শিক্ষকদের ‘দ্বন্দ্বে’ জাবিতে অচল ভূগোল ও পরিবেশ বিভাগ
১৪ সেপ্টেম্বর ২০১৮ ০৮:৫৪
।। জাবি করেসপন্ডেন্ট ।।
জাবি: জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের (জাবি) ভূগোল ও পরিবেশ বিভাগে গত প্রায় দেড় মাসে একাডেমিক কাউন্সিলের কোনো সভা না হওয়ায় শিক্ষকরা ‘অঘোষিত’ ধর্মঘট পালন করছেন। গত প্রায় দুই সপ্তাহের বেশি সময় ধরে বিভাগটিতে কোনো ক্লাস-পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হচ্ছে না। শুধু তাই নয়, বিভাগের ৪২তম ব্যাচের স্নাতকোত্তর চূড়ান্ত পরীক্ষাও ঝুলে রয়েছে। নেওয়া যাচ্ছে না ২০১৮-১৯ শিক্ষাবর্ষের ভর্তি পরীক্ষার সিদ্ধান্তও।
শিক্ষকরা বলছেন, একাডেমিক সভা ডাকা না হলে প্রয়োজনে তারা ফের বিভাগের সভাপতির অপসারণের জন্য আন্দোলনে নামবেন। অন্যদিকে, এর আগেও বিভাগের সভাপতির পদ থেকে অপসারণ হওয়ার পর আদালতের আদেশে সভাপতির দায়িত্ব পাওয়া অধ্যাপক মো. মনজুরুল হাসান জানান, দায়িত্ব বুঝে নিয়ে ‘যৌক্তিক’ সময়ে একাডেমিক সভা আহ্বান করবেন তিনি।
জানা গেছে, গত ২৬ জুলাই আদালতের আদেশে বিভাগের সভাপতির দায়িত্ব নিয়েছেন অধ্যাপক মো. মনজুরুল হাসান। এদিকে, নিয়ম অনুযায়ী প্রতিমাসে অন্তত একটি একাডেমিক কাউন্সিলের সভা হওয়ার কথা থাকলেও সভাপতির দায়িত্ব নেওয়ার পর এখন পর্যন্ত কোনো সভা ডাকেননি অধ্যাপক মনজুরুল। এ বিষয়ে তিনি বলছেন, আমার দায়িত্ব বুঝে নিতে একটু সময় লাগছে। তাই যৌক্তিক সময়ে আমি এ সভা আহ্বান করব।
তবে বিভাগীয় শিক্ষকরা বলছেন, অধ্যাপক মনজুরুল হাসান দীর্ঘ দিন দায়িত্বে থাকতে পারেননি। তিনিই আবার হাইকোর্টের আদেশে ফিরে এসেছেন। তাই তিনি বিভাগীয় শিক্ষকদের ওপর প্রতিশোধপরায়ণ আচরণ শুরু করে সভা (একাডেমিক কাউন্সিলের সভা) ডাকছেন না। আর সভা না হলে তারা কোনো ধরনের ক্লাস পরীক্ষায় অংশ নেবেন না।
বিভাগের সভাপতি ও শিক্ষকদের এমন মুখোমুখি অবস্থানে বিপাকে পড়েছেন শিক্ষার্থীরা। বিভাগের শিক্ষকদের নতুনভাবে কোর্স বণ্টন করা সম্ভব হচ্ছে না। ২০১৮-১৯ সেশনের ভর্তি পরীক্ষার গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্তও ঝুলে আছে। বন্ধ আছে বিভাগের সান্ধ্যকালীন কোর্সের ক্লাস-পরীক্ষাও।
অধ্যাপক মনজুরুলকে নিয়ে এই দ্বন্দ্বের সূত্রপাত ২০১৫ সালে। ওই বছর বিভাগের ৩৭তম স্নাতকোত্তর ব্যাচের স্নাকতোত্তর পরীক্ষার দায়িত্বে ছিলেন তিনি। নির্দিষ্ট সময়ে এ পরীক্ষা শুরু করতে না পারায় একাডেমিক সভায় তাকে দায়িত্ব থেকে অপসারণ করা হয়। বিভাগীয় সভায় তাকে ২০১৫-১৬ শিক্ষাবর্ষের ভর্তি পরীক্ষাসহ বিভাগের সব দায়িত্ব থেকেও অব্যাহতি দেওয়া হয়।
অধ্যাপক মনজুরুলের বিরুদ্ধে আনীত অভিযোগের প্রাথমিক সত্যতা পায় বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের একটি তদন্ত কমিটি। পরে বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের অধীনে একটি স্ট্রাকচারাল কমিটি গঠন করা হলেও ওই কমিটি কোনো কার্যকরী তদন্ত ও প্রতিবেদন জমা দেয়নি। এরই মধ্যে তদন্ত শেষ হওয়ার আগেই বিশ্ববিদ্যালয়ের ৭৩ অ্যাক্টের ৯(১) ধারা অনুযায়ী ২০১৬ সালের ৬ অক্টোবর অধ্যাপক মনজুরুল হাসানের ওপর বিভাগীয় সভাপতির দায়িত্ব আসে। কিন্তু তদন্ত প্রক্রিয়াধীন থাকায় তাকে এ দায়িত্ব না দিয়ে অধ্যাপক মো. শাহেদুর রশিদকে ভারপ্রাপ্ত সভাপতির দায়িত্ব দেওয়া হয়।
পরে অধ্যাপক মনজুরুলকে কেন সভাপতির দায়িত্ব দেওয়া হলো না— এ মর্মে তিনি নিজেই হাইকোর্টে আরেকটি রিট করেন। সর্বশেষে, অধ্যাপক মনজুরুল হাসানকে সভাপতির পদে দায়িত্ব দিতে ২২ জুলাই হাইকোটের্র একটি দ্বৈত বেঞ্চ বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনকে নির্দেশ দেন। সেই নির্দেশ অনুযায়ী ২৬ জুলাই বিভাগের সভাপতির দায়িত্ব নেন অধ্যাপক মনজুরুল। তবে এরপর থেকে তিনি এখনও একাডেমিক কাউন্সিলের কোনো সভা ডাকেননি।
এর মধ্যে সোমবার বিভাগের ২০ শিক্ষক একাডেমিক কমিটির সাধারণ সভা ডাকার জন্য লিখিত অনুরোধ জানান। শিক্ষকরা বলছেন, সভাপতি একাডেমিক সভা না ডাকলে তারা তার বিরুদ্ধে রিকুইজিশন আহ্বান করবেন। প্রয়োজনে অধ্যাপক মনজুরুলের অপসারণের দাবিতে টানা আন্দোলনে যাবেন তারা।
বিভাগের একজন সিনিয়র শিক্ষক নাম প্রকাশ না করার শর্তে সারাবাংলাকে বলেন, ‘বিশ্ববিদ্যালয়ের নিয়ম অনুযায়ী, প্রতিমাসে একাডেমিক কমিটির কমপক্ষে একটি মিটিং ডাকতে হয়। কিন্তু অধ্যাপক মনজুরুল দায়িত্ব নেওয়ার পর কোনো মিটিং হয়নি। আমাদের বিভাগে সভাপতি ছাড়া ২১ জন শিক্ষক আছেন। এর মধ্যে আমরা ২০ জন একাডেমিক কমিটির মিটিং ডাকার জন্য লিখিতভাবে আবেদন করেছি। কিন্তু মিটিং ডাকা হয়নি। বিভাগের বেশ কয়েকজন শিক্ষক ছুটি কাটিয়ে ফিরেছেন। তারা কোর্স পাচ্ছেন না। বিভাগের অন্যান্য কার্যক্রমও থমকে আছে।’
সভাপতি হিসেবে দায়িত্ব নেওয়ার পর অধ্যাপক মনজুরুল নিজেও ক্লাস নিচ্ছেন না জানিয়ে ওই শিক্ষক আরও বলেন, আমাদের দাবি একটাই— একাডেমিক কমিটির মিটিং। তবে সভাপতি ক্লাস নেওয়া শুরু করলে আমরাও ক্লাসে ফিরে যাব।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে বিভাগের সভাপতি অধ্যাপক মো. মনজুরুল হাসান সারাবাংলাকে বলেন, ‘ক্লাস-পরীক্ষা নেবে না বলে তারা (আন্দোলনকারী শিক্ষকরা) আমাকে লিখিতভাবে জানাননি। শিক্ষার্থীদের জিম্মি করে যদি শিক্ষকরা ক্লাস-পরীক্ষা না নেন, তবে সেটা হবে অমানবিক।’ তিনি আরও বলেন, আমি বিভাগের সব কিছু বুঝে ‘যৌক্তিক সময়ে’ একাডেমিক সভা আহ্বান করব।
এ বিষয়ে জানতে উপাচার্য অধ্যাপক ড. ফারজানা ইসলামকে ফোন দেওয়া হলেও তিনি রিসিভ করেননি। পরে বিশ্ববিদ্যালয়ের উপউপাচার্য (শিক্ষা) অধ্যাপক মো. নুরুল আলমের সঙ্গে যোগযোগ করা হলে তিনি বলেন, ‘প্রশাসনের পক্ষ থেকে আমরা সর্বোচ্চ চেষ্টা করছি যেন শিক্ষার্থীরা ভোগান্তির শিকার না হয়।’
সারাবাংলা/টিআই/টিআর