Friday 22 Nov 2024
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

এক সত্য নিরীক্ষকের গল্প, সত্যই যার ঈশ্বর


২ অক্টোবর ২০১৮ ১০:৩২

।। সারাবাংলা ডেস্ক ।।

সমগ্র জীবনকে সত্য অনুসন্ধানের বৃহৎ উদ্দেশ্যে উৎসর্গ করেছিলেন মহাত্মা গান্ধী। তিনি নিজের ভুল থেকে শিক্ষা নিয়ে এবং নিজের ওপর নিরীক্ষা চালিয়ে তা অর্জন করেছিলেন। নিজের আত্মজীবনীর নাম দিয়েছিলেন ‘দ্য স্টোরি অফ মাই এক্সপেরিমেন্টস উইথ ট্রুথ’ যার অর্থ সত্যকে নিয়ে আমার নিরীক্ষার গল্প। গান্ধী বলতেন তার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ যুদ্ধ ছিল নিজের অন্তঃকার ভয় ও নিরাপত্তাহীনতাকে কাটিয়ে ওঠা। তিনি প্রথমে তার বিশ্বাসকে সংক্ষিপ্ত করে বলতেন, ঈশ্বর হল সত্য। পরবর্তীতে মত বদলে বলেন, সত্যই হল ঈশ্বর।

বিজ্ঞাপন

মোহনদাস করমচাঁদ গান্ধী। ভারতে এবং বিশ্বজুড়ে মহাত্মা (মহান আত্মা) এবং বাপু (বাবা) নামে পরিচিত। ভারত সরকার তাকে সম্মানার্থে দেশটির জাতির জনক হিসেবে ঘোষণা করেছে। ১৮৬৯ সালের ২ অক্টোবর তিনি গুজরাটে জন্মগ্রহণ করেন। আজ তার ১৪৯তম জন্মবার্ষিকী।

একজন শিক্ষিত ব্রিটিশ আইনজীবী হিসেবে, মহাত্মা গান্ধী তার অহিংস শান্তিপূর্ণ নাগরিক আন্দোলনের মতাদর্শ প্রয়োগ করেন দক্ষিণ আফ্রিকায় নিপীড়িত ভারতীয় সম্প্রদায়ের নাগরিকদের অধিকার আদায়ের আন্দোলনে। পরে ভারতে ফিরে এসে কয়েকজন দুঃস্থ কৃষক এবং দিনমজুরকে সঙ্গে নিয়ে বৈষম্যমূলক কর আদায় ব্যবস্থা এবং বহু বিস্তৃত বৈষম্যের বিরুদ্ধে আন্দোলন গড়ে তোলেন।

রাজনৈতিক জীবনের শুরুতে ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের নেতৃত্বে আসার পর গান্ধী সমগ্র ভারতব্যাপী দারিদ্র্য দূরীকরণ, নারী স্বাধীনতা, বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠির মধ্যে ভ্রাতৃত্ব প্রতিষ্ঠা, বর্ণ বৈষম্য দূরীকরণ, জাতির অর্থনৈতিক সচ্ছলতাসহ বিভিন্ন বিষয়ে প্রচার শুরু করেন। তবে এর সবগুলোই ছিল স্বরাজ অর্থাৎ ভারতকে বিদেশি শাসন থেকে মুক্ত করার লক্ষ্যে।

বিজ্ঞাপন

মহাত্মা গান্ধী সমস্ত পরিস্থিতিতেই অহিংস মতবাদ এবং সত্যের ব্যাপারে অটল থেকেছেন। তিনি সাধারণ জীবনযাপন করতেন এবং একটি আশ্রম প্রতিষ্ঠা করেছিলেন যেটি ছিল স্বয়ংসম্পূর্ণ। তার নিজের পরিধেয় কাপড় ছিল ঐতিহ্যবাহী ভারতীয় ধুতি এবং শাল যা তিনি নিজেই চরকায় বুনতেন। তিনি সাধারণ নিরামিষ খাবার খেতেন। শেষ জীবনে ফলমূ্লই বেশি খেতেন। আত্মশুদ্ধি এবং প্রতিবাদের কারণে দীর্ঘ সময়ের জন্য উপবাস থাকতেন।

১৮৮৩ সালে মাত্র ১৩ বছর বয়সে মহাত্মা গান্ধী তার বাবা মায়ের পছন্দে কস্তুরবা মাখাঞ্জীকে (কাস্তুবাই নামেও পরিচিত ছিলেন) বিয়ে করেন। তাদের চার পুত্র সন্তান জন্ম নেয় যাদের নাম হরিলাল গান্ধী, মনিলাল গান্ধী, রামদাস গান্ধী এবং দেবদাস গান্ধী। মহাত্মা গান্ধী তার ছোটবেলায় পোরবন্দর ও রাজকোটের ছাত্রজীবনে মাঝারি মানের ছাত্র ছিলেন। কোনো রকমে গুজরাটের ভবনগরের সামালদাস কলেজ থেকে ম্যাট্রিকুলেশন পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন। তিনি কলেজেও সুখী ছিলেন না কারণ তার পরিবারের ইচ্ছা ছিল তিনি ব্যারিস্টার হন। ১৮ বছর বয়সে ১৮৮৮ সালের ৪ঠা সেপ্টেম্বর ব্যারিস্টারি পড়ার জন্য ইউনিভার্সিটি কলেজ লন্ডনে যান।

লন্ডন থেকে ব্যরিস্টারি পড়া শেষ করে তিনি দক্ষিণ আফ্রিকায় যান আইনজীবী হিসেবে তার ক্যারিয়ার শুরু করার জন্য। দক্ষিণ আফ্রিকা গান্ধীর জীবনকে নাটকীয়ভাবে পরবর্তন করে দেয়। এখানে তিনি ভারতীয় ও কৃষ্ণাঙ্গদের প্রতি সাধারণভাবে প্রচলিত বৈষম্যের শিকার হন। একদিন ডারবানের আদালতে ম্যাজিস্ট্রেট তার পাগড়ি সরিয়ে ফেলতে বলেন। গান্ধী তা অগ্রাহ্য করেন এবং আদালত কক্ষ থেকে ক্ষোভে বেরিয়ে পড়েন। তাকে পিটার ম্যারিজবার্গের একটি ট্রেনের প্রথম শ্রেণির কামরা থেকে তৃতীয় শ্রেণির কামরায় যেতে বাধ্য করা হয়, প্রথম শ্রেণির বৈধ টিকিট থাকা স্বত্ত্বেও। স্টেজকোচে ভ্রমণের সময় একজন চালক তাকে প্রহার করে কারণ তিনি এক ইউরোপীয় যাত্রীকে জায়গা করে দেয়ার জন্য ফুট বোর্ডে চড়তে রাজি হননি। যাত্রাপথে তাকে আরও কষ্ট করতে হয় এবং অনেক হোটেল থেকে তাকে বহিষ্কার করা হয়। এই ঘটনাগুলোকে তার পরবর্তী সামাজিক কার্যকলাপের মোড় ঘুরিয়ে দেওয়ার পেছনে মুখ্য ভূমিকা রাখে। ভারতীয়দের বিরুদ্ধে বর্ণবাদ, কুসংস্কার এবং অবিচার লক্ষ করে গান্ধী তার জনগণের মর্যাদা এবং অবস্থান নিয়ে প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে ওঠেন। ১৮৯৪ সালে গান্ধী নাটাল ইন্ডিয়ান কংগ্রেস প্রতিষ্ঠা করেন। এই সংগঠনের মাধ্যমে সেখানকার ভারতীয়দেরকে রাজনৈতিকভাবে সংঘবদ্ধ করেন। ১৮৯৭ সালের জানুয়ারিতে ভারতে এক সংক্ষিপ্ত সফর শেষে ফিরে আসার পর এক শ্বেতাঙ্গ মব তাকে প্রাণে মেরে ফেলার চেষ্টা করে। গান্ধী এই মব সদস্যদের বিরুদ্ধে কোনো অভিযোগ করেননি। কারণ তার মতে, কারও ব্যক্তিগত ভুলের জন্য পুরো দলের বিরুদ্ধে প্রতিশোধ নেওয়াকে তিনি সমর্থন করেন না।

১৯২১ সালের ডিসেম্বর মাঝে মহাত্মা গান্ধী ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের নির্বাহী দায়িত্বপ্রাপ্ত হন। তার নেতৃত্বে কংগ্রেস স্বরাজের লক্ষ্যকে সামনে রেখে নতুন সংবিধান গ্রহণ করেন। পার্টিকে একটি অভিজাত প্রতিষ্ঠান থেকে জাতীয় জনগণের আকর্ষণে রূপান্তর করেন। গান্ধী তার অহিংস নীতির পরিবর্ধন করেন স্বদেশি পলিসি যোগ করে। স্বদেশি পলিসি মতে সকল বিদেশি পণ্য বিশেষত ব্রিটিশ পণ্য বর্জন করা হয়। এর পথ ধরে তিনি সকল ভারতীয়কে ব্রিটিশ পোশাকের বদলে খাদি পরার আহ্বান জানান। এ ছাড়া ব্রিটিশ পণ্য বর্জনের মাধ্যমে, গান্ধী জনগণকে ব্রিটিশ শিক্ষা প্রতিষ্ঠান অফিস আদালত বর্জনের সরকারি চাকরি র্থেকে ইস্তফা এবং ব্রিটিশ উপাধি বর্জনের ডাক দেন।

গান্ধী ১৯২০ এর দশকের বেশির ভাগ সময় নীরব থাকেন, এ সময় তিনি স্বরাজ পার্টি এবং ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের মাঝে বাধা দূর করতে চেষ্টা করেন। অস্পৃশ্যতা, মদ্যপান, অবজ্ঞা এবং দারিদ্রতার বিরুদ্ধে সংগ্রাম অব্যাহত রাখেন। ১৯২৮ সালে তিনি আবার সামনে এগিয়ে আসেন। এর আগের বছর ব্রিটিশ সরকার স্যার জন সাইমনের নেতৃত্বে একটি নতুন সংবিধান সংশোধনী কমিশন গঠন করেন। যাতে একজনও ভারতীয় ছিল না। ফলে ভারতীয় রাজনৈতিক দলগুলো কমিশনকে বর্জন করে।

১৯২৯ সালে সালের ৩১ ডিসেম্বর ভারতীয় পতাকার উন্মোচন হয় লাহোরে। ১৯৩০ সালের ২৬ জানুয়ারি লাহোর মিলিত হয়ে ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেস দিনটিকে ভাতীয় স্বাধীনতা দিবস হিসেবে উৎযাপন করে। অন্যান্য প্রায় সকল প্রতিষ্ঠান ও এই দিনটিকে উৎযাপন করে। ঘোষণামত গান্ধী লবণের ওপর কর আরোপের বিরুদ্ধে নতুন সত্যাগ্রহ অভিযান শুরু করেন। ১৯৩০ সালের মার্চে এই উদ্দেশ্যে তিনি ডান্ডির উদ্দেশ্যে লবণ হাঁটা আয়োজন করেন ও ১২ই মার্চ থেকে ৬ এপ্রিল পর্যন্ত ৪০০ কিলোমিটার হেঁটে এলাহাবাদ থেকে ডান্ডিতে পৌঁছান নিজের হাতে লবণ তৈরির জন্য।

 

হাজার হাজার ভারতীয় তার সঙ্গে হেঁটে সাগরের তীরের পৌছান। এটি ছিল ব্রিটিশ শাসনের বিরুদ্ধে তার আন্যতম সফল প্রয়াস। ব্রিটিশরা এর বদলা নিতে ৬০ হাজার ব্যক্তিকে গ্রেপ্তার করে। সরকার গান্ধীর সাথে সমঝোতা করতে লর্ড এডওয়ার্ড আরউইনকে প্রতিনিধি নিয়োগ করে। গান্ধী-আর উইন প্যাক্টস হয় ১৯৪১ সালের মার্চ মাসে সরকার সকল গণ অসহযোগ আন্দোলন বন্ধের বিনিময় সকল রাজবন্দীদের মুক্তি দিতে রাজি হয়।

এ ছাড়াও গান্ধীকে গোল টেবিল বৈঠকের জন্য লণ্ডনে আমন্ত্রণ জাননো হয়। সেখানে তিনি একাই কংগ্রেসের প্রতিনিধিত্ব করেন। আলোচনা ভারতীয় যুবরাজ ও সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের উপর অনুষ্ঠিত হয় গান্ধী ও অন্যান্য জাতীয়তাবাদীদের নিরাশ করে। লর্ড আরউইনের স্থলাভিষিক্ত লর্ড উইলিংডন জাতীয়তাবাদীদের বিরুদ্ধে নতুন কর্মসূচি ঘোষণা করেন। গান্ধী পুনরায় গ্রেপ্তার হন এবং সরকার তার প্রভাব কাটিয়ে উঠতে তাকে সম্পূর্ণরূপে তার অনুসারীদের থেকে বিচ্ছিন্ন করে ফেলে। পদ্ধতিটি অবশ্য সফল হয়নি। ১৯৩২ সালে দলিত নেতা বি আর আম্বেদকারের প্রচেষ্টার ভিত্তিতে সরকারী নতুন সংবিধানের আওতায় অস্পৃম্শ্যদের জন্য আলাদা ইলেকটোরেট আয়োজন করে। এর প্রতিবাদে গান্ধী ১৯৩২ সালের সেপ্টেম্বরে ৬ দিনের অনশন পালন করের এবং এতে সরকার বাধ্য হয়ে দলিত ক্রিকেটার ও পরবর্তীকালে রাজনৈতিক নেতা পালওয়াঙ্কার বালুর মধ্যস্থ্যতায় আরও গ্রহণযোগ্য ব্যবস্থা প্রদান করে। এরপরই গান্ধী দলিত যাদের তিনি হরিজন বা ঈশ্বরের সন্তান নাম দিয়েছিলেন, সেই অস্পৃশ্যদের জীবনযাত্রার মান উন্নয়নে এক নতুন অগ্রযাত্রার সূচনা করেন। ১৯৩৩ সালের ৮ মে তিনি হরিজন আন্দোলনকে এগিয়ে নেবার লক্ষ্যে ২১ দিনের জন্য আত্মশুদ্ধি অনশন করেন।

১৯৪৮ সালের ৩০ জানুয়ারি গান্ধীকে গুলি করে হত্যা করা হয়। সে সময় তিনি নতুন দিল্লীর বিরলা ভবনে (বিরলা হাউস) রাত্রিকালীন পথসভা করছিলেন। তার হত্যাকারী নাথুরাম গডসে ছিলেন একজন হিন্দু মৌলবাদী যার সাথে চরমপন্থী হিন্দু মহাসভার যোগাযোগ ছিল। হিন্দু মহাসভা পাকিস্তানীদের অর্থ সাহায্য দেবার প্রস্তাব করে ভারতকে দূর্বল করার জন্য গান্ধীকে দোষারোপ করে। গডসে এবং সহায়তাকারী নারায়ণ আপতেকে পরবর্তীতে আইনের আওতায় এনে দোষী সাব্যস্ত করা হয়। ১৯৪৯ সালের ১৪ নভেম্বর তাদের ফাঁসি দেওয়া হয়। নতুন দিল্লীর রাজঘাটের স্মুতিসৌধে আছে ‘হে রাম’ যাকে অনুবাদ করে বলা যায় ‘ও ঈশ্বর’ এই শব্দ দুটিকে গান্ধীর শেষ কথা বলে বিশ্বাস করা হয়, অবশ্য এই উক্তির সত্যতা নিয়ে সন্দেহ আছে।

জওহরলাল নেহরু রেডিওতে জাতীর উদ্দশ্যে ভাষণে বলেন: ‘বন্ধু ও সহযোদ্ধারা আমাদের জীবন থেকে আলো হারিয়ে গেছে, এবং সেখানে শুধুই অন্ধকার এবং আমি ঠিক জানি না আপনাদের কি বলব কেমন করে বলব। আমাদের প্রেমময় নেতা যাকে আমরা বাপু বলে থাকি, আমাদের জাতীর পিতা আর নেই। হয়ত এভাবে বলায় আমার ভুল হচ্ছে তবে আমরা আর তাকে দেখতে পাব না যাকে আমরা বহুদিন ধরে দেখেছি, আমরা আর উপদেশ কিংবা স্বান্ত্বনার জন্য তার কাছে ছুটে যাব না, এবং এটি এক ভয়াবহ আঘাত, শুধু আমার জন্যই নয়, এই দেশের লক্ষ লক্ষ মানুষের জন্য।’

গান্ধীর ইচ্ছানুযায়ী, তার দেহভস্ম বিম্বের বেশ কয়েকটি প্রধান নদী যেমন: নীলনদ, ভোলগা, টেমস প্রভৃতিতে ডুবানো হয়। সামান্য অংশ ড. ভি এম নোলের (পুণের একজন সাংবাদিক ও প্রকাশক) পক্ষ থেকে পরমহংস যোগানন্দকে পৌছে দেওয়া হয়। এরপর তার দেহভস্ম সেলফ রিয়ালাইজেশন ফেলোশিপ লেক স্রাইনের মহাত্মা গান্ধী বিশ্ব শান্তি সৌধে একটি হাজার বছরের পুরনো চৈনিক পাথরের পাত্রে সংরক্ষণ করা হয়।

সারাবাংলা/এমআই

মহাত্মা গান্ধী

বিজ্ঞাপন

আরো

সম্পর্কিত খবর