‘ডোন্ট ডিস্টার্ব আ.লীগ’ থিওরিতে জামায়াত এখন দ্বিগুণ শক্তিশালী!
১০ সেপ্টেম্বর ২০১৮ ২১:৪১
।। রমেন দাশগুপ্ত, স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট ।।
চট্টগ্রাম ব্যুরো: গত চার বছরে বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের বিরোধিতাকারী জামায়াত ও তাদের ছাত্র সংগঠন ছাত্রশিবির চট্টগ্রাম নগরীতে অন্তত ২০ হাজার প্রশিক্ষিত কর্মী বা ক্যাডার তৈরি করেছে। মূল দল জামায়াতের তত্ত্বাবধানে চলতি বছরে কেবল চট্টগ্রাম নগরীতেই আরও ১৩ হাজার প্রশিক্ষিত কর্মী বা ক্যাডার তৈরির পরিকল্পনা নিয়ে কাজ করে যাচ্ছে। সব মিলিয়ে এই চার বছরে তারা দ্বিগুণ সাংগঠনিক শক্তি অর্জন করেছে। আর এর পেছনে কাজ করছে জামায়াত-শিবিরের ‘ডোন্ট ডিস্টার্ব আওয়ামী লীগ’ নীতি।
সম্প্রতি নগর গোয়েন্দা পুলিশ এবং কোতোয়ালি ও সদরঘাট থানা পুলিশ জামায়াতের চট্টগ্রামের শীর্ষ নেতা ও সাবেক সংসদ সদস্য শাহজাহান চৌধুরীসহ কয়েকজন গুরুত্বপূর্ণ নেতা ও কর্মীকে গ্রেফতারের পর এসব তথ্য পেয়েছে পুলিশ। চট্টগ্রাম নগর পুলিশ (সিএমপি) থেকে এসব তথ্য এরই মধ্যে প্রতিবেদন আকারে পুলিশ সদর দফতরে পাঠানো হয়েছে বলে সূত্র জানিয়েছে।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, টানা পাঁচ বছর সহিংস রাজনৈতিক কর্মসূচি পালনের পর ২০১৫ সাল থেকে ‘ডোন্ট ডিস্টার্ব আওয়ামী লীগ’ নীতি নেয় জামায়াত ও তাদের ক্যাডারভিত্তিক সংগঠন শিবির। এই নীতি নেওয়ার পর থেকে রাজপথে সক্রিয় উপস্থিতি ছিল না তাদের। ফলে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ধরপাকড় এড়াতে সক্ষম হন দলটির নেতাকর্মীরা। কিন্তু ভেতরে ভেতরে সংগঠিত হওয়া অব্যাহত রাখে দলটি। তাতে ফলও মেলে, সাংগঠনিকভাবে শক্তিশালী হয়ে ওঠে জামায়াত-শিবির।
নগর পুলিশের অতিরিক্ত কমিশনার (অপরাধ ও অভিযান) আমেনা বেগম সারাবাংলাকে বলেন, ‘জামায়াত-শিবির আবারও সংগঠিত হয়েছে বলে তথ্য আমরা বিভিন্ন সূত্র থেকে পাচ্ছি। এ বিষয়ে আমরা আরও তথ্য সংগ্রহ করছি। এরই মধ্যে জামায়াত-শিবিরের লিডিং পর্যায়ে যারা আছে, তাদের বিষয়ে অনেক তথ্য পেয়েছি। তাদের যেকোনো ধরনের নাশকতামূলক কর্মকাণ্ড প্রতিরোধে আমরা সক্রিয়।’
একাত্তরের মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে জামায়াতের শীর্ষ নেতাদের বিচার শুরুর প্রাথমিক পর্যায় ২০১১ সাল থেকে পুলিশের ওপর হামলা, গাড়ি পোড়ানো, পেট্রল বোমা হামলাসহ ধ্বংসাত্মক কর্মসূচি পালন শুরু করেছিল জামায়াত-শিবির। ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির নির্বাচন ঠেকানো এবং ২০১৫ সালে লাগাতার অবরোধের সময়ও ধ্বংসাত্মক কর্মকাণ্ড চালিয়ে যায় দলটি।
তবে জামায়াত-শিবিরের সহিংসতার বিরুদ্ধে পাঁচ বছর তাদের মোকাবিলায় পুলিশসহ আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীও ছিল মাঠে সক্রিয়। জামায়াত-শিবিরের ক্যাডারদের ধরতে নিয়মিত চালানো হতো অভিযান। ২০১৫ সালে জামায়াত-শিবির রাজপথ থেকে সরে যায়। স্বাধীনতা দিবস, বিজয় দিবসসহ কয়েকটি দিবসভিত্তিক কর্মসূচি ছাড়া তাদের আর রাজপথে দেখা যায়নি।
রাজনৈতিক বিশ্লেষক ও ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউশন চট্টগ্রাম কেন্দ্রের সাবেক সভাপতি দেলোয়ার মজুমদার সারাবাংলাকে বলেন, “জামায়াত-শিবির ‘ডোন্ট ডিস্টার্ব আওয়ামী লীগ’ নীতি নিয়েছিল। আওয়ামী লীগের দ্বিতীয় মেয়াদে মনে হয়েছে, তারাও ‘ডোন্ট ডিস্টার্ব জামায়াত-শিবির’ নীতি নিয়েছে। কারণ যুদ্ধাপরাধীদের বিচার ছাড়া সবক্ষেত্রে আওয়ামী লীগকে মুক্তিযুদ্ধের চেতনার পরিপন্থী সাম্প্রদায়িক শক্তির সঙ্গে আপস করতে দেখা গেছে। এই আপসের মেসেজ গেছে প্রশাসনের কাছে। সুতরাং তারাও রাষ্ট্রবিরোধী এই শক্তিকে মোকাবিলায় ততটা তৎপর ছিল না।”
‘এর ফাঁকে একাত্তরের পর জামায়াত ও ইসলামী ছাত্রসংঘ যেভাবে আন্ডারগ্রাউন্ডে থেকে সংগঠিত হয়েছিল এবং সুযোগ বুঝে বেরিয়ে এসেছিল, এখনও সেভাবেই সংগঠিত হয়েছে এবং নির্বাচনকে সামনে রেখে বেরিয়ে আসার চক্রান্ত করছে। আশা করি, বঙ্গবন্ধুর দল আওয়ামী লীগ তাদের সেই সুযোগ দেবে না। এই সুযোগ জামায়াত-শিবির পেলে দেশ ও জাতির ভয়াবহ ক্ষতি হবে,’— বলেন দেলোয়ার মজুমদার।
পুলিশ সূত্রে জানা গেছে, গত ২৪ জুন চট্টগ্রাম নগরীর মোটেল সৈকতে ঈদ পুর্নমিলনী অনুষ্ঠান থেকে জামায়াত-শিবিরের ২১০ নেতাকর্মীকে গ্রেফতার করে পুলিশ। গত ৩ আগস্ট খুলশীতে একটি গোপন বৈঠক থেকে শাহজাহান চৌধুরীসহ ছয় জনকে গ্রেফতার করে নগর গোয়েন্দা পুলিশ। এরপর গত ৩ সেপ্টেম্বর সদরঘাট ও বাকলিয়া থানায় অভিযান চালিয়ে ১৩ জনকে আটক করে পুলিশ।
সদরঘাট থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মো. নেজাম উদ্দিন সারাবাংলাকে বলেন, আমার থানায় আটক হওয়া ১৩ জনকে প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ তথ্য পেয়েছি। জামায়াতের তত্ত্বাবধানে শিবির ব্যাপক সাংগঠনিক শক্তি অর্জন করেছে। রাজপথে না থাকলেও তাদের ঘরোয়া রাজনীতি বন্ধ ছিল না। টেলিগ্রাম, ফেসবুকসহ বিভিন্ন মোবাইল অ্যাপ ব্যবহার করে তারা সাংগঠনিক সম্মেলন পর্যন্ত করেছে। ঘরোয়া বৈঠকগুলোর খবরও তারা দেয় টেলিগ্রামের মাধ্যমে। চেতনা-৭১, মুক্তিযুদ্ধের বাংলাদেশ— এ ধরনের বিভিন্ন নামে তারা ফেসবুক গ্রুপ-উপগ্রুপ তৈরি করে। সেই গ্রুপের মাধ্যমে নিজেরা যোগাযোগ করে।
কোতোয়ালি থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মোহাম্মদ মহসিন সারাবাংলাকে বলেন, রিমান্ডে জিজ্ঞাসাবাদে তারা জানিয়েছে, দিবসভিত্তিক কর্মসূচি তারা পালন করে কেবল নিজেদের অবস্থান জানান দেওয়ার জন্য। ২০১৫ সাল থেকেই তারা ঘরোয়া রাজনীতির মাধ্যমে সংগঠনকে শক্তিশালী করার দিকে নজর দেয়।
সূত্রমতে, ঘরোয়া রাজনীতির মাধ্যমে সংগঠিত হওয়ার শুরুতে শিবির চারটি ক্যাটাগরিকে টার্গেট করে সদস্য (বন্ধু) সংগ্রহ শুরু করে। এর মধ্যে আছে— সিংগেল ডিজিট, জিপিএ ফাইভ পাওয়া শিক্ষার্থী, মেধাক্রমে স্থান পাওয়া শিক্ষার্থী ও প্রভাবশালী পরিবারের সন্তান।
চট্টগ্রাম নগরী ও জেলায় ৭২টি প্রাইমারি স্কুল, ৭৬টি মাধ্যমিক বিদ্যালয়, চারটি ভোকেশনাল স্কুল, আটটি সরকারি কলেজ (স্নাতকোত্তর পর্যায় একেকটি কলেজ শাখা হিসেবে বিবেচিত), ১২টি বেসরকারি কলেজ, ৪০টি স্কুল অ্যান্ড কলেজ, দুইটি আইন কলেজ, আটটি পলিটেকনিক ইনস্টিটিউট, একটি টেক্সটাইল ও একটি টেকনিক্যাল ইনস্টিটিউট, চট্টগ্রাম সরকারি মেডিকেল কলেজ, পাঁচটি বেসরকারি মেডিকেল কলেজ, চারটি হোমিও কলেজ, চট্টগ্রাম প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, ছয়টি ইংলিশ মিডিয়াম স্কুল এবং ৬৬টি সরকারি নিয়ম মেনে চলা মাদ্রাসা ও ৯টি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে তাদের কার্যক্রম শুরু করে শিবির।
অনলাইনে দাওয়াতের মাধ্যমে ‘বন্ধু’ বাছাই করে তাদের বিভিন্ন বিষয়ে প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়। এর মধ্যে তথ্যপ্রযুক্তি এবং সাংগঠনিক বিভিন্ন প্রশিক্ষণ আছে। বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান থেকে ‘বন্ধু’ সংগ্রহের পর চট্টগ্রাম নগরীতে ২০ হাজার প্রশিক্ষিত কর্মী তৈরির কথা জিজ্ঞাসাবাদে পুলিশকে জানিয়েছেন গ্রেফতার হওয়া জামায়াত-শিবিরের নেতারা।
সূত্র বলছে, গত ফেব্রুয়ারি থেকে আবারও জোরালোভাবে ‘বন্ধু’ সংগ্রহের কার্যক্রম শুরু করে শিবির। তাদের টার্গেটের মধ্যে আছে স্কুল-মাদ্রাসা ও কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের বন্ধু বানানো এবং অমুসলিম ও প্রগতিশীল ঘরানার সংস্কৃতিকর্মীদের মগজ ধোলাই করে নিজেদের পক্ষে নিয়ে যাওয়া। এই প্রক্রিয়ায় ১৩ হাজার বন্ধু বানানোর টার্গেট নির্ধারণ করে শিবির। ১০ ফেব্রুয়ারি থেকে শুরু হওয়া এই কর্মসূচি ১৩ অক্টোবর পর্যন্ত চলার কথা রয়েছে।
জানা গেছে, ঘরোয়া রাজনীতির ক্ষেত্রে তারা ব্যবহার করছে এসএমএস, এমএমএস, ইমেইল, ফেসবুক ও টেলিগ্রাম। তবে তারা সবচেয়ে বেশি টেলিগ্রামের ওপর নির্ভর করছে বলে তথ্য আছে পুলিশের কাছে।
বিভিন্ন সূত্র থেকে আরও জানা গেছে, ছাত্রশিবিরের অভ্যন্তরীণ মূল্যায়ন রিপোর্ট অনুযায়ী তাদের সবচেয়ে মজবুত সংগঠন আছে পলিটেকনিক ইনস্টিটিউটে। এরপরই আছে সরকারি স্কুল ও কলেজ এবং পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়। বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়, মাদ্রাসা এবং মেডিকেল কলেজে তাদের সাংগঠনিক দুর্বলতার কথা উঠে এসেছে।
কোতোয়ালি থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মোহাম্মদ মহসিন সারাবাংলাকে বলেন, স্কুল-কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী, সংস্কৃতিকর্মী এবং বিশেষত সাংবাদিকদের মধ্যে বর্তমান ও সাবেক শিবিরের নেতাকর্মীদের একটি শক্ত বলয় গড়ে উঠেছে। ঘরোয়া রাজনীতি করতে গিয়ে এই কাজটি তারা খুব ভালোভাবে করেছে। জিজ্ঞাসাবাদে আমরা এমন তথ্য পেয়েছি।
সূত্রমতে, ২০১৮ সালে গঠিত কেন্দ্রীয় কার্যকরী পরিষদের সম্পাদকমণ্ডলীর ৪৩ জন সদস্যকে সারাদেশে বিভিন্ন সাংগঠনিক দায়িত্ব বণ্টন করা হয়েছে। এর মধ্যে কেন্দ্রে দায়িত্ব পালন করছেন ২৫ জন, বাকি ১৮ জন এবং মনোনীত পরিষদের আট জনকে চট্টগ্রাম মহানগরীসহ বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ শহর এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। এর মধ্যে সার্বিকভাবে তত্ত্বাবধানের দায়িত্বে আছেন ছাত্রশিবিরের সাবেক সভাপতি মাওলানা রফিকুল ইসলাম খান ও মুহাম্মদ সেলিম উদ্দিন।
এছাড়া, চট্টগ্রাম মহানগরী উত্তরের সভাপতি মুহাম্মদ আব্দুল জব্বারের নেতৃত্বে ১৫ জন আছেন বিভিন্ন থানা ও ওয়ার্ড এবং সাংগঠনিক স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের দায়িত্বে।
সদরঘাট থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মো. নেজাম উদ্দিন বলেন, শিবিরের একেকটি কলেজ কমিটিকে পূর্ণাঙ্গ থানা কমিটির মর্যাদা দেওয়া হয়েছে। এর ভেতরে আবার বিষয়ভিত্তিক বিভিন্ন শাখা ও হল কমিটি আছে। সেগুলো একেকটি ওয়ার্ড কমিটির মর্যাদাসম্পন্ন।
আরও পড়ুন-
ফ্রন্টলাইনে আসতে যুক্তফ্রন্টের বাধা তারেক ও জামায়াত
সারাবাংলা/আরডি/টিআর