জোসনা জামান, স্টাফ করেসপন্ডেন্ট
আর্সেনিকের কারণে সরকারের নিরাপদ পানি সরবরাহে অর্জিত সাফল্য ম্লান হয়ে গেছে। ’৮০-এর দশকে নলকূপ প্রযুক্তির মাধ্যমে পানি সরবরাহের ব্যাপ্তি অর্জিত হয় ৯৭ শতাংশ। এটি ছিল দক্ষিণ-পূর্ব এশিয় অঞ্চলের সর্বোচ্চ। কিন্তু নব্বই দশকের শুরুর দিকে ভূ-গর্ভস্থ পানিতে আর্সেনিক দেখা দেওয়ায় পানি সরবরাহের ব্যাপ্তি ৭৪ শতাংশে নামিয়ে দেয়। এ অবস্থা থেকে উত্তরণে ইতোমধ্যেই নানা পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে। তারপরও আগের অবস্থায় ফিরে যাওয়া সম্ভব হয়নি। এ পরিপ্রেক্ষিতে ‘পানি সরবরাহে আর্সেনিক ঝুঁকি নিরসন’ শীর্ষক একটি প্রকল্প হাতে নিচ্ছে স্থানীয় সরকার পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রণালয়।
পরিকল্পনা কমিশনে প্রস্তাবিত প্রকল্পটির ব্যয় ধরা হয়েছে ১ হাজার ৯৯০ কোটি ৯৫ লাখ টাকা। পুরোপুরি সরকারের অর্থায়নেই চলতি জানুয়ারি থেকে ২০২১ সালের মধ্যে প্রকল্পটি বাস্তবায়নের লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়েছে। এটি বাস্তবায়ন করবে জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তর। ইতোমধ্যেই প্রকল্পটি অনুমোদনের প্রক্রিয়া শেষ হয়েছে। জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটির (একনেক) আগামী সভায় অনুমোদনের জন্য প্রকল্পটি উপস্থাপন করা হতে পারে।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে প্রকল্পটির দায়িত্বপ্রাপ্ত পরিকল্পনা কমিশনের সহকারী প্রধান আব্দুল্লাহ আল মোত্তাসিম বিল্লাহ সারাবাংলাকে বলেন, আমরা এরই মধ্যে প্রকল্পটি অনুমোদনের জন্য সুপারিশ করে একনেক অনুবিভাগে পাঠিয়েছি। এখন তারাই সিদ্ধান্ত নেবেন কোন দিন একনেকে উপস্থাপন করা হবে।
প্রকল্পের প্রস্তাবনায় বলা হয়েছে, প্রকল্পটির সামগ্রিক লক্ষ্যমাত্রা হল অতিমাত্রায় আর্সেনিক ঝুঁকিপূর্ণ এলাকাগুলোর মানুষের স্বাস্থ্য ও জীবনমান উন্নয়ন করা। এছাড়া অন্য লক্ষ্যগুলো হচ্ছে, বিদ্যমান নলকূপের পানিতে আর্সেনিক দূষণের পরিমাণ নিরূপণ, প্রকল্প এলাকায় আর্সেনিক মুক্ত নিরাপদ পানি সরবরাহ করা এবং স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানগুলো এবং সাধারণ মানুষের সক্ষমতা বাড়ানোর মাধ্যমে নিরাপদ পানি পান নিশ্চিত করা হবে।
স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়, নিরাপদ পানির সহজলভ্যতা সাধারণ মানুষের স্বাস্থ্য ও আর্থ-সামাজিক উন্নয়নের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ নির্ধারক। মানুষের ব্যবহার্য পানি হওয়া উচিত নিরাপদ ও বিশুদ্ধ। পর্যাপ্ত নিরাপদ পানীয় জলের অভাবে বর্তমান সমাজ এমনকি ভবিষ্যৎ প্রজন্মের স্বাস্থ্য ও হুমকির সম্মুখীন হবে। নিরাপদ পানীয় জলের সংস্থান সামগ্রিক সামাজিক উন্নয়নের একটি পূর্বশর্ত।
গত শতাব্দীর শেষ নাগাদ, বাংলাদেশ ভূ-গর্ভস্থ পানির উৎস ব্যবহারের মাধ্যমে নলকূপ প্রযুক্তির মাধ্যমে পানি সরবরাহের ব্যাপ্তি ৯৭ শতাংশ অর্জনে সক্ষম হয়, যা ছিল দক্ষিণ-পূর্ব এশীয় অঞ্চলে সর্বোচ্চ। কিন্তু নব্বই এর দশকের শুরুর দিকে ভূ-গর্ভস্থ পানিতে বিশেষত, অগভীর স্তরে আর্সেনিকের উপস্থিতি সনাক্তকরণ এই প্রশংসনীয় সাফল্যকে স্লান করে দেয়, যা নিরাপদ পানি সরবরাহ ব্যাপ্তিকে ৯৭ শতাংশ থেকে ৭৪ শতাংশে কমিয়ে আনে। এ সময় দেশের ৬৪ জেলার মধ্যে ৬১ জেলাতেই পানীয় জলে আর্সেনিকের শনাক্ত করা হয়। শনাক্তকরণের পরবর্তী সময় থেকে আর্সেনিক দূষণ তীব্রতা হ্রাস করার জন্য নানামুখী পদক্ষেপ ও কর্মসূচি নেয়া হয়েছে। এভাবে আর্সেনিক দূষণ মাত্রা ক্রমান্বয়ে বৃদ্ধি ও তা হ্রাসকরণে বিভিন্ন সময়ে পদক্ষেপ নেওয়ার ফলে বর্তমানে নিরাপদ পানি সরবরাহ ব্যাপ্তি ৮৭ শতাংশে উন্নীত হয়। কিন্তু এসব প্রচেষ্টা সত্ত্বেও দেশের উল্লেখযোগ্য সংখ্যক মানুষ এখনও পানীয় জলের ক্ষেত্রে আর্সেনিক ঝুঁকিতে রয়েছে।
সূত্র জানায়, ২০০৯ সালে আর্সেনিক দূষণ পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণের জন্য ডিপিএইচই-জাইকা যৌথভাবে সিচুয়েশন অ্যানালাইসিস অব আর্সেনিক মিটিগেশন ২০০৯ নামক একটি সমীক্ষা পরিচালনা করে। সমীক্ষা এলাকা নির্বাচনে বাংলাদেশ আর্সেনিক মিটিগেশন ওয়াটার সাপ্লাই প্রজেক্ট (বিএএমডব্লিউএসপি-২০০৪) এর আওতায় পরিচালিত জরিপ প্রতিবেদন ও ডিপিএইচ ইউনিসেফ জরিপ-২০০৩ এর ফলাফলের পাশাপাশি মাঠ পর্যায় থেকে সংশ্লিষ্ট জেলার নির্বাহী প্রকৌশলী, জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তর এর নিকট হতে প্রাপ্ত তথ্য বিবেচনা করা হয়। সমীক্ষাটি দেশের তৎকালীন ৭টি প্রশাসনিক বিভাগের ৫৫টি জেলার ৩০১টি উপজেলায় পরিচালিত। এই সমীক্ষায় ২ হাজার ৯৯৮টি ইউনিয়ন এবং ১৩৪টি পৌরসভা অন্তর্ভুক্ত ছিল। সেখানে আর্সেনিকের ভয়াবহতার চিত্র উঠে আসে।
প্রকল্পের প্রধান কার্যক্রম গুলো হচ্ছে, ৩ হাজার ২০০ ইউনিয়ন আর্সেনিক শনাক্তকরণ কার্যাবলী, গবেষণা ও উন্নয়নমূলক কার্যক্রম, সেফ ওয়াটার ডিভাইস স্থাপন, ৯৯ হাজার ৮৯৮টি ডিপ টিউবওয়েল, ৫২ হাজার ৬৩৮টি তারা পাম্প ডিপ টিউবওয়েল, ১ হাজার ১৫৬টি পন্ডস্যান্ড ফিল্টার, ২ হাজার ৩৯০টি রিং ওয়েল, ৯৫৫টি রেইন ওয়াটার হার্ভেষ্টিং, ৬২টি রুরাল পাইপড ওয়াটার সাপ্লাই স্কিম, ৩৫টি লবণাক্ত দূরীকরণ প্লান্ট, ৪ হাজার ৭২৩টি আর্সেনিক আয়রন রিমুভাল প্লান্টসহ পানির উৎস, ২ হাজার ৫৮০টি পরীক্ষামূলক নলকূপ, ২টি ডাবল কেবিন পিক-আপ, ১১৭টি মোটর সাইকেল এবং বিভিন্ন ধরণের যন্ত্রপাতি ক্রয় করা হবে।
সারাবাংলা/জেজে/এসআই