‘আমি এহন কী করুম, কী খাইমু’
১৪ সেপ্টেম্বর ২০১৮ ০৮:৩৭
।। জাকিয়া আহমেদ, স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট ।।
নড়িয়া (শরীয়তপুর) থেকে ফিরে: ভাদ্রের কড়া রোদ, তার ওপর ভরদুপুর। পদ্মার পাড়ে বসে নদীর দিকে শূণ্য দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছেন ৫৫ বছরের খোদেজা বেগম। সব হারিয়ে একেবারেই নিঃস্ব এই পৌঢ়া।
জানা গেল, নিজের ছয়টি দোকান ঘর ভাড়া দিয়ে চলতো তার সংসার। খোদেজা বেগম বলেন, ‘আপনারা সরকারকে কন, আমারে জায়গা দিতে, আমার ওষুধ খাওয়া টাকা দিতে। নায়তো বান (বাঁধ) দিলো না ক্যা? আর (গত) বছর বান দিলে তো এই বছর পদ্মায় সব যাইতো না। ওষুধ লাগে এক হাজার টাহার প্রতি মাসে, আমি এহন কী করুম, কী খাইমু কন। আমার ঘরও নাই, ওয়ালও নাই কিছুই নাই। ছয় হাজার ট্যাকা প্রতিমাসে পাইতাম ঘর ভাড়া, এহন আমার ছয় টাকাও নাই। এহন সরকার কী করবো-করুক, নাইলে আমাগো মাইরা ফালাক। ১২ গণ্ডা জমি ছিল, কিন্তু সব নদীতে গেছে গা। এহন আমরা বাঁচুম ক্যামনে, বাঁচানোর কোনও পথ নাই আমাগো।’
স্থানীয় আব্দুল গণি শেখ জানালেন, সব ভাইঙ্গা চুইরা যাইতাছে-সেটা দেখার জন্য আসছি। আর কিছু আত্মীয় স্বজনও আছে এই এলাকাতে তাদের সঙ্গে দেখা করতে আসছি। আমরা তাদের পাশে আছি-এইটা জানাতে আসছি-বলেন আব্দুল গণি শেখ। তিনি বলেন,এখানে প্রায়ই আসি, গত কয়েকমাস ধরেই প্রায় দুই থেকে তিনদিন পরপর আসি এখানে।
আব্দুল গণি বলেন, নদী ভাঙনে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন নড়িয়ার কেদারপুর ইউনিয়নের প্রায় আড়াই হাজার পরিবার, তারা এখন ঘরছাড়া। এছাড়াও বিলীন হয়েছে সাধুর বাজার, প্রায় ২০০ বছরের পুরনো মুলফতগঞ্জ বাজার, ওয়াপদা বাজার, বাঁশতলা বাজার।
প্রমত্ত পদ্মার পাড়ে দাঁড়িয়ে গণি শেখ জানান, তিনি শরীয়তপুরের ভেদরগঞ্জের রামভদ্রপুর গ্রাম থেকে এসেছেন। তার মতো আরও অনেকেই নড়িয়ার ভাঙন এলাকার ঘর হারানো মানুষদের পাশে দাঁড়িয়েছেন। কেউ নিয়ে আসছেন খাবার, কেউ আবার দিচ্ছেন নগদ টাকা।
গণি বলেন, ‘শরীয়তপুরের স্থানীয় হিসেবে যাতায়াত করেছেন এই পথে, এই পথ দিয়ে গিয়েছেন অনেক।’ এর আগে দেখা নদীকে কোথায় দেখেছেন জানতে চাইলে আব্দুল গণি শেখ পদ্মার দিকে হাত তুলে বলেন, ‘এখান থেকে প্রায় চার কিলোমিটার মতো উত্তর দিক থেকে ভাইঙ্গা দক্ষিণ দিকে আইসা পরছে, আর পূর্ব দিকে ছিল ছয় কিলোমিটার আর পশ্চিম দিকে ছিলো তিন কিলোমিটারের মতো। পৌরসভার ২, ৪ এবং ৫ নাম্বার ওয়ার্ড ইতোমধ্যেই নদীতে চলে গেছে’, বলেন গণি শেখ।
‘এসব এলাকাতে যেসব আত্মীয়রা ছিল তারা বিভিন্ন জায়গায় অন্য আত্মীয়ের বাড়িতে আশ্রয় নিয়েছে। তারা সরকার থেকে কোনও অনুদান পায়নি, পাবে কিনা তাও জানে না। পরবাসী হয়ে তাদের কতদিন চলতে হবে, সেটাই এখন চিন্তা’, বলেন আব্দুল গণি শেখ।
আব্দুল গণির মত পদ্মাপাড়ের ঘর-বাড়িহারা মানুষদের সান্তনা দিতে, তাদের পাশে দাঁড়াতে এবং প্রমত্তা পদ্মার ভয়াল রূপ দেখতে এই এলাকাতে পুরো শরীয়তপুর থেকেই নানা বয়সের মানুষরা ভিড় করছেন।
তারা বলেন, ‘আমাদেরও যে খুব কিছু করার আছে তা নয়, কিন্তু বিপদের সময়ে মানুষের পাশে দাঁড়ানোই মানুষের ধর্ম তাই তাদের পাশে আছি। একইসঙ্গে দেখতে আসছি, পদ্মা কী করে এতো ভয়াল হলো, কেমন করে সে সব খেয়ে ফেলছে। পদ্মাতে সব ভাঙছে-ভাঙছে মন’, এই একটি কথা বলে সামনে থেকে সরে যান শরীয়তপুর সদরের সাজিদ হোসেন। তিনি আত্মীয়-স্বজনের কাছ থেকে টাকা চেয়ে নিয়ে নদী ভাঙা মানুষের জন্য শুকনো খাবার নিয়ে এসেছেন।
স্থানীয়রা জানালেন, গত ২৬ বছর ধরে পদ্মার ভাঙ্গন চলছে তবে তা ভয়াল মূর্তি ধারণ করেছে চলতি বছরের বর্ষা মৌসুমের শুরুতে। সরেজমিনে নড়িয়াতে গিয়ে দেখা গেল, পদ্মাপাড় পরিণত হয়েছে এক ধ্বংসস্তুপে। দোকান, মসজিদ, মন্দির, হাসপাতাল সব পদ্মার ভেতরে, বিলীন হয়েছে হাজার হাজার জমি। যাদের পাকা বাড়ি ছিল তারা বাড়ি বিক্রি করে দিয়েছেন, সেখানে শ্রমিকরা কাজ করছেন।
আঙ্গারিয়া থেকে আসা বাবুল শেখ জানালেন, পাঁচ কক্ষের একটি পাকা বাড়ি তাদের কাছে বিক্রি করে দেওয়া হয়েছে, সেখান থেকে তারা ইট ভেঙে নিচ্ছেন, রড কিনে নিয়েছেন। কতো টাকায় বিক্রি হয়েছে এ বাড়ি জানতে চাইলে বাবুল শেখ বলেন, ‘১৮ হাজার টাকায় কিনে নিয়েছি।’ কাজ করতে করতেই বাবুল শেখ বলেন, ‘বুদ্ধিমানের কাজ করছে বাড়ির মালিক। তাওতো বিক্রি কইরা কিছু নগদ টাকা পাইবো, নয়তো পুরা বাড়িইতো পদ্মায় গিয়া পরতো।’
২০০৬ সালের আগস্ট মাসে মুলফৎগঞ্জ বাজারের পাশে প্রতিষ্ঠিত হয় হযরত খাজা মইনউদ্দিন কালু মঞ্জিল। স্থানীয়ভাবে ‘গাজী কালুর মাজার’ বলে পরিচিত এই মাজারের সামনে অংশ পদ্মায়। পুরো ভবন নদীতে চলে যাবার আগে কয়েকশত মানুষ এসেছেন শেষ বারের মতো এখানে। তাদেরই একজন সাব্বির রহমান। তিনি বলেন, ‘এভাবে ভাঙতে থাকলে মানুষ যাবে কোথায়? খাবে কী? এরা তো খোলা আকাশের নিচে জীবনযাপন করছে তারা, এতো মানবেতরভাবে কী বাঁচা যায়’, বলে মাজারের ভেঙে যাওয়া খোলা জায়গায় গিয়ে দাঁড়ান, বিস্ময় নিয়ে সামনে থাকা পদ্মা দেখেন।
স্থানীয়দের সঙ্গে কথা বলে জানা গেল, মুলফৎগঞ্জ বাজার, চর জুজির গাঁও, উত্তর কেদারপুর, দাসপাড়ায় ভাঙন তীব্র হয়েছে। আর তাতে করে মুলফৎগঞ্জ বাজারের ভেতরের দিকে থাকা প্রায় আট শতাধিক দোকান ঝুঁকিতে রয়েছে। ক্ষতিগ্রস্তরা অভিযোগ করে বলেন, ‘পদ্মায় তাদের সব বিলীন হলেও সরকারের পক্ষ থেকে কেউ তাদের দেখছে না, সরকারি সহযোগিতা যাও এসেছে তারও প্রয়োজনের তুলনায় খুবই কম।’
তবে নড়িয়া উপজেলার নির্বাহী কর্মকর্তা সানজিদা ইয়াসমিন বলেন, ‘প্রায় ৩ হাজার ৫১০টি পরিবারকে ৩০ কেজি চাল, ২ হাজার ৪০০ পরিবারকে শুকনো খাবার এবং ৩৫০টি পরিবারকে ৭০০ বান্ডিল টিন এবং ৬ হাজার করে টাকা দেওয়া হয়েছে। আবার সাধুর বাজার এলাকার ভূমি ধসে আহতদের ২০ পরিবারকে দশ হাজার করে আর্থিক সহায়তা করা হয়েছে এবং আরও সহায়তা চেয়ে ঊধ্বর্তন কর্তৃপক্ষের কাছে চাহিদাপত্র পাঠানো হয়েছে।’
পদ্মার ভাঙন ঠেকাতে কী ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে জানতে চাইলে শরীয়তপুর জেলা প্রশাসক কাজী আবু তাহের বলেন, “জাজিরা ও নড়িয়া উপজেলার প্রায় ৯ কিলোমিটার জুড়ে ‘পদ্মার ডান তীর রক্ষা প্রকল্প’ নামে একটি প্রকল্প গত ২ জানুয়ারি জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটির (একনেক) সভায় পাস হয় এবং এর জন্য এক হাজার ৯৭ হাজার কোটি টাকা ব্যয় ধরা হয়েছে। এই প্রকল্প বাস্তবায়নের জন্য ২০২১ সালের মধ্যে সময়ও নির্ধারণ করে দেওয়া হয়েছে।’
কিন্তু গত জুলাই মাসে পদ্মার ভাঙন তীব্র হলে চলতি বছরের জুলাই মাসে সাড়ে ৬ কোটি টাকা বরাদ্দ দেওয়া হয় এবং ১১ জুলাই থেকে ভাঙন রোধ করতে বালু ভর্তি জিও ব্যাগ ফেলা শুরু হয়েছে। কাজী আবু তাহের বলেন, ‘এই জন্য নতুন করে আরও ২ কোটি টাকাও বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। কিন্তু এই জিও ব্যাগ নিয়ে প্রচণ্ড অসন্তোষ প্রকাশ করলেন স্থানীয়রা। তারা বলেন, ‘পাহাড় সমান ইটের বাড়ি গুলা নদী টাইন্যা নিতেছে, সেইখানে এই বালুর ব্যাগ কী করবো, এই বস্তা-মস্তা ফাইলাইয়া কোনও লাভ নাই। যদি সরকার মাঝ নদীতে ড্রেজিংয়ের ব্যবস্থা করতো তাইলে যদি একটা কাজ হইতো’।
সারাবাংলা/জেএ/এমও/জেডএফ