বন্যপ্রাণী হত্যা নয়, শিক্ষার্থীদের শেখাচ্ছে চট্টগ্রাম চিড়িয়াখানা
২৮ সেপ্টেম্বর ২০১৮ ১১:২৪
।। স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট ।।
চট্টগ্রাম ব্যুরো: দেশজুড়ে নির্বিচারে ধ্বংস হচ্ছে বনাঞ্চল। ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে বন্যপ্রাণীর আবাসস্থল। খাবারের সন্ধানে লোকালয়ে এসে পড়ছে হাতি, হরিণ, অজগরসহ বিভিন্ন বন্যপ্রাণী। লোকালয়ে আসা বন্যপ্রাণীর সহিংস আচরণের শিকার হচ্ছে মানুষ। আবার মানুষের হাতে মারা পড়ছে বন্যপ্রাণী। এর ফলে বিলুপ্ত হতে বসেছে অনেক বন্যপ্রাণী।
মানুষ এবং বন্যপ্রাণীর মধ্যে এই দ্বান্দ্বিক অবস্থা যেন অব্যাহত না থাকে, প্রজন্মের মধ্যে যেন বন্যপ্রাণীর প্রতি মমত্ববোধ তৈরি হয়, সেজন্য একটি বিশেষ কর্মসূচি হাতে নিয়েছে চট্টগ্রাম চিড়িয়াখানা কর্তৃপক্ষ। তাদের এই উদ্যোগে শামিল হয়েছে বাংলাদেশ জু এন্ড ওয়াইল্ড লাইফ ওয়েলফেয়ার এসোসিয়েশনও।
সপ্তাহে একদিন চট্টগ্রাম নগরী ও আশপাশের এলাকার একটি করে স্কুলের শিক্ষার্থীদের এনে বন্যপ্রাণী সম্পর্কে ধারণা দিয়ে তাদের রক্ষার তাগিদ জানানোর উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। বৃহস্পতিবার (২৭ সেপ্টেম্বর) থেকে এই কার্যক্রম শুরু হয়েছে। তাদের উদ্যোগের মূলকথা হচ্ছে, ‘বন্যপ্রাণী হত্যা নয়, তাদের জীবন বাঁচান।’
দেশের চিড়িয়াখানাগুলোর মধ্যে প্রথম চট্টগ্রাম চিড়িয়াখানা কর্তৃপক্ষ ব্যতিক্রমী এই উদ্যোগ নিয়েছে।
চট্টগ্রাম চিড়িয়াখানার ভারপ্রাপ্ত কিউরেটর ডা.শাহাদাৎ হোসেন শুভ সারাবাংলাকে বলেন, চিড়িয়াখানা মানে শুধু বন্যপ্রাণী দেখিয়ে বিনোদন পাওয়া কিংবা টাকা আয় করা হয়। চিড়িয়াখানা কিংবা সাফারি পার্কগুলোর তিনটি উদ্দেশ্য আছে। প্রাণী সংরক্ষণ, গবেষণা এবং শিক্ষা হচ্ছে চিড়িয়াখানা প্রতিষ্ঠার মূলনীতি। আমরা বন্যপ্রাণী দেখিয়ে বিনোদন ও টাকা আয়ের সেই চিরাচরিত প্রথা থেকে বেরিয়ে আসতে চাই। সেজন্য কোমলমতি শিক্ষার্থীদের মাঝে বন্যপ্রাণী সংরক্ষণের বিষয়ে ধারণা তৈরির উদ্যোগ নিয়েছি।
বৃহস্পতিবার দুপুরে প্রথমদিনে নগরীর নিউ ঝাউতলা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ৩৭ শিক্ষার্থীকে নেওয়া হয় চট্টগ্রাম চিড়িয়াখানায়। তাদের পুরো চিড়িয়াখানা ঘুরিয়ে বন্যপ্রাণীগুলো দেখানো হয়। প্রত্যেক খাঁচার সামনে দাঁড় করিয়ে সেখানে রাখা প্রাণী সম্পর্কে প্রথমে ধারণা দেন শাহাদাৎ হোসেন শুভ ও চট্টগ্রাম ভেটেরিনারি এন্ড অ্যানিমেল সাইন্সেস বিশ্ববিদ্যালয়ের মেডিসিন ও সার্জারি বিভাগের প্রভাষক ডা.প্রণব পাল।
চিড়িয়াখানা পরিদর্শন শেষ হওয়ার পর বন্যপ্রাণী হত্যা না করে তাদের সংরক্ষণের বিষয়ে উদ্বুদ্ধ করে বক্তব্য দেন তারা।
এসময় শাহাদাৎ হোসেন শুভ সুন্দরবনের উদাহরণ তুলে ধরে বলেন, বর্তমানে সুন্দরবনে ১০৬টির মতো বাঘ আছে। একসময় আরও বেশি বাঘ ছিল। কিন্তু সেগুলোর বসবাস বিভিন্নভাবে সুন্দরবনে বিপন্ন করে তোলা হয়েছে অথবা হত্যা করা হয়েছে। বাঘ কমে যাওয়ায় মানুষ নির্বিঘ্নে বনে ঢুকে যাচ্ছে। বনাঞ্চল উজাড় করছে। এতে অন্যান্য প্রাণীরও আবাসস্থল নষ্ট হচ্ছে।
বাংলাদেশ জু এন্ড ওয়ার্ল্ড লাইফ ওয়েলফেয়ার সোসাইটির উপদেষ্টা ডা.প্রণব পাল বলেন, আমরা প্রায়ই দেখি, বন থেকে হাতি লোকালয়ে এসে বাড়িঘরে, ফসলের ক্ষেতে হামলা করছে। মানুষ ক্ষুব্ধ হয়ে হাতি মেরে ফেলছে। অজগর সাপ মেরে ফেলছে। হরিণও মারা হচ্ছে। এতে করে এসব বন্যপ্রাণী বিলুপ্তির পর্যায়ে পৌঁছে যাচ্ছে। বাঘডাস, শিয়ালের মতো প্রাণী পর্যন্ত দেশে বিলুপ্ত হয়ে যাচ্ছে। জ্ঞানের অভাবে মানুষ নির্বিচারে সেসব প্রাণীকেও হত্যা করছে।
শিক্ষার্থীদের উদ্দেশে তারা বলেন, যদি কোথাও এই ধরনের প্রাণীর দেখা পাওয়া যায়, কোনোভাবেই তাদের আঘাত করা যাবে না। এমনকি একটি কুকুরের শরীরেও যেন হাত না উঠে। বন্যপ্রাণী ধরা পড়লে চিড়িয়াখানা কিংবা স্থানীয় বন কর্মকর্তাদের সঙ্গে যোগাযোগ করে তাদের হাতে দিতে হবে। আহত অবস্থায় পাওয়া গেলেও সেটিকে বাঁচানোর উদ্যোগ নিতে হবে। না হলে অচিরেই বাংলাদেশ বন্যপ্রাণী-শূন্য হয়ে পড়বে।
চিড়িয়াখানায় আসা পঞ্চম শ্রেণীর শিক্ষার্থী আসমা খাতুন সারাবাংলাকে বলেন, আমি আগেও একবার চিড়িয়াখানায় এসেছিলাম। তখন শুধু প্রাণী দেখে চলে গিয়েছিলাম। আজ অনেক কিছুই জানতে পারলাম। এখানে এসে খুব ভালো লাগছে।
একই শ্রেণীর ছাত্র তাজুল ইসলাম সারাবাংলাকে বলেন, আমরা শিক্ষা নিয়েছি, একটা কুকুর পর্যন্ত কোনদিন মারব না। সাপ কিংবা অন্য কোন প্রাণী দেখলে সেটাকে নির্বিঘ্নে চলে যাবার সুযোগ করে দেব। কোন প্রাণী ধরা পড়লে সেটাকে চিড়িয়াখানায় নিয়ে আসব।
শাহাদাৎ হোসেন শুভ সারাবাংলাকে বলেন, প্রতি সপ্তাহের বৃহস্পতিবার আমরা এই প্রোগ্রাম করব। আমাদের টার্গেট হচ্ছে অপেক্ষাকৃত সুবিধা-বঞ্চিত, গরীব-নিম্নবিত্ত পরিবারের ছাত্রছাত্রীরা। অভিজাত পরিবার এবং বয়স্কদের মোটিভেট করা যাবে না। সমাজের বড় অংশ যাদের বন্যপ্রাণী নিয়ে বিভিন্ন পরিস্থিতির মুখোমুখি হতে হয়, সেই প্রজন্মের মধ্যে আমরা প্রাণীর প্রতি মমত্ববোধ জাগাতে চাই।
একইসঙ্গে বন্যপ্রাণী নিয়ে গবেষণার জন্য চট্টগ্রাম চিড়িয়াখানায় প্রাণী জাদুঘর তৈরির কাজও এগিয়ে যাচ্ছে বলে জানিয়েছেন ডা.শুভ। ইতোমধ্যে বাঘ ও সাম্বার হরিণের কঙ্কাল তৈরির কাজ প্রায় শেষ হয়েছে। সিংহের কঙ্কালও তৈরি হচ্ছে। এছাড়া চমড়া বসিয়ে এমনভাবে বিভিন্ন কাঠামো তৈরি হচ্ছে যাতে দেখে মনে হবে একেকটি জীবন্ত প্রাণী বসিয়ে রাখা হয়েছে।
জাদুঘর থেকে এই বছরের মধ্যেই ২০টি প্রকাশনা বের করার পরিকল্পনা আছে বলেও জানিয়েছেন এই কর্মকর্তা।
সারাবাংলা/আরডি/এনএইচ