ইসলামে বাকস্বাধীনতা ও জবাবদিহিতা
৫ অক্টোবর ২০১৮ ১৪:২৪
।। জহির উদ্দিন বাবর।।
ঢাকা: অর্ধ পৃথিবীজুড়ে তখন মুসলমানদের শাসন। ইসলামি খেলাফতের সবচেয়ে রমরমা অবস্থা। হজরত উমর ফারুক রা. হলেন সেই খেলাফতের কেন্দ্রীয় ব্যক্তিত্ব মুসলমানদের খলিফা। ন্যায় ও ইনসাফের পরাকাষ্ঠা হিসেবে তিনি সবার কাছে পরিচিত ও প্রশংসিত। রাষ্ট্রের প্রতিটি নাগরিক তার উত্তম শাসনে সন্তুষ্ট। কারো কোনো খেদ নেই। মুসলমানদের সাপ্তাহিক ঈদ পবিত্র জুমার দিন। মদিনার মসজিদ লোকে লোকারণ্য। সবার প্রিয় খলিফা হজরত ওমর রা. নামাজপূর্ব খুতবা দিতে দাঁড়ালেন। চারদিকে পিনপতন নীরবতা। সবাই উদগ্রীব হয়ে বসে আছেন খলিফা কী বলেন তা শোনার জন্য।
উমর রা. যথারীতি শুরু করলেন তার খুতবা। এমন সময় মুসলিমদের মধ্য থেকে একজন দাঁড়িয়ে গেলেন। সবাই অবাক বিস্ময়ে তাকিয়ে আছেন সেই লোকটির দিকে। মদিনার অতি সাধারণ এই লোকটি উমরের মতো পরাক্রমশালী শাসককে কী বলবেন গুরুত্বপূর্ণ এই মুহূর্তে! লোকটি দৃঢ়কণ্ঠে অভিযোগ করলেন খলিফা উমরের প্রতি- ‘আমরা একটি জামা জুটাতে পারি না। আপনি আমাদের শাসক, আপনার গায়ে কেন দুটি জামা?’ লোকটির কথা শুনে হজরত ওমর রা. একটুও বিচলিত হলেন না। তার চেহারায় রাগের কোনো চিহ্নও দেখা গেল না।
অত্যন্ত নির্লিপ্ত কণ্ঠে জবাব দিলেন, ‘আপনার অভিযোগ ঠিক আছে। তবে প্রকৃত ঘটনা হচ্ছে, আমার জামা একটিই, অপরটি আমার ছেলের। সে তার জামাটি আমাকে দিয়েছে শীতের প্রকোপ থেকে বাঁচার জন্য। কারণ, আমি ঠাণ্ডাজনিত অসুস্থতায় ভুগছি।’
খলিফার মুখের জবাব শুনে ওই লোকটি সন্তুষ্ট হলেন। উমর রা. খুতবা চালিয়ে গেলেন। তার ঔদার্যপূর্ণ আচরণ দেখে সবাই অভিভূত হলেন।
উপরের ঘটনাটি ইসলামের শাশ্বত সুন্দর কাঠামোর অনুপম দৃষ্টান্ত। বাকস্বাধীনতা ও জবাবদিহিতার অতুলনীয় নজির। ইসলামের দৃষ্টিতে প্রতিটি মানুষই স্বাধীন মতামত পেশ করার অধিকার রাখে। মুক্তচিন্তা ও মতামত যদি কারও ব্যক্তিগত, সামাজিক ও ধর্মীয় অধিকারে আঘাত না করে তবে ইসলাম তাকে উৎসাহিত করে। ইসলামের সোনালি যুগে একজন সাধারণ নাগরিকেরও সে অধিকার ছিল। রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ কর্তাব্যক্তিটিও জবাবদিহিতার ঊর্ধ্বে ছিলেন না। সচেতন নাগরিকের পরামর্শ, অভিযোগ ও অনুযোগ অত্যন্ত গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করতেন কর্তা ব্যক্তিরা। এটাকে তারা নিজেদের সঠিক পথে চলার পাথেয় হিসেবে মনে করতেন।
রাসুল সা. বিদায় হজের ঐতিহাসিক ভাষণে মানুষে-মানুষে যে কৃত্রিম ভেদাভেদ তা নির্মূল করে দিয়েছেন।
তিনি বলেছেন, ‘অনারবের ওপর আরবের, গরিবের ওপর ধনীর, শাসিতের ওপর শাসকের মানুষ হিসেবে কোনো শ্রেষ্ঠত্ব নেই।’
পৃথিবীর সূচনালগ্ন থেকে চলে আসা কৃত্রিম ভেদাভেদ ও উঁচু-নিচুর পার্থক্য দূর করে দিয়ে ইসলাম মানুষকে স্বাধীন করে দিয়েছে। শ্রেষ্ঠ জীব হিসেবে সে তার খোদাপ্রদত্ত মেধা ও প্রতিভার প্রকাশ ঘটাতে পারবে। নিজের চিন্তাশক্তি ও ভাবনাকে কাজে লাগিয়ে নতুন পথ ও পন্থা আবিষ্কার করতে পারবে। সুষ্ঠু সুশীল সমাজ বিনির্মাণে প্রয়োজনীয় অবদান রাখার সুযোগ তার রয়েছে।
আমরা কেউই জবাবদিহিতার বাইরে নই। স্ব স্ব অবস্থান ও কর্মক্ষেত্রে প্রত্যেকেই জবাবদিহিতার মুখোমুখি হতে হয়। রাসুল সা. বলেছেন, ‘তোমরা প্রত্যেকেই দায়িত্বশীল এবং প্রত্যেকেই নিজ নিজ দায়িত্ব সম্পর্কে জিজ্ঞাসিত হবে।’
জবাবদিহিতা না থাকলে কোনো ব্যবস্থাপনাই সুষ্ঠু ধারায় পরিচালিত হতে পারে না। যখন কেউ নিজেকে জবাবদিহিতার ঊর্ধ্বে ভাবতে থাকে তখনই সামাজিক কাঠামোতে বিশৃঙ্খলা দেখা দেয়। আর জবাবদিহিতা নিশ্চিত হয় বাকস্বাধীনতার চর্চা অব্যাহত থাকলে। এ জন্য বাকস্বাধীনতা ও জবাবদিহিতা পারস্পরিক সম্পর্কযুক্ত। গতিশীল সমাজব্যবস্থার স্বার্থেই বাক স্বাধীনতার চর্চা অব্যাহত রাখা জরুরি।
একটি আদর্শ সমাজব্যবস্থার জন্য বাকস্বাধীনতার কোনো বিকল্প নেই। তবে এ কথাও সত্যি যে, অনিয়ন্ত্রিত বাকস্বাধীনতা যার উদ্দেশ্য মহৎ নয় তা দেশ ও জাতির জন্য অপূরণীয় ক্ষতি বয়ে আনে। এ জন্য বাকস্বাধীনতা চর্চা হতে হবে অত্যন্ত দায়িত্বশীলতার সঙ্গে, যৌক্তিক ও নৈতিক মানদণ্ডে। মুক্তচিন্তার দোহাই দিয়ে হীন স্বার্থ চরিতার্থ করতে অনিয়ন্ত্রিত ও লাগামহীন মতামত ব্যক্ত করা যাবে না। মানবাধিকার লঙ্ঘন হয়, রাষ্ট্রীয় সার্বভৌমত্ব হুমকির মুখে পড়ে কিংবা ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত লাগে এমন মন্তব্য থেকে বেঁচে থাকতে হবে সবাইকে।
লেখক: সভাপতি, বাংলাদেশ ইসলামী লেখক ফোরাম
সারাবাংলা/একে