ী, আত্মহত্যা প্রবণতার ক্ষেত্রে বাংলাদেশর অবস্থান বিশ্বে দশম।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন, পারিবারিক নির্যাতন, পরীক্ষা ও প্রেমে ব্যর্থতা, দারিদ্র, বেকারত্ব, অস্থিরতা, মাদকাসক্তি, নৈতিক অবক্ষয়সহ নানা কারণে মানুষ আত্মহত্যার পথ বেছে নিচ্ছে।

বিজ্ঞাপন

সোমবার (১০ সেপ্টেম্বর) আন্তর্জাতিক আত্মহত্যা প্রতিরোধ দিবস। দিবসটি উপলক্ষে বিশ্বজুড়ে নানা পদক্ষেপ নিয়েছে  ইন্টারন্যাশনাল অ্যাসোসিয়েশন ফর সুইসাইড প্রিভেনশন ( আইএএসপি)। দিবসটির এবারের প্রতিপাদ্য ‘লেটস ওয়ার্ক টুগেদার ফর প্রিভেন্ট সুইসাইড’ বা ‘আত্মহত্যা প্রতিরোধে কাজ করি একসঙ্গে’। সম্প্রতি বাংলাদেশে আত্মহত্যার প্রবণতা বেড়ে যাওয়াতে আইএএসপি বাংলাসহ ৭১টি ভাষায় এবারের প্রতিপাদ্যের ব্যানার তৈরি করেছে।

বাংলাদেশ সেন্টার ফর ইনজুরি প্রিভেনশন অ্যান্ড রিসার্চের প্রতিবেদনে পাওয়া গেছে, আঘাতজনিত সব ধরনের মৃত্যুর শীর্ষে রয়েছে আত্মহত্যা। এর মধ্যে প্রতিদিন ৬৬ জন আত্মহত্যা করে বলে জরিপে বলা হয়েছে। ২০০৩ ও ২০১৬ সালে তারা এ সম্পর্কিত দু’টি জরিপ চালানো হয়। যেখানে দেখা যায়, ১৭ বছর নিচের বয়সীদের মধ্যে ২০০৩ সালে যেখানে প্রতিদিন ছয় জন আত্মহত্যা করলেও ২০১৬ সালে এই সংখ্যা দাঁড়ায় ২৬ জন। অন্যদিকে, ১৮ বছরের ওপর প্রতিদিন আত্মহত্যা করেন ৪০ জন এবং আত্মহত্যার চেষ্টা করেন ৪৪ জন।

এর মধ্যে ১৫ থেকে ১৭ বছর বয়সীদের মধ্যে আত্মহত্যার হার শতকরা ৪৪ দশমিক ০৯, ১০ থেকে ১৪ বছর বয়সীদের মধ্যে শতকরা ২৮ দশমিক আট, ১৮ বছর থেকে ২৪ বছর বয়সীদের মধ্যে ২৪ দশমিক তিন, ২৫ থেকে ৩৯ বছর বয়সীদের মধ্যে ১৩ দমশিক সাত, ৪০ থেকে ৫৯ বছর বয়সীদের মধ্যে তিন দশমিক চার এবং ৬০ বছর বয়সীদের মধ্যে ২১ দশমিক ০৯ শতাংশ মানুষ আত্মহত্যা করে।

জরিপে পাওয়া যায়, শহরের চেয়ে গ্রামে আত্মহত্যার হার ১৭ গুণ বেশি। গ্রামে যারা আত্মহত্যা করেন, তাদের বড় অংশ অশিক্ষিত এবং দরিদ্র। জরিপে বলা হয়, নারীদের মধ্যে আত্মহত্যার প্রবণতা সবচেয়ে বেশি। এদের মধ্যে ১০ থেকে ১৯ বছর বয়সি নারীরা সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ।

বিজ্ঞাপন

ইন্টারন্যাশনাল অ্যাসোসিয়েশন ফর সুইসাইড প্রিভেনশন (আইএএসপি), ওয়ার্ল্ড হেলথ অর্গানাইজেশন (ডব্লুএইচও) এবং ওয়ার্ল্ড ফেডারেশন ফর মেন্টাল হেলথের (ডাব্লুএফএমএইচ) সহযোগিতায় বিশ্ব আত্মহত্যা প্রতিরোধ দিবস আয়োজন করা হয়ে থাকে।

পুলিশ সদর দফতর ও বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার তথ্য থেকে জানা যায়, দেশে আত্মহত্যাকারীদের বেশিরভাগেরই বয়স ২১ থেকে ৩০ বছরের মধ্যে। অন্যদিকে জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটের তথ্যানুযায়ী, দেশে চুয়াডাঙ্গা, ঝিনাহদহসহ দেশের দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলে মানুষের মধ্যে আত্মহত্যার প্রবণতা বেশি।

যদি সঠিকভাবে একজন আত্মহত্যাপ্রবণ ব্যক্তিকে শনাক্ত করা যায়, তাহলে তার চিকিৎসা করানো সম্ভব বলে জানান বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের মনোরোগবিদ্যা বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ডা. সালাহউদ্দিন কাউসার বিপ্লব।

তিনি সারাবাংলাকে বলেন, বিষন্নতা, সবকিছু সম্পর্কে নেতিবাচক মনোভাব, নিজেকে নিয়ে নেতিবাচক মনোভাবে এবং নিজেকে হেয় ভাবা, নিজেকে ভালো না বাসা, বেঁচে থাকার ইচ্ছা না থাকা— এ ধরনের কোনো অনুভূতি জন্ম নিলেই বিশেষজ্ঞের সঙ্গে কথা বলা উচিত। ব্যক্তি, পারিবারিক বা সামাজিক পর্যায়েও আত্মহত্যার কারণ অনুসন্ধান করে শনাক্ত করে প্রতিরোধের ব্যবস্থা নিতে হবে। চিকিৎসা করাতে হবে এবং অন্য কোনো সংকট তৈরি হলে সেখান থেকে তাবে বের করে আনতে হবে।

আত্মহত্যাকে ‘নম্বর ওয়ান প্রিভেন্টেবল ডেথ’ বলা হয় উল্লেখ করে অধ্যাপক ডা. সালাহউদ্দিন কাউসার বিপ্লব বলেন, যে মৃত্যুকে একমাত্র ঠেকানো সম্ভব, সেটাই হলো আত্মহত্যা। তাই এটাকে গুরুত্ব দিতে হবে। কেননা, একজন আত্মহত্যা করলে কেবল তিনিই চলে যান না, তার পুরো পরিবারকে এজন্য ভোগান্তির মধ্যে দিয়ে যেতে হয়। তাই আত্মহত্যার মতো ‍মৃত্যু প্রতিরোধ করা খুবই জরুরি।

অন্যদিকে জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটের ‘শিশুবর্ধন ও পারিবারিক সম্পর্ক’ বিভাগের সহকারী অধ্যাপক ডা. হেলালউদ্দিন আহমেদ সারাবাংলাকে বলেন, মানুষ অতি তুচ্ছ কারণেও এখন আত্মহত্যার পথ বেছে নিচ্ছেন এবং আত্মহত্যার ধরন বদলেছে।

তিনি আরও বলেন, ‘ভারতীয় উপমহাদেশসহ এশিয়ার দেশগুলোতে পুরুষদের চেয়ে নারীদের আত্মহত্যার প্রবণতা বেশি। এ কারণে প্রতিপাদ্য অনুযায়ী নারী-পুরুষ একসঙ্গে কাজ করতে হবে এবং নারীদের ক্ষমতায়ন খুব বেশি জরুরি। বিভিন্ন গবেষণায় দেখা গেছে, নারী ক্ষমতায়ন হলে তাদের মধ্যে আত্মহত্যার প্রবণতা কমে যায়। একইসঙ্গে আত্মহত্যার ইচ্ছা, মৃত্যু চিন্তা যারা করেন, তারা যদি কোনো কারণে এসব প্রকাশ করেন, সেটিকেও হালকাভাবে দেখার সুযোগ নেই।’ এ ধরনের ক্ষেত্রে গুরুত্ব দিয়ে বিবেচনা করে সে অনুযায়ী ব্যবস্থা নিতে হবে বলে মন্তব্য করেন ডা. হেলাল উদ্দিন আহমেদ।

সারাবাংলা/জেএ/জেডএফ

আত্মহত্যা জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউট

বিজ্ঞাপন

আরো

সম্পর্কিত খবর