চিকিৎসকের ‘অসর্তকতায়’ ২টি কিডনিই হারালেন রোগী!
২২ সেপ্টেম্বর ২০১৮ ১৭:০৫
।। স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট ।।
ঢাকা: চিকিৎসকের ‘অসর্তকতা’য় চিকিৎসাধীন থাকার রোগীর দু’টি কিডনিই খোয়া যাওয়ার মতো ঘটনা ঘটেছে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ে। ঘটনা তদন্তে বিশ্ববিদ্যালয়ের পক্ষ থেকে তদন্ত কমিটিও গঠন করা হয়েছে। চিকিৎসকরা বলছেন, ‘আগে থেকে সতর্ক থাকলে এ ধরনের ঘটনা ঘটতো না। দে ক্যান সেইভ ইফ দে প্ল্যানড আর্লিয়ায়।’ তবে অস্ত্রোপচারকারী চিকিৎসক অধ্যাপক হাবিবুর রহমান বলেন, ‘কিডনি যাবে কোথায়, অবশ্যই আছে।’
রোগী রওশন আরার ছেলে রফিক সিকদার সারাবাংলাকে জানান, বাম পাশের কিডনির জটিলতা নিয়ে তার মাকে গত ২৬ আগস্ট বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি করানো হয়। মূত্রথলির নালিতে পাথর হয়ে ব্লক হয়ে গিয়েছিল। ভর্তি করার পর বেশ কিছু পরীক্ষা হবার পর গত ৫ সেপ্টেম্বর অস্ত্রোপচার করার সিদ্ধান্ত নেন চিকিৎসকরা। তখনকার রিপোর্ট অনুযায়ী বাম কিডনি তখনো কিছুটা কাজ করছিল, আর ডান পাশের কিডনি সম্পূর্ণ ভালো ছিল।
রফিক বলেন, “বিশ্ববিদ্যালয়ের চিকিৎসক ইউরোলজি বিভাগের অধ্যাপক আমাকে বলেন, ‘বাম পাশের কিডনি রাখতেই চাই না, একটা কিডনি নিয়ে মানুষ বছরের পর বছর বেঁচে থাকে।’ এরপর গত ৫ সেপ্টেম্বর তার অস্ত্রোপচার হয়। এরপর মাকে পোস্ট অপারেটিভে নেওয়া হলে দেখতে পাচ্ছিলাম মায়ের শরীর ফুলে যাচ্ছে, তার জ্ঞান ছিল। কিন্তু তার প্রস্রাব হচ্ছিল না, ক্যাথাটার লাগানো ছিল, কিন্তু তিনি প্রস্রাব করছিলেন না-এটা দায়িত্বরত চিকিৎসক আমাকে জানালেন।’
‘এরপর রাত সাড়ে আটটার পর বলা হলো, আইসিইউ সার্পোট লাগবে। কিন্তু তখন বিএসএমএমইউতে আইসিইউ না থাকায় তারা আমাদের বেসরকারিতে খোঁজ নিতে বলেন। হাসপাতাল থেকে বলা হলো, রোগীর ইউরিন তৈরি হচ্ছে না, যেকোনও সময় তার অবস্থা খারাপ হতে পারে, আইসিইউ লাগতে পারে। দেখলাম বমি হচ্ছে যা দেখে আমি চিন্তিত হই এবং আইসিইউতে নিতে বলায় খটকা লাগে। এরপর মাকে মগবাজারের ইনসাফ বারাকা হাসপাতালের আইসিইউতে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকরা দেখে তাকে সিটিস্ক্যান করার পরামর্শ দিলে ধানমন্ডির একটি বেসরকারি হাসপাতালে তখনই নিয়ে তার সিটি স্ক্যান হয়’, বলেন রফিক।
রফিক সিকদার বলেন, ‘ওখানে সিটি স্ক্যান রির্পোট দেখে সেখান থেকেই আমাকে বলা হয়, আমরা একটি কিডনিও দেখতে পাচ্ছি না। আমি তাদের বলি, একটা ফেলে দিয়েছে এবং আরেকটি আছে। তারা জোর দিয়ে বলেন, আপনার মায়ের পেটে কোনও কিডনিই নেই। সেখানে তারা বিষয়টি নিয়ে বোর্ড করে এবং অস্ত্রোপচারের আগের সব পরীক্ষার রির্পোট দেখাই। তখন তারা নিশ্চিত হন, তার দুটি কিডনিই ছিল, যদিও বাম পাশেরটি খারাপ ছিল কিন্তু ডান পাশেরটি একেবারেই ভালো ছিল।’
‘রিপোর্ট নিয়ে আবার ইনসাফ বারাকা হাসপাতালে গেলে বলা হয়, যেহেতু তার কিডনিই পাওয়া যাচ্ছে না, তাই যেখানে তার অস্ত্রোপচার হয়েছে সেখানেই আবার যেতে। ওখানে অধ্যাপক ফখরুল আমার সামনেই কথা বলেন অধ্যাপক হাবিুর রহমানের সঙ্গে। তিনিও যেতে বললে আমরাও যাই। সেখানে যাওয়ার পর তার সমস্যা এবং ক্রিয়েটিনিন বেড়ে যাবার বিষয়টি জানালে অধ্যাপক হাবিবুর রহমান জানালেন ডায়ালাইসিস করার জন্য। মায়ের ভালো কিডনিও সিটি স্ক্যানে কেন আসেনি জানতে চাইলে তিনি আমাকে বলেন, ‘আপনি ডাক্তারদের সঙ্গে পরামর্শ করে বিভ্রান্ত হবেন না, অন্য কোনও হাসপাতালের রির্পোট নিয়ে বিভ্রান্ত হওয়ার সুযোগ নেই, আপনি ধৈর্য্য ধরেন’।
তিনি আমাকে বলেন, ‘আমরা চেষ্টা করছি এবং ডায়ালাইসিস করবো। কিডনিই যদি পেটে না থাকে তাহলে ডায়ালাইসিস করে কতদিন তাকে বাঁচিয়ে রাখা যাবা প্রশ্নে তিনি আবারও বলেন, আপনার মায়ের পেটে কিডনি আছে। যদি কিডনি কাজ না করে তাহলে ডায়ালাইসিস করে কতদিন বাঁচিয়ে রাখা যাবে প্রশ্ন করলে তিনি বলেন, তখন আমরা কিডনি প্রতিস্থাপন করে দেব। তাকে কিডনি প্রতিস্থাপনের জটিলতার কথা জানালে তিনি উত্তর দেন, তখন দেখা যাবে।’
আগের রিপোর্ট, যেখানে ডান পাশে কিডনি রয়েছে।
রফিক আরও বলেন, ‘সেদিন থেকে তার ডায়ালাইসিস শুরু হলেও তার ক্রিয়েটিনিন কমছিল না, আরও জটিলতা তৈরি হয়, তার শারীরিক অবস্থার অবনতি হয়। তখন আমরা অধ্যাপক ডা. এম এ সামাদ সাহেবের কাছে নিয়ে যাই মাকে। তিনি আগের সব রির্পোট এবং তিনি আরও কিছু পরীক্ষা করে বললেন, আমার মায়ের পেটে কোনও কিডনিই নেই।’
এটা কী করে হতে পারে প্রশ্নে তিনি জোর দিয়ে বলেন, ‘এটাই হয়েছে। চিকিৎসা দিয়ে ভালো করতে পারবো না। কিন্তু যারা অস্ত্রোপচার করেছে তাদের কাছে জবাব চাওয়া যায়। আমি তখনই বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ে আবার চলে আসি। হাসপাতালের পরিচালকের সঙ্গে কথা বলি সব রির্পোট নিয়ে। তিনি আমার সামনেই কথা বলেন অধ্যাপক হাবিবুর রহমানে সঙ্গে। তারা কথা বলেন এবং উপাচার্যের সঙ্গে দেখা করতে পরদিন যাই কিন্তু তাকে পাইনি।’
অধ্যাপক ডা. এম এ সামাদ বলেন, ‘অস্ত্রোপচারের পর কিডনি কাজ না করলেও সিটিস্ক্যানে কিডনি শো করবে। কিন্তু তার ক্ষেত্রে কোনও কিডনিই শো করছে না। মানুষ তাহলে চিকিৎসার জন্য যখন পরীক্ষা করায় তখন তো খারাপ কিডনিও শো করে সিটিস্ক্যানে, নয়তো আমরা চিকিৎসা কীভাবে করি।’
শনিবার (২২ সেপ্টেম্বর) বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ে গিয়ে চিকিৎসাধীন রওশন আরার সঙ্গে কথা হয় প্রতিবেদকের। তিনি বলেন, ‘অপারেশন করার আগে প্রস্রাব হয়েছে, অথচ এই এতোদিন ধরে প্রস্রাব হচ্ছে না। পাশে থাকা তার বোন জাহেদা বলেন, রওশন আরার পুরো শরীর ফুলে গিয়েছে, ফুলে গিয়েছে পা।’
কিডনি থাকা না থাকা এবং প্রস্রাব না হওয়া নিয়ে কথা হয় একাধিক বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের সঙ্গে। তারা বলেন, ‘যদি কিডনি থাকতো তাহলে রোগীর প্রস্রাব হতো, কিডনি নেই বলে প্রস্রাব উৎপন্ন হচ্ছে না। কাউন্সিলিং, ম্যানেজমেন্ট কোথাও না কোথাও অবশ্যই এ ঘটনায় ঘাটতি রয়েছে।’
তবে অনুসন্ধানে জানা যায়, রওশন আরা ‘ঘোড়ার খুর’ আকৃতির মতো জোড়া কিডনি নিয়ে জন্ম নিয়েছিলেন। সাধারণত এ ধরনের কিডনির কোনো একটি ফেলতে হলে দুটিই ফেলতে হয়। তাই প্রয়োজন পড়ে কিডনি প্রতিস্থাপনের- এ ধরনের কোনও পূর্ব প্রস্তুতি না থাকায় এ পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে।
জন্মগতভাবে দুই কিডনি একসঙ্গে লাগানো ছিল। চিকিৎসা বিজ্ঞানের ভাষায় একে ‘হর্স শু কিডনি’ (ঘোড়ার খুরের মতো একসঙ্গে লাগানো বা ঘোড়ার খুরাকৃতি) বলা হয়। যখন একসঙ্গে জোড়া লাগানো থাকে, তখন একটি কিডনি অস্ত্রোপচার করে ফেলে দেওয়ার সময় বাকি কিডনির রক্তপাত হতে পারে। কিডনি রাখলে কাজ করবে না এবং রক্তপাত থামানো যাবে না। তখন তার ভালো ডান পাশের কিডনিটিও ফেলে দিতে হয় এবং আন্তর্জাতিকভাবেও তাই নিয়ম।
কিন্তু এ ক্ষেত্রে তখন চিকিৎসকদের উচিত ছিল রোগীর স্বজনদের এ বিষয়ে কাউন্সিলিং করানো এবং তাদের বিষয়টি সর্ম্পূণ জানানো যে, ‘জোড়া কিডনি বলে সেটি রাখা সম্ভব না। জোড়া কিডনি হলেও যদি কোনও ধরনের জটিলতার তৈরি না হয় তাহলে মানুষ বছরের পর বেঁচে থাকতে পারে, কিন্তু চিকিৎসকরা সেটি করেননি।’
এ ধরনের জটিলতা ইচ্ছে করলেই এড়ানো যেত, কেবলমাত্র চিকিৎসকের অসর্তকতার জন্য রোগী রওশন আরার এ অবস্থা হয়েছে।
জানতে চাইলে ইউরোলজি বিভাগের অধ্যাপক ডা. হাবিবুর রহমান দুলাল সারাবাংলাকে বলেন, ‘২০১৬ সালে তার (রওশন আরা) বাম দিকের কিডনিতে একবার পাথরের অস্ত্রোপচার হয়। ৭ মাসে আগে তার বাম পাশের কিডনিতে আবার অস্ত্রোপচার করে পুঁজ বের করে নল লাগিয়ে দেওয়া হয়। কিন্তু তার ইনফেকশন কমলেও বাম কিডনি কাজ করছিল না।’
গত ৫ সেপ্টেম্বরের অস্ত্রোপচার নিয়ে তিনি বলেন, ‘বামদিকে ইনফেকশন হয়ে তখন এমন হয়েছিলো যে রক্তনালি, খাদ্যনালি, কিডনি বোঝা খুব কঠিন হয়ে গিয়েছিল। তখন প্রচণ্ড রক্তপাত হয়ে খুব খারাপ অবস্থা হয়ে যায় তার। পরে রক্তক্ষরণ বন্ধ করা হয়। পোস্ট অপারেটিভে নেওয়ার পর তার প্রস্রাব না হওয়াতে আমাকে জানানো হয়। চিকিৎসকদের বলি, এরকম রক্তক্ষরণ হলে কিডনির রক্তসরবরাহ বন্ধ হয়ে কিডনি সাময়িক অকেজো হয়ে যায়। রাত ১টার দিকে তার শ্বাসকষ্ট হচ্ছে বলে আবার জানানো হয়। তাদের আইসিইউতে স্থানান্তরের কথা বলি, কিন্তু রোগীর স্বজনরা বোধহয় এখানে সাড়া না পেয়ে বাইরে চলে যায়।’
‘বেসরকারি হাসপাতালে সিটি স্ক্যান করা হয়েছে। পরীক্ষাতে কিন্তু ‘নন ভিজ্যুয়ালাইজেশন অব রাইট কিডনি’ এসছে, আর বাম পাশের কিডনি তো ফেলেই দিয়েছি। রক্ত সরবরাহ বন্ধ হয়ে গেলে কিডনি সাময়িক বিকল হয়ে যেতে পারে অনেক সময় স্থায়ীভাবেও বিকল হয়ে যেতে পারে। বর্তমানে আমরা আপাতত ডায়ালাইসিস করছি’, যোগ করেন ডা. হাবিবুর।
অধ্যাপক ডা. হাবিবুর রহমান বলেন, ‘রোগীর স্বজনদের মাথায় কেউ ঢুকিয়েছে আমরা ডান দিকের কিডনিও ফেলে দিয়েছি। কিন্তু ডান দিকের কিডনি অপারেশনের জন্য আলাদা অস্ত্রোপচারের প্রস্তুতি নিতে হয়।’
‘ডান দিকের কিডনি আছে নাকি নেই’ প্রশ্নে তিনি বলেন, ‘রির্পোট অনুযায়ী নন ভিজ্যুয়ালাইজেশন, এখানে আইদার অবসেন্ট অথবা কাজ করছে না, নন ভিজ্যুয়ালাইজেশন মানে তাই’- বলেন অধ্যাপক ডা. হাবিবুর রহমান।
এখন কী তার কিডনি আছে নাকি নেই আবার প্রশ্ন করলে তিনি বলেন, ‘আমরা পরীক্ষা করি নাই।’ কেন করেননি প্রশ্নে তিনি বলেন, ‘যখন শরীরের কোনও অর্গানের অস্ত্রোপচার করা হয় তখন দুই থেকে তিন সপ্তাহ আগে থেকে সেখানে ভালোভাবে বোঝা যায় না।’
রোগীর কিডনি ‘হর্স শু শেপ’ ছিল কিনা জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘এরকম একটা সম্ভবনা হতে পারে, কিন্তু তাতেও ডানদিকে কিডনিতে আমাকে যেতে হবে।’
‘কিডনি তাহলে আছে কিনা’ ফের প্রশ্নে অধ্যাপক হাবিবুর রহমান বলেন, ‘অবশ্যই কিডনি আছে। যাবে কোথায় প্রশ্ন করে তিনি বলেন, ‘আমরাতো বাম দিকে অস্ত্রোপচার করেছি।’
সারাবাংলা/জেএ/এমও