‘কোনো সুযোগসন্ধানী মহল ছাত্রদের কাজে লাগাতে পারে’
২ অক্টোবর ২০১৮ ২০:১৮
।। জাকিয়া আহমেদ, স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট ।।
ঢাকা: আমার মনে হয়, কোনো সুযোগ সন্ধানী মহল এই ছাত্রদের কাজে লাগাতে পারে। কোনো ইস্যু জিইয়ে রাখার চেষ্টা হতে পারে, যেন প্রতিষ্ঠান ‘আনরেস্ট’ থাকে। এখনতো যেকোনো ইস্যুতেই শিক্ষা প্রতিষ্ঠান আনরেস্ট করার সুযোগ খোঁজে সবাই। এসবই আমার ধারণা- বলছিলেন ঢাকা ডেন্টাল কলেজের নবনিযুক্ত অধ্যক্ষ অধ্যাপক ডা. হুমায়ুন কবীর বুলবুল।
ঢাকা ডেন্টাল কলেজের অধ্যক্ষকে আচমকা ওএসডি করার পর তার পুনর্বহালের দাবিতে শিক্ষার্থীদের বিক্ষোভ ও ক্লাস বর্জনের ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে তিনি এসব কথা বলেন। তিনি আরও বলেন, যেভাবেই হোক, ঘটনাটি আমার ওপর এসে পড়েছে। এটি আনফরচুনেট, আনএক্সপেকটেড।
ডা. আবুল কালাম বেপারীকে বিশেষ ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওএসডি) থেকে অধ্যক্ষ পদে পুনর্বহাল করে প্রজ্ঞাপন জারির আগ পর্যন্ত ক্লাসে ফিরবেন না বলে জানিয়েছেন ঢাকা ডেন্টাল কলেজের শিক্ষার্থীরা। তারা বলছেন, অধ্যক্ষ হিসেবে তারা ডা. বেপারীকেই চান। অন্যথায় তিনি শিক্ষার্থীদের বোঝাতে এলেও ডা. বেপারীকেও তারা ক্যাম্পাসে ঢুকতে দেবেন না।
গত ১৬ সেপ্টেম্বর ঢাকা ডেন্টাল কলেজের অধ্যক্ষ আবুল কালাম বেপারীকে ওএসডি করা হয়। তার জায়গায় সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজের ডেন্টাল ইউনিটের প্রধান হুমায়ন কবীরকে অধ্যক্ষ পদে নিয়োগ দেওয়া হয়। ডা. আবুল কালাম বেপারীকে অধ্যক্ষ হিসেবে পুনর্বহালের দাবিতে আজ (মঙ্গলবার) ঢাকা ডেন্টাল কলেজে টানা ১৭ দিনের মতো ক্লাস বর্জন করছেন শিক্ষার্থীরা। স্থগিত রয়েছে সব পরীক্ষা।
তারা বলছেন, নতুন অধ্যক্ষকে নিয়ে তাদের কোনো আপত্তি নেই। তবে অধ্যক্ষ আবুল কালাম বেপারী তাদের কলেজের জন্য অনেক উন্নয়নমূলক কাজ করেছেন। তিনি তাদের অভিভাবক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। হঠাৎ করে কোনো কারণ ছাড়াই তাকে অধ্যক্ষ পদ থেকে সরিয়ে দেওয়া হয়েছে। এ ঘটনায় তারা ক্ষুব্ধ এবং ডা. বেপারীর পুনর্বহাল চান।
ডা. আবুল কালামকে অধ্যক্ষ হিসেবে পুনর্বহালের প্রজ্ঞাপন জারির আগ পর্যন্ত তারা ক্লাস বর্জন চালিয়ে যাবেন- এমনটিই শিক্ষার্থীদের বক্তব্য। আন্দোলনের অংশ হিসেবে শিক্ষার্থীরা সবগুলো গেটে তালা ঝুলিয়েছেন। সরকারি আদেশের পরিপ্রেক্ষিতে ২৬ সেপ্টেম্বর নতুন কর্মস্থলে যোগ দিয়ে এসে বিড়ম্বনায় পড়েছেন ডা. হুমায়ুন কবীর বুলবুল। অধ্যক্ষের কক্ষে ঢুকতেও তাকে বাধা দেওয়া হয়।
ডা. হুমায়ুন কবীর বুলবুলের সারাবাংলার প্রতিবেদকের কথা হয় কলেজ ক্যাম্পাসের মূল ফটকের বাইরে। তিনি একটি চেয়ারে বসে, পেছনে মূল ফটক- বন্ধ। দাফতরিক কাজ করছিলেন তিনি। জানালেন, আগামী ৫ অক্টোবর অনুষ্ঠেয় মেডিকেল ভর্তি পরীক্ষার কাজে ব্যস্ত সময় পার করছেন ডা. হুমায়ুন কবীর। বন্ধ দরজার ওপারে তখন ‘জয় বাংলা’ স্লোগানে মুখরিত।
ক্যাম্পাসে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর পাশাপাশি সেখানে দেখানে দেখা গেল, বাংলাদেশ আওয়ামী স্বেচ্ছাসেবক লীগের কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী সংসদের যুগ্ম-সাধারণ সম্পাদক গাজী মেজবাউল হোসেন সাচ্চু।
শিক্ষার্থীদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, গত ১৫ সেপ্টেম্বর কলেজে আয়োজিত এক অনুষ্ঠানে ডা. আবুল কালামের বিরুদ্ধে অব্যবস্থাপনার অভিযোগ ওঠে। সেখানে প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন স্বাস্থ্যমন্ত্রী মোহাম্মদ নাসিম। অব্যবস্থাপনার অভিযোগেই তাকে ওএসডি করা হয়ে থাকতে পারে- জানাচ্ছে সূত্রগুলো।
ডেন্টাল কলেজ ঘুরে দেখা যায়, শিক্ষকরা এখানে সেখানে গোল হয়ে বসে রয়েছেন। শিক্ষার্থীরা ভেতরে স্লোগান দিচ্ছে। নবনিযুক্ত অধ্যক্ষ অধ্যাপক হুমায়ুন কবীর বুলবুল তার দাফতরিক কাজ সারছেন মূল ফটকের বাইরে বসে।
সারাবাংলাকে তিনি বলেন, ‘এই পরিস্থিতি কোনো স্যাবোটাজ হতেও পারে। স্যাবোটাজ করার জন্য যেখানে যা উপাদান পাওয়া যাবে…এটা তারও অংশ হতে পারে- নাও হতে পারে। আমি প্রিন্সিপাল, তাদের অভিভাবক। তারা আন্দোলন করবে শিক্ষার উপকরণ নিয়ে, তারা আমার কাছে আসবে নানা অসুবিধা নিয়ে, ক্লাস না হলে তারা আমার কাছে আসবে। একটি কলেজে একজন অধ্যক্ষ যাবেন, আরেকজন আসবেন এটাই নিয়ম।’
আমি সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজে শিক্ষকতা করছি, ডেন্টাল অনুষদের প্রধান ছিলাম। কলেজের প্রতিষ্ঠালগ্ন থেকে আমি ডেন্টাল অনুষদের প্রধান হিসেবে কাজ করেছি, সেখানে শিক্ষার্থীবান্ধব হিসেবে সুনাম ছিল। এখানকার শিক্ষার্থীদের সঙ্গে যদি ন্যূনতম সর্ম্পকও থাকতো বা আমি কিছুটা সময় যদি তাদের জন্য কাজ করতে পারতাম তাহলে তারা বুঝতো, তারা সঠিক পথে যাচ্ছে না। আমার সঙ্গে তারা যদি আধা ঘণ্টা কথা বলতো…। ২৫ সেপ্টেম্বর সন্ধ্যায় অর্ডার পেয়ে পরদিন সকালেই জয়েন করার জন্য সরকার থেকে আদেশ ছিল। আমি এখানে বসে জয়েনিং লেটার দিয়েছি। গত ১৬ সেপ্টেম্বর আগের অধ্যক্ষকে ওএসডি করা হয়েছে, তারপর পদ খালি ছিল। আমাকে পদায়ন করা হয়েছে ২৫ সেপ্টেম্বর। এমন না যে, কাউকে সরিয়ে দিয়ে আমাকে দেওয়া হয়েছে।
“আমি প্রথম দিন এখানে এসে শিক্ষার্থীদের বলেছিলাম, আমার খুব ভালো লাগছে তোমরা একজন শিক্ষককে ফিরে পাওয়ার জন্য আন্দোলন করছো। একজন শিক্ষকের অর্জন এটাই। পুলিশ আমাকে বারবার বলেছে, তারা কঠোর হবে। আমরা সেটা হতে দেইনি। একজন শিক্ষক হিসেবে সেটা আমরা হতে দিতে পারি না। আমিও এই কলেজেরই ছাত্র, কিন্তু এই কলেজ তখন ছিল ঢাকা মেডিকেল কলেজ ক্যাম্পসে। এই ক্যাম্পাস হয়েছে ২২ বছর আগে আর আমি পাস করেছি ৩০ বছর আগে। এটা ঠিক এই ক্যাম্পাসটাও আমার কাছে নতুন, তেমনি নতুন শিক্ষার্থীরাও।” বলেন তিনি।
ক্যাম্পাস সূত্রে জানা গেছে, আগামীকাল (বুধবার) সকালে সাবেক অধ্যক্ষ অধ্যাপক ডা. আবুল কালাম বেপারী আসবেন। এই প্রসঙ্গে নবনিযুক্ত অধ্যক্ষ বলেন, আজই তার আসার কথা ছিল। কিন্তু অসুস্থতার কারণে তিনি আসতে পারেননি। তিনি শিক্ষার্থীদের সঙ্গে কথা বলতে চেয়েছেন। আশা করা যায়, তাতে তারা আন্দোলন থেকে ফিরে আসবে।
অধ্যাপক হুমায়ুন কবীর বলেন, আমি গতকাল এখান থেকে বের হওয়ার পর মন্ত্রণালয় থেকে ফোন পাই। আমাকে কলেজে ফিরে আসতে বলা হয়। জানানো হয়, আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী, মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তা এবং জেলা প্রশাসনের মেজিস্ট্রেট থাকবেন। আমি কলেজে পৌঁছানোর আগেই তারা উপস্থিত হন। কলেজের পরিচালকও উপস্থিত ছিলেন। ছাত্ররা বিভ্রান্ত হয়েছে, ওরা মনে করেছে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীকে আমি এনেছি। কিন্তু বিষয়টা তা না। আমি এসেছিলাম মন্ত্রণালয়ের নির্দেশে। আমার কোনো অফিস আওয়ার নেই, আগামী ৫ অক্টোবর মেডিকেলে পরীক্ষা হবে। সব মেডিকেল কলেজ অধ্যক্ষের এখন অনেক কাজ। আমারও কাজ রয়েছে, সেই কাজ করতেই আমাকে এখানে আসতে হয়েছিল। কেবল আমি না, ভর্তি পরীক্ষায় যারা দায়িত্ব পালন করবেন, কলেজের প্রত্যেক কর্মকর্তা, কর্মচারী ব্যস্ত। এটা রাষ্ট্রীয় দায়িত্ব, পালন করতেই হবে।
ডেন্টাল চিকিৎসকদের সংগঠন বাংলাদেশ ডেন্টাল অ্যাসোসিয়েশনের এই মহাসচিব বলেন, বাংলাদেশ ডেন্টাল অ্যাসোসিয়েশনের নির্বাচিত মহাসচিব আমি, আমি তাদের অভিভাবকও। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনক, আমি আজ এখানে এসে বিব্রত। আমাকে বাইরে অফিস করতে হচ্ছে, আমি রুমেও যাইনি।
এই কলেজ দেশের একমাত্র সরকারি ডেন্টাল কলেজ। এই কলেজের শিক্ষার্থীদের অনেক দূর নিয়ে যাওয়া সম্ভব, মন্তব্য করেন অধ্যাপক ডা. হুমায়ুন কবীর।
সারাবাংলা/এটি