Wednesday 20 Nov 2024
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

নির্বাচন নিয়ে ‘রণপ্রস্তুতি’ জামায়াত-শিবিরের


১১ সেপ্টেম্বর ২০১৮ ২১:৪১

।। স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট ।।

চট্টগ্রাম ব্যুরো: আগামী নির্বাচন নিয়ে রীতিমতো ‘রণপ্রস্তুতি’ নিয়ে রেখেছে জামায়াত ইসলামী ও তাদের ছাত্রসংগঠন ছাত্রশিবির। নির্বাচনে গেলে কিংবা না গেলে কী ধরনের কৌশল তারা নেবে— তা আগে থেকেই ঠিক করে রেখেছে আদালতের রায়ে নিবন্ধনবিহীন অবস্থায় থাকা রাজনৈতিক দলটি।

পুলিশসহ বিভিন্ন সূত্রের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়াকে মুক্তি না দিলে ভোট বর্জন করে নির্বাচন ঠেকানোর প্রস্তুতি আছে জামায়াত-শিবিরের। আবার নির্বাচনে অংশ নিলে গলায় নৌকা প্রতীকের কার্ড ঝুলিয়ে ভোটকেন্দ্রে শক্ত অবস্থান নেওয়া এবং ব্যাপক সহিংসতার মাধ্যমে ভোটের ফল নিজেদের অনুকূলে নেওয়ারও প্রস্তুতি আছে দলটির।

সূত্রের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, নির্বাচনে না গেলে তফসিল ঘোষণার পর থেকে আবারও সহিংস রাজনৈতিক কর্মসূচি শুরুর প্রস্তুতি আছে জামায়াত-শিবিরের। এক্ষেত্রে হামলার মাধ্যমে পুলিশের মনোবল ভেঙে দেওয়া এবং বাংলাদেশের অর্থনীতির জন্য গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনাগুলোতে নাশকতার টার্গেট নিয়েছে দলটি।

নির্বাচনকে কেন্দ্র করে বিএনপির নেতৃত্বাধীন জোটের মূল স্ট্রাইকিং ফোর্স হিসেবে মাঠে জামায়াত-শিবির থাকবে— এমন তথ্য পাওয়ার কথা জানিয়েছেন চট্টগ্রাম নগর পুলিশের (সিএমপি) একাধিক কর্মকর্তা।

সম্প্রতি নগর গোয়েন্দা পুলিশ এবং কোতোয়ালি ও সদরঘাট থানা পুলিশ জামায়াতের চট্টগ্রামের শীর্ষ নেতা ও সাবেক সংসদ সদস্য শাহজাহান চৌধুরীসহ কয়েকজন গুরুত্বপূর্ণ নেতা ও কর্মীকে গ্রেফতারের পর এসব তথ্য পেয়েছে। এসব তথ্য এরই মধ্যে প্রতিবেদন আকারে পুলিশ সদর দফতরে পাঠানো হয়েছে বলে সূত্র জানিয়েছে।

বিজ্ঞাপন

জানতে চাইলে সিএমপি’র অতিরিক্ত কমিশনার (অপরাধ ও অভিযান) আমেনা বেগম সারাবাংলাকে বলেন, ‘নির্বাচনকে সামনে রেখে জামায়াত-শিবিরের নাশকতার পরিকল্পনার বিষয়ে আমরা জেনেছি। ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ আমাদের বেশকিছু নির্দেশনা দিয়েছে। এক্ষেত্রে তারা কী ধরনের নাশকতা করতে পারে, তাদের টার্গেট কী— সেগুলো আমরা খতিয়ে দেখছি। ২০১৩-১৪ সালে কারা নাশকতা করেছে, মামলার আসামি হিসেবে কারা আছেন, তাদের মধ্যে জামিনে কারা আছে— সেসব বিষয়ও আমরা খতিয়ে দেখছি। নাশকতার চেষ্টা হলে সর্বাত্মকভাবে প্রতিরোধের সব প্রস্তুতি আমরা নিচ্ছি।’

সদরঘাট থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মো. নেজাম উদ্দিন সারাবাংলাকে বলেন, জামায়াতের পরামর্শে ছাত্রশিবিরের ২০১৮ সালের পুরো সাংগঠনিক পরিকল্পনা আমরা জানতে পেরেছি। এই পরিকল্পনার বড় অংশই জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে কেন্দ্র করে। তারা পুলিশের ওপর হামলা করতে চায়। এটাই তাদের প্রধান লক্ষ্য। দ্বিতীয় টার্গেট হচ্ছে অর্থনৈতিক অঞ্চল।

সূত্র জানায়, ছাত্রশিবিরের কেন্দ্রীয় সভাপতি মুহাম্মদ ইয়াছিন আরাফাত দেশের সব শাখায় দিকনির্দেশনামূলক একটি বক্তব্য পাঠিয়েছেন। এতে ২০ দফা দিকনির্দেশনার কথা উল্লেখ আছে। সেই দিকনির্দেশনায় নির্বাচন নিয়ে ছাত্রশিবিরের পরিকল্পনায় সরকারবিরোধী বৃহত্তর আন্দোলনের সঙ্গে সমন্বয় রেখে নিজেদের বড় শক্তি হিসেবে প্রকাশের কথা উল্লেখ আছে।

সূত্রমতে, নির্বাচনে শক্তি প্রদর্শনের জন্য চট্টগ্রাম মহানগরীর ১৬টি থানা এলাকাকে ৫২টি সাংগঠনিক থানায় ভাগ করেছে ছাত্রশিবির। আটটি থানার বিপরীতে ২৬টি সাংগঠনিক থানায় ১২৯ জন করে দায়িত্বশীল নেতারা মনিটরিংয়ের দায়িত্বে থাকবেন। মাঠে থাকবে ২০ হাজার প্রশিক্ষিত কর্মী।

বিজ্ঞাপন

কোতোয়ালি থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মোহাম্মদ মহসিন সারাবাংলাকে বলেন, ‘তফসিল ঘোষণার পর থেকে নির্বাচনী প্রচারণা কিংবা আন্দোলনকে কেন্দ্র করে প্রকাশ্যে আসবে জামায়াত-শিবির। মহানগরীকে দুই ভাগ করে উত্তর ও দক্ষিণ জোনে শিবির ২৬টি করে সাংগঠনিক থানা কমিটি গঠন করেছে। প্রশিক্ষিত নেতাকর্মীদের মধ্যে আবার চারটি স্তর আছে। একভাগ বিভিন্ন সামাজিক সংগঠনের ব্যানারে দোকান-অফিস, বাসাবাড়িতে যাবে; আরেকভাবে রাজনৈতিক কর্মসূচিতে সক্রিয় থাকবে; ‍তৃতীয় ভাগ চালাবে সহিংসতা; আর আরেকটি অংশ অনলাইনে সক্রিয় থাকবে। সারাদেশের সব গুরুত্বপূর্ণ জেলা ও শহরে একই পরিকল্পনা নিয়ে তারা কাজ করবে।

সূত্র জানায়, ২০১৮ সালে ছাত্রশিবির নগরীর বিভিন্ন ওয়ার্ড ও স্কুল-কলেজ মিলিয়ে ১৮৪টি ইউনিটে কুরআন ক্লাস ও আলোচনা চক্র পরিচালনা করেছে। এতে নির্বাচন নিয়ে পরিকল্পনার কথা বলা হয়েছে। প্রতিটি ইউনিট থেকে আট জন করে প্রশিক্ষিত কর্মী নিয়ে গঠন করা হয়েছে সমন্বয় কমিটি।

ছাত্রশিবিরের কেন্দ্রীয় সম্পাদকমণ্ডলীর ২৬ সদস্য, নির্বাচিত পরিষদের ৪৩ জন, মনোনীত পরিষদের আট জন এবং সাবেক দুই সভাপতি নির্বাচনকেন্দ্রিক সার্বিক কর্মকাণ্ড দেখভাল করছেন।

কেন্দ্রীয় সম্পাদকমণ্ডলীর সদস্যদের মধ্যে আছেন— সাইফুল ইসলাম, শাহ মো. মাহফুজুল হক, সালাউদ্দিন আইয়ূবী, হাসানুল বান্না, খালেদ মাহমুদ, রাজিফুল হাসান বাপ্পি, রাশেদুল ইসলাম, রিয়াজ উদ্দিন, জামশেদ আলম, মনিরুল ইসলাম, কামরুল হাসান, আতিকুর রহমান, আবদুল্লাহ আল মাহমুদ, তৌহিদুল ইসলাম, মুজাহিদুল ইসলাম, আব্দুল জলিল আকন্দ, রাজিবুর রহমান পলাশ, আদনান কবির, শাহাদাত হোসেন, নাজমুস সাদাত, নাদিমুল ইসলাম, জসিম উদ্দিন, ইমরান খালিদ, মাসুদ পারভেজ, আবদুল্লাহ আল গালিব ও সরওয়ার কামাল।

নির্বাচিত পরিষদের সদস্যদের মধ্যে ঢাকা মহানগরী পূর্ব, উত্তর ও দক্ষিণের দায়িত্বে আছেন জামিল মাহমুদ, শাফিউল আলম ও সোহেল রানা মিঠু। নারায়ণগঞ্জ মহানগরীতে আব্দুর রব ফারুকী, রাজশাহী মহানগরীতে মঞ্জুরুল ইসলাম, সিলেট মহানগরীতে নজরুল ইসলাম, চট্টগ্রাম মহানগরী উত্তর-দক্ষিণে আব্দুল জব্বার ও রফিকুল ইসলাম লোদী, খুলনা মহানগরীতে হাবিবুর রহমান, বরিশাল মহানগরীতে জাবের হাসান, ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ে হাদিউজ্জামান খোকন, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে গোলাম রাব্বানী, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ে শাহিন হাসান প্রধান, ঢাকা মহানগরী পশ্চিমে আব্দুল আলীম, কুমিল্লা মহানগরীতে হাবিবুর রহমান মজুমদার, দিনাজপুর শহরে সোহেল রানা, নোয়াখালী শহরে জাকের হোসেন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে শরফুদ্দিন দায়িত্বে আছেন।

মনোনীত পরিষদের সদস্যদের মধ্যে সরওয়ার কামাল কেন্দ্রে, গাজীপুর মহানগরীতে মিজানুর রহমান, রংপুর মহানগরীতে সামিউল ইসলাম, ময়মনসিংহ মহানগরীতে গোলাম কিবরিয়া, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে হাসান তারিক, প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ের মহিনউদ্দিন, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের ইমরান হাসান এবং বগুড়া শহরে দায়িত্বে আছেন রেজাউল করিম।

ছাত্রশিবিরের সাবেক কেন্দ্রীয় সভাপতি মাওলানা রফিকুল ইসলাম খান ও মুহাম্মদ সেলিমউদ্দিন কেন্দ্র থেকে সব ধরনের পরিকল্পনা নিচ্ছেন এবং দিকনির্দেশনা দিচ্ছেন বলে তথ্য আছে নগর পুলিশের কাছে।

সূত্রমতে, চট্টগ্রাম মহানগরী উত্তরে যেসব ছাত্রশিবিরের নেতা সক্রিয় থেকে আন্দোলন সংগঠিত করার দায়িত্ব পেয়েছেন, তাদের মধ্যে আছেন সভাপতি মুহাম্মদ আব্দুল জব্বার, সেক্রেটারি আ স ম রায়হান, অফিস সম্পাদক আমানউল্লাহ আমান, আইন ও ট্রাস্ট সম্পাদক আ ন ম যোবায়ের, সাহিত্য ও সাংস্কৃতিক সম্পাদক মুহাম্মদ আহসান উল্লাহ, দাওয়াহ সম্পাদক ডা.আরশাদুল ইসলাম, স্কুল কার্যক্রম সম্পাদক রায়হান মুহাম্মদ কাউসার, প্রকাশনা সম্পাদক আনোয়ার হোসাইন, কলেজ ও মিডিয়া সম্পাদক আব্দুর রশিদ, এইচআরডি ও পাঠাগার সম্পাদক হাফেজ জহিরুল ইসলাম, শিক্ষা সম্পাদক ইয়াসিন আরাফাত, মাদ্রাসা কার্যক্রম সম্পাদক ওসমান গণী, প্রচার সম্পাদক ফরহাদুল হাসান, বিতর্ক সম্পাদক তারেক মাহমুদ, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি সম্পাদক আব্দুর রহমান, সমাজসেবা ও তথ্য-গবেষণা সম্পাদক ড. মাসুম বিল্লাহ, মানবাধিকার ও ক্রীড়া সম্পাদক দিদারুল মোস্তফা এবং একাডেমিক কোচিং সম্পাদক তারিকুল ইসলাম মাসুদ।

একইভাবে চট্টগ্রাম মহানগরী দক্ষিণেও একইভাবে দায়িত্ব বণ্টন করার তথ্য পেলেও তাদের নাম পায়নি পুলিশ।

সদরঘাট থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) নেজাম উদ্দিন সারাবাংলাকে বলেন, ‘আমরা ছাত্রশিবিরের দায়িত্বশীল ১৩ জনকে গ্রেফতার করেছিলাম। তাদের কয়েকজনের মোবাইলে অ্যাপসের মাধ্যমে যেসব সাংগঠনিক নির্দেশনা এসেছে, সেগুলো আমরা পেয়েছি। জিজ্ঞাসাবাদেও বিভিন্ন তথ্য দিয়েছেন। তারা বলেছেন, নির্বাচনকে কেন্দ্র করে ২০ দলের বাইরে ছাত্রশিবিরের কেন্দ্রভিত্তিক আলাদা কমিটি থাকবে।’

ওসি বলেন, তাদের পরিকল্পনা দুই ধরনের। বেগম খালেদা জিয়াকে মুক্তি না দিলে তারা নির্বাচনে যাবে না। সেক্ষেত্রে নির্বাচন ঠেকাতে জন্য পুলিশের মনোবল ভেঙে দেওয়ার জন্য হামলা করবে। এমনকি ভোটগ্রহণের সময় যখন সবাই কেন্দ্রে ব্যস্ত থাকবে, তখন তারা থানা-ফাঁড়ি আক্রমণের চেষ্টা করবে। ইপিজেড, চট্টগ্রাম বন্দরসহ অর্থনীতি সংশ্লিষ্ট যেসব পয়েন্ট আছে, সেগুলোতে হামলা করবে। ব্যাপক ধ্বংসযজ্ঞ ঘটিয়ে নির্বাচন বানচালের সব পরিকল্পনা তাদের আছে।

‘আর যদি নির্বাচনে যায়, তাহলে গলায় নৌকার কার্ড ঝুলিয়ে কেন্দ্রে শক্ত অবস্থান নেবে। ভোটকেন্দ্র পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণে রেখে ফলাফল নিজেদের অনুকূলে আনার চেষ্টা করবে। সেক্ষেত্রে প্রয়োজনে তারা কেন্দ্র দখল করবে।  যেকোনোভাবে আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের চেয়ে তাদের অবস্থান যেন শক্ত থাকে, সেজন্য তারা সব প্রস্তুতি নিচ্ছে। কেন্দ্রে পুলিশ ও আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের সঙ্গে রক্তক্ষয়ী সংঘাতে জড়াবে,’— বলেন ওসি নেজাম উদ্দিন।

রাজনৈতিক বিশ্লেষক ও ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউশন চট্টগ্রাম কেন্দ্রের সাবেক সভাপতি দেলোয়ার মজুমদার সারাবাংলাকে বলেন, ‘এটা অস্বীকার করার উপায় নেই, আওয়ামী লীগের ভেতরে বিপুল পরিমাণ জামায়াত-শিবিরের অনুপ্রবেশ ঘটেছে। ক্ষেত্রবিশেষে আওয়ামী লীগের নেতারাই তাদের ছায়া দিয়ে জায়গা করে দিয়েছেন। এই কূটকৌশলের রাজনীতিতে জামায়াত লাভবান হয়ে অনেক বেশি শক্তিশালী হয়েছে। জামায়াত-শিবির কখনও তাদের লক্ষ্য থেকে বিচ্যুত হয় না। তারা নির্বাচনে মরণকামড় দেবে— এটাই স্বাভাবিক।’

আরও পড়ুন-

‘ডোন্ট ডিস্টার্ব আ.লীগ’ থিওরিতে জামায়াত এখন দ্বিগুণ শক্তিশালী!

সারাবাংলা/আরডি/টিআর

ছাত্রশিবির জাতীয় সংসদ নির্বাচন জামায়াত জামায়াতে ইসলামী নির্বাচনী কৌশল

বিজ্ঞাপন

আরো

সম্পর্কিত খবর