বিরল রোগে গৃহবন্দি ভাইবোন, চিকিৎসার সামর্থ্য নেই পরিবারের
২৫ সেপ্টেম্বর ২০১৮ ০৯:৫৯
।। হৃদয় দেবনাথ, ডিস্ট্রিক্ট করেসপন্ডেন্ট ।।
মৌলভীবাজার: মৌলভীবাজারের কমলগঞ্জ উপজেলার প্রত্যন্ত গ্রাম তিলকপুর। এই গ্রামেই স্ত্রী এবং ছয় সন্তান নিয়ে দরিদ্র কৃষক ফকরুল ইসলামের বসবাস। তার দুই সন্তান ছালেকিন (১৮) ও রিমা (১৫) বিরল রোগে আক্রান্ত। দিনে দিনে আরও জটিল আকার ধারণ করা রোগটিতে গৃহবন্দি ভাইবোনের চিকিৎসা করার সামর্থ্য নেই তাদের বাবা ফখরুলের।
ফখরুল জানান, তার ছেলেমেয়েদের মুখমণ্ডল এখন বিকৃত আকার ধারণ করেছে। যন্ত্রণায় ছটফট করছে তারা। ঘরের বাইরেও বের হতে পারছে না। কিন্তু টাকার অভাবে তাদের চিকিৎসা করাতেও পারছেন না তিনি।
ফখরুল জানান, তিন-চার বছর বয়স থেকেই তার দুই ছেলেমেয়ে অদ্ভুত ধরনের রোগে আক্রান্ত। দিন যত যাচ্ছে তাদের রোগটি আরও জটিল হচ্ছে। অভাবের সংসার । তাই হাসপাতালে নিতে না পারলেও স্থানীয় কবিরাজ দিয়েই চিকিৎসা করান। কিন্তু কবিরাজের চিকিৎসায় কোনো উন্নতি না হওয়ায় একেবারেই ভেঙে পড়েছেন ফকরুল এবং তার স্ত্রী শিরি বেগম।
রোগটি বেড়ে গিয়ে তাদের মুখমণ্ডল এখন বিকৃত আকার ধারণ করেছে। তাই সচরাচর লজ্জায় মানুষের সামনে যায় না তারা। দীর্ঘদিন ধরে অনেকটা গৃহবন্দি অবস্থায় আছে এই দুই ভাই-বোন।
ছালেকীন আর আর রিমার মা শিরি বেগম জানান, প্রথম পর্যায়ে ছালেকীনের মুখে একটি ক্ষতচিহ্ন ও সাদা সাদা দাগ দেখতে পান। কিন্তু ধীরে ধীরে তা মারাত্মক আকার ধারণ করে। একপর্যায়ে সমস্ত শরীরে ছড়িয়ে পড়ে। ভাই-বোন কেউই এখন আর শক্ত খাবার খেতে পারে না। তাই তরল জাতীয় খাবার খেয়েই জীবন চলে তাদের। মেয়ে রিমার শরীর ও মুখেও প্রথম অবস্থায় ছালেকীনের মতোই কিছু সাদা সাদা দাগ ছিল। ধীরে ধীরে তা সমস্ত মুখে ও শরীরে ছড়িয়ে পড়লে একপর্যায়ে তা কালো বর্ণ ধারণ করেছে। এখন সে আলোতে ঠিকমতো তাকাতে পারে না। ছালেকীনের মুখমণ্ডল ও শরীরেও রোগটি বেড়ে গিয়ে ভয়ঙ্কর আকার ধারণ করেছে। এই অবস্থায় ঘরের বাইরে চলাফেরাও কষ্টসাধ্য হয়ে পড়েছে। দুজনের কেউই সূর্যের আলো সহ্য করতে পারে না বলে জানান পিতা ফখরুল। দীর্ঘদিন ধরে ভয়ঙ্কর এ রোগের সাথে অনেকটা যুদ্ধ করেই বেঁচে আছে তারা।
ফখরুল ইসলাম বলেন, স্থানীয় এক ডাক্তারের কাছে নিয়ে গেলে তিনি রোগটি শনাক্ত করতে পারেননি।
তিনি বলেন, ‘অভাবের সংসারে নুন আনতে পান্তা ফুরায় সন্তানদের কি করে সুস্থ করে তুলি। নিজের চোখের সামনে ছেলেমেয়ে ব্যাথায় তীব্র আর্তনাদ আর সইতে পারছি না! মাঝে মধ্যে আল্লাহকে ডাকি তিনি যেন আমাকে নিয়ে নেয়,চোখের সামনে সন্তানের এ কষ্ট-যন্ত্রনা পিতা হয়ে কী করে সহ্য করি বলেন? তাদের মুখমণ্ডল এখন এমন বিকৃতরূপ ধারণ করেছে যে দুই ভাই-বোনের মধ্যে কেউই এখন আর ঘর থেকে বের হন না।’
‘বহুবছর ধরে অনেকটা ঘরবন্দি অবস্থায়ই বসবাস করছে তারা। ওদের যন্ত্রণা দেখলে আর বেঁচে থাকতে ইচ্ছে করে না। না। একদিকে রোগের যন্ত্রণা অন্যদিকে সংসারের অভাব-অনটনে চিকিৎসার অভাবে মৃত্যুর দিকে এগিয়ে যাচ্ছে ছালেকীন আর রিমা।’
সারাবাংলার প্রতিবেদকের সঙ্গে কথা বলার সময় কান্নায় ভেঙে পড়েন ফখরুল। নিজেকে সামলে নিয়ে বলেন, ‘ছয় ভাই-বোনের মধ্যে ছালেকীন দ্বিতীয় এবং রিমা তৃতীয়। পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তিই ফখরুল ইসলাম (৫০)। কৃষিকাজ করে আটজনের সংসার চালানোই তার পক্ষে কঠিন। এ অবস্থায় সন্তানদের চিকিৎসা করানোটা তার কাছে স্বপ্নের মতো।
স্থানীয়রা জানায়, ডাক্তারের কাছে নিয়ে গিয়ে চিকিৎসা করানোর সামর্থ্যও নেই হতদরিদ্র কৃষক ফখরুলের। প্রায় রাতেই যন্ত্রণায় চিৎকার করে দুই ভাই-বোন। ফখরুলের নিজস্ব কোনো জমি জমাও নেই যে তা বিক্রি করে সন্তানদের চিকিৎসা করাবে।
সম্প্রতি স্থানীয়দের সহযোগিতায় সিলেট ওসমানী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে যান। সেখানে কিছুদিন চিকিৎসার পর ডাক্তাররা সঠিকভাবে রোগটি শনাক্ত করতে পারেনি তাই তারা দুজনকেই ঢাকা অথবা ভারতে নিয়ে গিয়ে চিকিৎসা করানোর পরামর্শ দেন।
এ রোগের বিষয়ে জানতে চাইলে কমলগঞ্জ হাসপাতালের চিকিৎসক ডা. সৈয়দ শওকত আলী জানান, এটি জিনগত সমস্যা হতে পারে। রোগীর চামড়ার কোষে মেলানিন না থাকায় সূর্যের আলোর অতিবেগুনী রশ্মিতে কোষের ডিএনএ নষ্ট হয়ে যায়। ক্রমাগত অতিবেগুনী রশ্মির সম্মুখীন হলে ডিএনএ নষ্ট হয়ে ক্যানসার হতে পারে। প্রাথমিকভাবে তিনি ধারণা করছেন রোগটি Xeroderma Pigmentosam হতে পারে। এটি একটি বিরল ধরনের রোগ। ছেলে ও মেয়েটিকে সঠিক রোগ নির্ণয় ও চিকিৎসার জন্য ঢাকা মেডিকেল কলেজ অথবা পিজি হাসপাতালে পাঠানো যেতে পারে।
বিষয়টি কমলগঞ্জ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মাহমুদুল হকের নজরে আনলে তিনি সারাবাংলাকে জানান, সম্প্রতি এদের রোগের বিষয়টি আমি জেনেছি, ডাক্তারদের বলেছি বিষয়টা দেখতে। আমাদের পক্ষ থেকে সার্বিক সহযোগিতা করা হবে।
সারাবাংলা/এইচডি/জেডএফ