বাকস্বাধীনতায় ভূমিকম্প হয়ে গেছে: ড. শাহদীন মালিক
২৯ সেপ্টেম্বর ২০১৮ ১৭:০৮
।। সিনিয়র করেসপন্ডেন্ট।।
ঢাকা: সম্প্রতি জাতীয় সংসদে পাশ হওয়া ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে বাকস্বাধীনতায় এক ধরনের ভূমিকম্প হয়ে গেছে বলে মন্তব্য করেছেন সুপ্রিমকোর্টের আইনজীবী ড. শাহদীন মালিক।
তিনি বলেছেন, এ আইন বাস্তবায়ন হলে দেশে বাক স্বাধীনতা বলে আর কিছু থাকবে না।
শনিবার (২৯ সেপ্টেম্বর) ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটির সাগর-রুনি মিলনায়তনে ‘ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন ২০১৮: আশঙ্কায় মৌলিক অধিকার’ শীর্ষক আলোচনা সভায় তিনি এ মন্তব্য করেন।
মৌলিক অধিকার সুরক্ষা কমিটি নামে একটি সংগঠন এ অনুষ্ঠানের আয়োজন করে। অনুষ্ঠানটি পরিচালনা করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক সি আর আবরার।
আইনজীবী ড. শাহদীন মালিক বলেন, ‘গণমাধ্যমে এ আইনের ৩২ ধারায় অনুসন্ধানী সাংবাদিকতার গুপ্তচর বৃত্তির বিষয়টি উঠে এলেও এ আইনের আরও ভয়াবহ দিক রয়ে গেছে। যা আমাদের দৃষ্টিকে দূরে সরিয়ে দিয়েছে। এ আইনের পরে হয় তো বাকস্বাধীনতা বলে আর কিছু থাকবে না।’
তিনি বলেন, ‘মাইকের সামনে কথা বললে হয় তো বাকস্বাধীনতা থাকবে। তবে সমস্যা হবে মিডিয়া যদি কম্পিউটার, ইন্টারনেটের মাধ্যমে কথা প্রকাশ করে তখন কনসিকুয়েন্স কী হবে? হয়তো মাইকে বললে কিছুটা আইনি তর্ক করতে পারব যে কম্পিউটারে আমি কিছু প্রকাশ করি নাই।’
ড. শাহদীন মালিক বলেন, ‘অনেক কিছু আইন হয়ে যায়, আমরা খেয়াল করি না। বিশাল ভূমিকম্প হয়ে যায়। ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনেও কিন্তু ভূমিকম্প হয়ে গেছে। বাকস্বাধীনতা শেষ হয়ে যাবে। আমরা যে কম্পিউটার ব্যবহার করি তার অধিকাংশ পাইরেটেড কপি। সুতরাং আপনি যা-ই লিখেন, চাইলে পাইরেট সফটওয়্যার দিয়ে আপনি লিখেছেন বলে এ আইনে একটি অপরাধ সংঘটনের অভিযোগ আনা যাবে। সুতরাং এটা সাংঘাতিক ভয়াবহ অবস্থা হয়ে গেছে।’
এ আইনের সমালোচনা করে তিনি বলেন, ‘১৭৯১ সালে অর্থাৎ সোয়া দু’শ বছর আগে আমেরিকার সংবিধানে বলা হলো— বাকস্বাধীনতা খর্ব হতে পারে এমন কোনো আইন কংগ্রেস করতে পারবে না। অথচ এখন আমরা চিন্তা করি আমেরিকার ১৭৯১ সাল থেকে আমরা কত পিছিয়ে আছি।’
তিনি বলেন, ‘কিছু বললেই অপরাধ হবে, এমন আইন এখন পাশ হয়ে গেছে। আমেরিকার সোয়া দুইশ বছর আগের গণতন্ত্রে হয় তো আমরা যেতে পারব না। কিন্তু দুই-একটা বিষয়ে কথা বলতে পারব, সে অধিকারটাও আমার থাকবে না।’
কম্পিউটার হ্যাকিং সংক্রান্ত একটা আইনের দরকার ছিল এবং এ আইনে ওই সংক্রান্ত কিছু ধারা আছে, যেটার প্রয়োজনীয়তা অস্বীকার করা যায় না। কিন্তু এর সঙ্গে সব ধরনের কথা বলাটা কেমন করে চলে এলো? কম্পিউটারের বিষয়ের শাস্তির পাশাপাশি আমার মনে হয় এর পেছনে বড় উদ্দেশ্য ছিল কথা বলা বন্ধ করা।
তিনি আরও বলেন, ‘অনেকে দেখলাম রাষ্ট্রপতির কাছে সই না দেয়ার জন্য অনুরোধ করেছেন। আমি যতদূর জানি ১৯৯১ সাল থেকে আবদুর রহমান থেকে আবদুল হামিদ পর্যন্ত ৩০ বছরে শুধু একজন রাষ্ট্রপতি একটা বা দুইটা আইনের ধারাতে আপত্তি দিয়েছিলেন। এখন আমরা এই রাষ্ট্রপতির কাছে অনুনয় বিনয় করছি। সম্পাদক পরিষদের এই ছেলেমানুষি দেখে আমি অবাক হচ্ছি।’
এ সময় তিনি এ আইনের ৪, ৫, ৬, ৭, ৮, ১২ থেকে ১৪ ধারার বিভিন্ন বিষয়ে তুলে ধরেন।
সুপ্রিমকোর্টের আরেক আইনজীবী ব্যারিস্টার জ্যোতির্ময় বড়ুয়া আলোকচিত্রী পাঠশালার প্রতিষ্ঠাতা শহিদুল আলমকে গ্রেফতার করার বিষয়টি উল্লেখ করে বলেন, ‘একজন ভিডিও লাইভে কী বলল সে কারণে ৬০ দিন ধরে জেলে আটকে থাকবে? তাহলে তো যারা কোটি কোটি টাকা লোপাট করে দিচ্ছে, পাচার করে দিচ্ছে তাদের চৌদ্দগোষ্ঠী সবাইকে পুরোটা সময় জেলে কাটানো উচিত। শাস্তি আসলে নির্ধারণ করছে কে?’
‘আমরা বারবার যে বিষয়টি গুলিয়ে ফেলছি বা সরকার আমাদের গুলিয়ে ফেলার জন্য বিভিন্ন রকমের ডোজ দিয়ে এ পরিবেশ তৈরি করছে, সেটা হলো- রাষ্ট্র ধারণাটা সরকার-রাষ্ট্রের মধ্যে একাকার করে দেওয়া এবং এর মধ্যে নাগরিকদের উপেক্ষা করা। আমি জানি না নাগরিকদের উপেক্ষা করে রাষ্ট্র হয় কী করে? সরকার হয় কী করে।’
এ আইন ফ্রিল্যান্স লেখকদের ওপর বেশ প্রভাব পড়বে উল্লেখ করে ব্যারিস্টার জ্যোতির্ময় বলেন, ‘ফ্রিল্যান্সার হলে তিনি ৩২ ধারায়ও পড়বেন। তবে যিনি প্রাতিষ্ঠানিকভাবে কোন মিডিয়ার সঙ্গে যুক্ত আছেন তাদের একটা আইডেনটিটি আছে। তার পক্ষে ফাইট দেওয়ার জন্য একটা হাউজ আছে। কিন্তু ফ্রিল্যান্সারের জন্য কেউ নাই।’
ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের বিভিন্ন নেতিবাচক দিক তুলে ধরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের অধ্যাপক মুহাম্মদ মাহবুবুর রহমান বলেন, ‘বাংলাদেশের পাশাপাশি ভারত ও পাকিস্তানের আইন পর্যালোচনা করলে দেখা যাবে বাংলাদেশে সাইবার ক্রাইম সব থেকে বেশি। সেই সঙ্গে বাংলাদেশে শাস্তি অন্যদের তুলনায় ভয়াবহ। যেখানে ভারত বা বাংলাদেশে শাস্তি দুই বছর, একই অপরাধে বাংলাদেশ শাস্তি যাবজ্জীবন।’
সারাবাংলা/এজেডকে/একে