এমপির সামনে হাঁটু গেড়ে করজোড়ে নতমস্তকে এ কেমন সম্মান!
১১ অক্টোবর ২০১৮ ২২:১৮
।। জাকিয়া আহমেদ, স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট ।।
ঢাকা: ব্যাকগ্রাউন্ডে গান বাজছে, ‘ধনধান্যে পুষ্পে ভরা, আমাদেরই বসুন্ধরা….এমন দেশটি কোথাও খুঁজে পাবে নাকো তুমি, সকল দেশের রাণী সে যে আমার জন্মভূমি’। কক্ষের সামনে চেয়ারে বসে আছেন ঝিকরগাছা-চৌগাছা আসনের (যশোর -২ ) সংসদ সদস্য অ্যাডভোকেট মনিরুল ইসলাম মনির, স্কুলের প্রধান শিক্ষক মো. শাহজাহান, চৌগাছা উপজেলা আওয়ামী লীগের সাবেক সভাপতি মো. শাহজান কবির, চৌগাছা উপজেলা আওয়ামী লীগের সাবেক যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাস্টার সিরাজুল ইসলামসহ অন্যরা।
ফেসবুকে ছড়িয়ে পড়া ভিডিওটিতে দেখা যায়, কক্ষের মাঝের সারি দিয়ে স্কুলড্রেস পরা কয়েকজন বালিকা শিক্ষার্থী ফুলের মালা হাতে এগিয়ে আসছে। প্রথম জন মালা হাতে দাঁড়িয়ে গেলো সংসদ সদস্য মনিরুল ইসলাম মনিরের সামনে। একে একে পর্যায়ক্রমে অন্যরা বসে থাকা অতিথির সামনে গিয়ে দাঁড়িয়ে কিছুসময় পরে হাঁটু গেড়ে বসে পড়ে। এভাবে তারা সাতবার হাঁটু গেড়ে বসেছে এবং উঠে দাঁড়িয়েছে। পরে তারা অতিথিদের গলায় ফুলের মালা পরিয়ে দিয়ে হাত জোড় করে ফিরে যায় নিজেদের আসনে।
বৃহস্পতিবার (১১ অক্টোবর) এই ভিডিও ছড়িয়ে পড়েছে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে। এর পরপরই ভিডিওটি নিয়ে সমালোচনা শুরু হয়। সেখানে বলা হচ্ছে, এ যেন জমিদারি প্রথা। একজন সংসদ সদস্য, যিনি কিনা একজন আইনজীবীও, তিনি কি করে মধ্যযুগীয় কায়দায় এ ধরনের সম্মাননা নিতে পারলেন? একই সঙ্গে বিদ্যালয় কর্তৃপক্ষেরও সমালোচনা করেছেন অনেকেই।
যশোরের চৌগাছায় কথা বলে জানা যায়, ঘটনাটি যশোহরের চৌগাছা হাকিমপুর ইউনিয়নের এবিসিডি মাধ্যমিক বিদ্যালয় যা স্থানীয়ভাবে ‘দেবিপুর’ মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের।
বৃহস্পতিবার বেলা ১১ টার দিকে বিদ্যালয়টির নতুন ভবন এর ভিত্তি প্রস্তর স্থাপনের দিন এই অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়। সেখানেই সংসদ সদস্য অ্যাডভোকেট মনিরুল ইসলাম মনির প্রধান অতিথি হিসেবে ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করতে যান। সেখানেই তাকে সংবর্ধনা জানানোর জন্য স্কুল কর্তৃপক্ষ এই আয়োজন করেন।
ঘটনাটির বিষয়ে সারাবাংলা এ প্রতিবেদকের কথা হয়, চৌগাছা হাকিমপুর ইউনিয়নের এবিসিডি মাধ্যমিক বিদ্যালয় প্রধান শিক্ষক মো. শাহজাহানের সঙ্গে। তিনি প্রথমে বলেন, আজ এখানে আবহাওয়া খারাপ ছিল, প্রাকৃতিক দুর্যোগ ছিল, রুমের মধ্যে গ্যাদারিং অবস্থায়……। ওই রকম…..।
তিনি বলেন, ‘বসার কোনও পরিবেশ ছিল না, একটা ফাঁকা রুমে এমপি স্যারসহ মেহমানদের বসিয়ে অনুষ্ঠানটা চলছিল। আমার শিক্ষকরা এ অনুষ্ঠানের দায়িত্বে ছিলেন।’
আপনি আগে থেকে জানতেন কিনা জানতে চাইলে তিনি বলেন, এমপি স্যার যখন…….। ফুলের মালা দেওয়ার কথা ছিল….। এটা এ পর্যায়ে যাবে সেটা ভাবিনি। তবে এর ম্যানেজমেন্টের দায়িত্বে অন্য টিচাররা ছিল বলেও জানান তিনি।
তবে ওই শিক্ষকের ফোন নাম্বার চাইলে তিনি তা দিতে অপারগতা প্রকাশ করে বলেন, আমাদের ভুল হয়েছে। নেক্সট টাইম এমন আর হবে না, জীবনে কখনও হবে না।…এটা ঠিক হয়নি, ভবিষ্যতে এ ধরনের কাজ আর হবে না।
জানতে চাইলে অনুষ্ঠানের আরেক অতিথি উপজেলা আওয়ামী লীগের সাবেক সভাপতি শাহজান কবির সারাবাংলাকে বলেন, আমরা ফুল-টুল নিতে চাই না। কিন্তু বোঝেন তো, রাজনীতি করি-কতো জায়গায় যাই। সবখানেই নেতা কর্মী আর আয়োজকদের চাপ থাকে। এলাকাতে যখন এমপি আসেন তখন সবাই চায় তাকে সম্মান জানাতে। তারই অংশ হিসেবে এমপি সাহেবকে তারা ফুল দেয়। তারাই চাপ সৃষ্টি করে ফুল নেওয়ার জন্য, তাই নিতে বাধ্য হয়েছি বলেন তিনি । তিনি আরও বলেন, বোঝেন তো সামনে নির্বাচন, এগুলো মেইনটেইন করতেই হয়।
ঘটনা সম্পর্কে জানার জন্য সংসদ সদস্য মনিরুল ইসলাম মনিরকে একাধিকবার ফোন কল এবং ক্ষুদে বার্তা পাঠিয়েও তার সঙ্গে কথা বলা সম্ভব হয়নি।
স্থানীয়রা জানান, সংবর্ধনার এই ভিডিওটি এমপি সাহেব নিজেই আপলোড করেন। কিন্তু পরে আরেকজন সে ভিডিও ডাউনলোড করে শেয়ার করলে তিনি পোস্টটি ডিলিট করে দেন। তার এ কর্মকাণ্ডে ক্ষোভ জানিয়েছেন এলাকার অনেকেই।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একাধিক স্থানীয় বাসিন্দা সারাবাংলাকে বলেন, স্কুল কর্তৃপক্ষ যদি তার মনোরঞ্জনের জন্য আয়োজনটি করেও থাকেন তার উচিত ছিল এটি বন্ধ করা। কারণ তিনি নিজেকে প্রতিষ্ঠিত ও উচ্চশিক্ষিত ব্যক্তি হিসেবে জাহির করে নামের আগে অ্যাডভোকেট ব্যবহার করেন।
ফেসবুকে এই ঘটনার নিন্দা জানিয়ে অনেকেই সংসদ সদস্য মনিরুল ইসলাম মনিরসহ এর সঙ্গে সম্পৃক্ত সবাইকে শাস্তির আওতায় আনার দাবি জানান।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে শিশু অধিকার সংগঠক ও মানুষের জন্য ফাউন্ডেশনের কর্মসূচি সমন্বয়কারী আব্দুল্লা আল মামুন সারাবাংলাকে বলেন, এটা একটি জঘন্য ঘটনা। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের মত সৃজনশীল স্থানে এ ধরনের ঘটনা কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়।
এ ঘটনায় যারাই জড়িত তাদের প্রত্যেককে জবাবদিহিতার আওতায় আনা প্রয়োজন মন্তব্য করে আবদুল্লা আল মামুন বলেন, যারা এই আয়োজনের সাথে জড়িত এবং যারা এই মালা নিয়েছেন প্রত্যেককে এই ঘটনায় জবাবদিহিতার আওতায় আনার দাবি জানাচ্ছি।
আব্দুল্লা আল মামুন ঘটনাটিকে শিশু অধিকারের লংঘন মন্তব্য করে আরও বলেন, এটি শিশু অধিকারের লংঘন। এছাড়া এটি আমাদের সংস্কৃতির ও পরিপন্থী। আমি মনে করি স্থানীয় প্রশাসন ও শিক্ষা প্রশাসনের পক্ষ থেকে অবিলম্বে এ ঘটনার নিরপেক্ষ তদন্ত সাপেক্ষে আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া উচিত।
এ ঘটনার সমালোচনা করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক শাহীদুজ্জামান। তিনি বলেন, উচ্চ আদালত থেকে এই লোকদের কারণ দর্শাতে বলা হোক। কেনো এই ঘটনাকে শিশু নিপীড়ন ও বিকৃত মনন ধরা হবে না? এদেরকে আদালতে তলব করা উচিৎ।
সাবেক ছাত্রনেতা ও কলামিস্ট লীনা পারভীন এই ঘটনায় নিন্দা জানিয়ে বলেন, প্রথম কথা শিশুদের দিয়ে এমন প্রভুভক্তি আপত্তিকর। তাছাড়া যে গান ব্যবহার করে কোরিওগ্রাফি করা হয়েছে সেটা দেশকে অপমান করা। একজন জনপ্রতিনিধি যদি এমন বিষয়কে উদ্বুদ্ধ করেন তবে তা দেশের জন্য হুমকিস্বরূপ। কী শিখবে প্রজন্ম প্রশ্ন করে তিনি বলেন, এমন ঘটনায় রাজনীতিবিদের প্রতি সবার শ্রদ্ধাবোধ উঠে যাবে। দেশ আর নেতা সমান নয়, বলেন লীনা পারভীন।
সারাবাংলা/জেএ/জেডএফ