হুট করে বন্ধ ‘অনুমোদিত’ হিউম্যান হলার, বিপাকে যাত্রীরা
১১ সেপ্টেম্বর ২০১৮ ০৮:৫৪
।। সাদ্দাম হোসাইন, স্টাফ করেসপন্ডেন্ট ।।
ঢাকা: ‘সব সমস্যা আমাদের মতো গরীবদের জন্য ভাই। দেশে কিছুতে কিছু হলেই আমাদের মতো গরীবদের ওপরেই চাপ আসে। শুনছি, সরকার নাকি এখন আবার নতুন করে লেগুনা (হিউম্যান হলার) বন্ধ করে দিয়েছে। কিন্তু একটাবারও আমাদের কথা ভাবলো না! আগে ১৮ টাকা দিয়ে বাসায় যেতাম ব্রিজ থেকে। আজ দুই-তিন দিন হয় পায়ে হেঁটে যাই, নাইলে এক-দেড় শ টাকা খরচ করে রিকশায় যেতে হয়। যা আয় করি তা দিয়ে পেট চালামু না পথেই খরচা করমু?’
রাজধানীর রামপুরা-মেরাদিয়া অস্থায়ী হিউম্যান হলার স্ট্যান্ডে দাঁড়িয়ে হতাশা আর চাপা ক্ষোভ নিয়ে সারাবাংলার কাছে কথাগুলো বলছিলেন মাদারটেকের বাসিন্দা সুমন উদ্দিন। অভিযোগ করে তিনি বলেন, আধাঘণ্টা ধরে দাঁড়িয়ে আছি। কোনো লেগুনা নেই, রিকশা ভাড়াও সাধ্যের বাইরে।
তিনি বলেন, রামপুরায় একটা গার্মেন্ট কারখানায় চাকরি করি। এখান থেকে মাদারটেকের রিকশা ভাড়া চাচ্ছে দেড় শ টাকা। একশ ২০ টাকা পর্যন্ত বলেছি, তাও রাজি হচ্ছে না। এ অবস্থা চলতে থাকলে যা আয় করি, সব তো পথেই খরচ হয়ে যাবে। তাহলে বাসার বাকি চারটা পেট কীভাবে চলবে?
একই ধরনের অভিযোগ করলেন আরেক পোশাককর্মী আরমান শেখ। তিনি বলেন, গেল কয়েকদিন ধরেই এ অবস্থা। মেরাদিয়ার এই এলাকা থেকে বাসাবে -মাদারটেকের দিকে কোনো বাস চলে না। তাই আমাদের ভরসা ছিল লেগুনা। কিন্তু সেগুলো নাকি সরকার বন্ধ করে দিয়েছে। গতকাল (রোববার) হেঁটে গিয়েছি। আজও মনে হয় তাই হবে। আমাদের জন্য কেউ চিন্তা করে না।
শুধু মাদারটেকের সুমন বা আরমান নয়, রাজধানীর বাড্ডা লিংক রোড, মহাখালী, ফার্মগেট, মোহাম্মদপুর ও মিরপুরসহ হিউম্যান হলারের রুটগুলোর নিয়মিত যাত্রীদের সবার অভিযোগ এক- হুট করে হিউম্যান হলার বন্ধ হওয়ায় তারা চরম বিপাকে পড়েছেন। এসব যাত্রীদের অধিকাংশই নিম্ন ও মধ্যম আয়ের।
পরিবহন ও যাত্রী অধিকার নিয়ে কাজ করছেন এমন বিশেষজ্ঞরা বলছেন, শ্রমিক ও যাত্রীদের জন্য বিকল্প ব্যবস্থা না করে এমন সিদ্ধান্ত অযৌক্তিক। কারণ এ পরিবহনের সঙ্গে যাত্রীরা যেমন জড়িয়ে আছে, তেমনি পরিবহনের চালক ও তাদের জীবিকা জড়িয়ে আছে। ঢাকা মেট্রেপলিটন পুলিশ (ডিএমপি) কমিশনারের এমন সিদ্ধান্ত জনবান্ধব নয়। এ সিদ্ধান্তের কারণে প্রান্তিক মানুষরাই অবর্ণনীয় দুর্ভোগের শিকার হবে। অন্তত পরিবহন শ্রমিকদের জীবন-জীবিকা ও প্রান্তিক যাত্রীদের দুর্ভোগের কথা ভেবে কার্যকরী বিকল্প ব্যবস্থা চালু করে তবেই এই পরিবহন বন্ধের সিদ্ধান্ত নেওয়া উচিত ছিল বলে মনে করছেন তারা।
লেগুনা বন্ধের সিদ্ধান্তের বিষয়ে জানতে চাইলে বিষয়ে বাংলাদেশ অটো-রিকশা অটোটেম্পু পরিবহন শ্রমিক ফেডারেশনের সাধারণ সম্পাদক মো. গোলাম ফারুক সারাবাংলাকে বলেন, ‘এসব হিউম্যান হলার চলাচলের অনুমোদন দিয়েছে আঞ্চলিক পরিবহন কমিটি (আরটিসি)। ডিএমপি কমিশনার সেখানকার সভাপতি। তারপরও তিনি এগুলো বন্ধের ঘোষণা দিয়েছেন। কিন্তু হিউম্যান হলার বন্ধ করতে হলে অবশ্যই যুক্তিসঙ্গত কারণ থাকতে হবে। অযৌক্তিকভাবে তো বন্ধ ঘোষণা করলেই তো বন্ধ হবে না। এ জন্য আমরা সব শ্রমিক ও মালিক সংগঠনের নেতাদের সঙ্গে আলোচনা চালিয়ে যাচ্ছি।’
তিনি আরও বলেন, যদি সব বন্ধের ঘোষণা না দিয়ে বলা হতো ফিটনেসবিহীন অথবা অনুমোদন নেই- এমন পরিবহনগুলো বন্ধ করা হবে, তাহলে মানা যেত। কিন্তু এভাবে যাত্রীদের কষ্ট দিয়ে এবং আমাদের অনুমোদন থাকা সত্ত্বেও বন্ধ ঘোষণার ফলে আমরা উভয়েই ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছি। কিন্তু আমাদের রুট পারমিট আইনসিদ্ধ। হঠাৎ ঘোষণা দিয়ে বৈধ একটা বিষয়কে অবৈধ করা যায় না। এ জন্য আলাপ-আলোচনা করতে হবে। পরিকল্পনামাফিক এগুতে হয়।
এ বিষয়ে বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব প্ল্যানার্সের সহসভাপতি এবং জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের নগর ও অঞ্চল পরিকল্পনা বিভাগের অধ্যাপক ড. আকতার মাহমুদ সারাবাংলাকে বলেন, হিউম্যান হলার বন্ধ হলেও বিকল্প কোনো সার্ভিস চালু হয়নি। প্রধান সড়কগুলোতে হিউম্যান হলারের যাত্রীও অনেক। এখন এগুলো বন্ধের কারণে ওইসব এলাকার যাত্রীরা হঠাৎ দুর্ভোগে পড়েছেন। সেজন্য এ সিদ্ধান্তটা জনবান্ধব হয়নি।
তিনি আরও বলেন, কী কারণে এটা বন্ধ করা হলো, সে কারণটিও অস্পষ্ট। শুধু দুর্ঘটনার জন্য দায়ী- এমন ভিত্তিতে এটা বন্ধ না করে বরং যেসব পরিবহনের ফিটনেস নেই অথবা চালক অপ্রাপ্তবয়স্ক কিংবা অদক্ষ অথবা রুট পারমিট বা অনুমোদন নেই, সেসব হিউম্যান হলার বন্ধ করা যেত। তাহলে জনদুর্ভোগ হতো না এবং অনুপযোগী হিউম্যান হলার রাস্তা থেকে সরে যেত। এতে দুর্ঘটনার জন্য দায়ী লেগুনাগুলোও প্রতিরোধ করা যেত। কিন্তু তা করা হয়নি। অথচ শহরে যানজটের জন্য অর্ধেক দায়ী প্রাইভেটকারগুলোর যে অবৈধ পার্কিং হচ্ছে, সেগুলোর বিরুদ্ধে কিন্তু এখন পর্যন্ত ডিএমপি কিংবা সরকার হার্ডলাইনে কোনো ব্যবস্থা নেয়নি।
এ বিষয়ে ঢাকা মেট্রোপলিটন ট্রাফিক পুলিশের অতিরিক্ত কমিশনার মীর রেজাউল আলম বলেন, সিটির ভেতরে যেসব হিউম্যান হলার চলে সেগুলো সরিয়ে দেওয়া হচ্ছে। ঢাকার আশপাশে ও উপকণ্ঠে এগুলো চলবে। মূল সড়কের যেসব জায়গায় এখনও হিউম্যান হলারের চলাচল বন্ধ হয়নি, সেসব জায়গাতেও তা বন্ধ করা হবে বলে জানান তিনি।
উল্লেখ্য, রাজধানীতে চলাচলের রুট পারমিট নেই- এমন কারণ জানিয়ে গত ৪ সেপ্টেম্বর হিউম্যান হলারের চলাচল বন্ধের নির্দেশ দেন ডিএমপি কমিশনার আছাদুজ্জামান মিয়া। তিনি বলেন, লেগুনার কারণে সড়কে সবচেয়ে বিশৃঙ্খল পরিস্থিতি তৈরি হয়। সড়কে দুর্ঘটনার অন্যতম কারণও এই লেগুনা। কাজেই রাজধানীতে লেগুনা চলবে না। এ ঘোষণার পর দুয়েকটি রুট ছাড়া রাজধানীর বেশিরভাগ রুটেই হিউম্যান হলার বা লেগুনা চলাচল বন্ধ হয়ে যায়।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, পরিবেশ দূষণের কারণে ২০০২ সালে রাজধানী থেকে তিন চাকার অটো টেম্পু উচ্ছেদ করা হয়। বিকল্প ব্যবস্থা হিসেবে পরিবেশবান্ধব হিউম্যান হলার চলাচলের অনুমোদন দেওয়া হয়। চলতি বছরের জুলাই পর্যন্ত রাজধানী ঢাকায় প্রায় পাঁচ হাজার ১৫৬টি হিউম্যান হলার নিবন্ধিত হয়েছে বাংলাদেশ রোড ট্রান্সপোর্ট অথরিটিতে (বিআরটিএ)।
এসব নিবন্ধিত পরিবহনগুলোকে রাজধানীর ফার্মগেট থেকে মিরপুর-১০, ফার্মগেট থেকে মহাখালী, ফার্মগেট থেকে জিগাতলা, ফার্মগেট থেকে মানিক মিয়া অ্যাভিনিউ হয়ে নিউমার্কেট, ট্যানারি মোড় থেকে নিউমার্কেট, গাবতলী থেকে বাড্ডা ভায়া মহাখালী-গুলশান- উত্তরা মাস্কট প্লাজা ও দিয়াবাড়ি, গুলিস্তান থেকে মালিবাগ রেলগেট-সিপাহীবাগ-গোড়ান, ডিএসসিসি নগর ভবন থেকে পুরান ঢাকার বিভিন্ন এলাকায় চলাচলের অনুমোদনও দিয়েছিল গণপরিবহনের ২৫১টি রুটের আঞ্চলিক পরিবহন কমিটি (আরটিসি)। অনুমোদনে প্রায় ১৫৯টিতে এসব গাড়ি চলাচলের অনুমোদন রয়েছে।
সারাবাংলা/এসএইচ/জেডএফ