আত্মহত্যার সংবাদ পরিবেশনে সর্তকতা অবলম্বনের পরামর্শ
১৩ সেপ্টেম্বর ২০১৮ ২২:০৯
।। স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট ।।
ঢাকা: আত্মহত্যার সংবাদ পরিবেশনের ক্ষেত্রে সতর্কতা অবলম্বনের পরামর্শ দিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা। বিভিন্ন জরিপের বরাত দিয়ে তারা বলেছেন, ‘আত্মহত্যার সংবাদ প্রকাশের পর আত্মহত্যার প্রবণতা বেড়ে যায়। তাই এ ধরনের সংবাদ এমন ভাবে পরিবেশন করা উচিত, যাতে এর দ্বারা অন্যরা প্রভাবিত না হয়। যাতে অন্যরা সংবাদ পড়ে কেউ আত্মহত্যার পথে না এগোয়।’
এক্ষেত্রে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার কিছু নির্দেশনা মেনে সংবাদ পরিবেশনেরও পরামর্শ দেন তারা।
বৃহস্পতিবার (১৩ সেপ্টেম্বর) জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউট মিলনায়তনে এক কর্মশালায় এসব পরামর্শ দেন বিশেষজ্ঞরা। জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটের উদ্যোগে ‘ওয়ার্কসপ অন রেসপন্সসিবল রিপোর্টিং অব সুইসাইড ফর মিডিয়া প্রফেসনালস’ শীর্ষক অনুষ্ঠানের আয়োজন করে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা।
জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক ডা. মো. আব্দুল মোহিত কামাল বলেন, ‘নিজের আশপাশের মানুষগুলোর মনের খবর রাখতে হবে। যারা আত্মহত্যার ঝুঁকিতে আছেন, তাদের পাশে দাঁড়াতে হবে। কাউন্সিলিং করে আত্মহত্যার পথ থেকে ফেরানোর চেষ্টা করতে হবে। যদি আগে থেকেই বোঝা যায়, কেউ আত্মহত্যার পথে হাঁটছেন, তাহলে তাকে বুঝিয়ে ওই পথ থেকে ফিরিয়ে আনা সম্ভব।’
আত্মহত্যার খবর প্রকাশের ব্যাপারে তিনি বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার নির্দেশনা মেনে সংবাদ পরিবেশনের পরামর্শ দেন। তিনি বলেন, ‘আত্মহত্যার খবর ফলাও করে প্রকাশ না করে, এমন ভাবে প্রকাশ করা, যাতে এর দ্বারা কেউ প্রভাবিত না হয়।’
জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটের পরিচালক অধ্যাপক ডা. মো. ফারুক আলম বলেন, ‘আত্মহত্যা প্রতিরোধে পৃথক নীতিমালা হওয়া প্রয়োজন। একইসঙ্গে আত্মহত্যা প্রতিরোধে এ ধরনের আলোচনা বেশি বেশি হওয়া দরকার। যত বেশি আলোচনা হবে, সবাই ততোবেশি এ সম্পর্কে জানবে, জানলে সচেতন হবে। আর সচেতন হলে প্রতিরোধও বাড়বে।’
জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটের সহযোগী অধ্যাপক ডা. হেলাল উদ্দিন আহমেদ বলেন, ‘বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার ২০১৪ সালের জরিপ অনুযায়ী, বিশ্বে প্রতি ৪০ সেকেন্ডে একজন মানুষ আত্মহত্যা করে। বছরে করে ৮ লাখ। ২০২০ সালে এই সংখ্যা হবে দ্বিগুণ; প্রায় সাড়ে ১৫ লাখ মানুষ আত্মহত্যা করবে। ১ নাম্বার ঝুঁকিতে কৃষক এবং বিশ্বে আত্মহত্যার দ্বিতীয় ঝুঁকিতে রয়েছেন চিকিৎসকরা।’
বাংলাদেশে আত্মহত্যার অবস্থা সম্পর্কে বলতে গিয়ে জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটের সহযোগী অধ্যাপক ডা. মেখালা সরকার বলেন, ‘আত্মহত্যা নিয়ে সুনির্দিষ্ট কোনো জরিপ নেই। বিভিন্ন জরিপে দেখা গেছে, বাংলাদেশে প্রতি লাখে ১০ থেকে ৩৯.৬ জন মানুষ আত্মহত্যা করে। বাংলাদেশে গড়ে প্রতিদিন ২৮ জন মানুষ আত্মহত্যা করে থাকেন। এদের বেশির ভাগের বয়স ২১ থেকে ৩০ বছরের মধ্যে।’
তিনি আরও বলেন, ‘বাংলাদেশে ৬৫ লাখ মানুষ আত্মহত্যার ঝুঁকিতে রয়েছেন। যাদের বেশির ভাগই অল্প বয়সী এবং প্রায় ৮৯ শতাংশ নারী।’
এই মনোরোগ বিশেষজ্ঞ বলেন, ‘যেকোনো ব্যক্তির মৃত্যুর প্রথম ২০টি কারনের মধ্যে আত্মহত্যা অন্যতম। ১৫ বছর বয়সীদের মৃত্যুর দ্বিতীয় কারণ আত্মহত্যা। ৭৯ শতাংশ আত্মহত্যা ঘটে নিম্ন ও মধ্যম আয়ের দেশে। প্রতি একটি আত্মহত্যায় ১৫ জন কোনো না কোনোভাবে মানসিক যন্ত্রণা বা অন্যভাবে আক্রান্ত হয়। যত জন মানুষ আত্মহত্যা করে তার চেয়ে ২৫ গুণ মানুষ আত্মহত্যার চেষ্টা করে। আর তার চেয়েও অনেক বেশি মানুষ আত্মহত্যার চিন্তা করে।’
আত্মহত্যার সংবাদ কেমন হবে বলতে গিয়ে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার নির্দেশনার বরাত গিয়ে ডা. হেলাল উদ্দিন আহমেদ বলেন, ‘সংবাদটি প্রথম পৃষ্ঠায় বা অন্যত্র খুবই গুরুত্বপূর্ণ জায়গায় প্রকাশ করা যাবে না। শিরোনামে এমন কোনো শব্দ বা বাক্যরীতি ব্যবহার করা উচিত নয় যা পাঠক বা দর্শকে উদ্দীপনার খোরাক দেয়। আবার এমন ভাবেও প্রকাশ করা যাবে না যে আত্মহত্যা একটি মামুলী স্বাভাবিক মৃত্যুমাত্র। শিরোনামে এমন কোনো বার্তা না থাকে যাতে মনে হয় আত্মহত্যা কোনো সমস্যার সমাধান।’
তিনি বলেন, ‘কিভাবে একজন আত্মহত্যা করেছে বা করবার চেষ্টা করে কেন ব্যর্থ হয়েছে সে বিষয়ে যেন বিস্তারিত বিবরত আত্মহত্যার সংবাদে না থাকে। এ ধরনের বিবরণ ভবিষ্যতে আরো একজনকে একটি সফল আত্মহত্যার দিকে ঠেলে দিতে পারে।’
আত্মহত্যার স্থান নিয়ে যেন কোনো সংবাদ না থাকে। তবে স্থানটিকে নিরাপদ রাখতে প্রশাসন বা কর্তৃপক্ষকে আলাদা করে জানানো যেতে পারে। আত্মহত্যার পরে মৃতদেহের ছবি বা ভিডিও ফুটেজ কোনোভাবেই প্রকাশ করা উচিত নয়। স্রেলিব্রেটি ব্যক্তিদের আত্মহত্যার বিষয়টি দ্বিগুণ সতর্কতা নিয়ে সংবাদ পরিবেশন করতে হবে, বলেও জানান তিনি।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার প্রতিনিধি ডা. হাসিনা মমতাজ বলেন, ‘৫টি প্রথম শ্রেণির প্রতিকার কয়েকমাসের ৬২টি ঘটনার রিপোর্ট বিশ্লেষণ করা হয়। তাতে দেখা গেছে, ৬৯ শতাংশ কেসে এমন ভাষা ব্যবহার করা হয়েছে তাতে আত্মহত্যাকে সমাধান হিসেবে দেখানো হয়েছে। আত্মহত্যার পদ্ধতি হাইলাইট করা হয়েছে। ৭৩ শতাংশ কেসে লেকেশস উল্লেখ করা হয়েছে। ৬২টি কেসের মধ্যে ১০টি কেসে ছবি বা ভিডিও দেখানো হয়েছে। এসব নেতিবাচক বিষয়ের মধ্যেও মিডিয়ার ইতিবাচক দিকগুলো হচ্ছে কয়েকটি প্রতিবেদনে এর প্রতিরোধে কোথায় যেতে হবে, কারা কাজ করছে, প্রতিরোধের উপায় তুলে ধরা হয়েছে।’
আলোচকরা বলেন, ‘আমাদের দেশে আত্মহত্যাকে এখনো অপরাধ হিসেবে ধরা হয়। আসলে এটিকে অপরাধ ইস্যু হিসেবে না ধরে এটিকে স্বাস্থ্য ইস্যু হিসেবে বিবেচনা করা প্রয়োজন। এছাড়া আত্মহত্যা প্রতিরোধে তারা সরকারি বা বেসরকারি ভাবে একটি হটলাইন চালুর দাবি জানিয়েছেন।’
সারাবাংলা/জেএ/এমও