জন্মনিয়ন্ত্রণে আগ্রহী হচ্ছেন রোহিঙ্গা নারীরা
১৪ অক্টোবর ২০১৮ ০৮:২৫
।। জাকিয়া আহমেদ, স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট ।।
ঢাকা: ২২ বছরের হাসিনা বেগম মিয়ানমার থেকে পালিয়ে বাংলাদেশে আশ্রয় নেন গত বছরের সেপ্টেম্বরের শুরুর দিকে। শ্বশুরবাড়ির সবার সঙ্গে কোনোরকমে প্রাণ হাতে নিয়ে পালিয়ে আসেন হাসিনা। প্রথম সন্তানের জন্মের ১ বছর ৯ মাস পর আবার গর্ভবতী হয়েছেন তিনি।
হাসিনারা থাকছেন উখিয়ার কুতুপালংয়ের রোহিঙ্গা ক্যাম্পে। ক্যাম্পের মধুরছড়া এলাকাতে ক্যাম্পের পাশেই গড়ে উঠেছে হোপ ফাউন্ডেশনের হোপ ফিল্ড হসপিটাল ফর উইমেন। গর্ভবতী হওয়ার পর থেকে এ হাসপাতালেই নিয়মিত চেকআপে আসেন হাসিনা। সেখানেই কথা হয় হাসিনার সঙ্গে। বলেন, ‘সন্তান নিতে চাননি, কিন্তু নিজের অজ্ঞতার কারণে সন্তান পেটে এসেছে। কিন্তু এরপর আর এমন হবে না।’
একই সিদ্ধান্তের কথা জানালেন কুতুপালংয়ের লাম্বাসিয়া ক্যাম্পে মাজুমা খাতুন। দুই বছরের দুই সন্তানের পর মাজুমার কোল জুড়ে এখন ১৯ দিনের ছেলে। মাজুমার ভাই বউয়ের কোলে সাত মাসের মেয়ে। মেয়ের আগে তার আরও দুই সন্তান রয়েছে।
জাতিসংঘের শরণার্থী বিষয়ক সংস্থা ইউএনএইচসিআরের সাম্প্রতিক পরিসংখ্যান থেকে জানা যায়, রোহিঙ্গা ক্যাম্পগুলোতে আশ্রয় নেওয়া শতকরা ৩৯ ভাগ পরিবারের সদস্য সংখ্যা চার থেকে পাঁচ জন। এর বাইরে পাঁচ থেকে আটসদস্যের পরিবার আছে ২১ শতাংশ; আর আট জনের বেশি সদস্য রয়েছে শতকরা তিন ভাগ পরিবারে। ইউএনএইচসিআরের তথ্য অনুযায়ী, মোট ৩০টি রোহিঙ্গা ক্যাম্পে জনসংখ্যায় পুরুষের সংখ্যা ৫২ শতাংশ, নারী ৪৮ শতাংশ। মোট রোহিঙ্গার শতকরা ৫৫ ভাগই শিশু।
গত ১৬ মে জাতিসংঘের শিশু তহবিল ইউনিসেফ জানায়, রোহিঙ্গ ক্যাম্পে প্রতিদিন ৬০টি করে শিশুর জন্ম হচ্ছে। অপরদিকে, আন্তর্জাতিক সংস্থা সেভ দ্য চিলড্রেন থেকে জানা যায়, সঠিক পরিসংখ্যান না থাকলেও চলতি বছরে প্রতিদিন ১৩০টি শিশুর জন্ম হবে বলে মনে করছে তারা।
গত বছরের ২৯ আগস্টে রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠী যখন থেকে বাংলাদেশে আসা শুরু করে তখন থেকেই ক্যাম্পগুলোতে রোহিঙ্গা নারীদের জন্মনিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি গ্রহণ করার জন্য সরকারের পক্ষ থেকে পদক্ষেপ নেওয়া হয়।
স্বাস্থ্য অধিদফতরের পক্ষ থেকে জন্ম নিয়ন্ত্রণের জন্য বড়ি ও কনডম দেওয়া হলেও এসব বিষয়ে তাদের অনাগ্রহ ছিল। জন্মনিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থায় তাদের কোনও আগ্রহই ছিল না। কিন্তু সম্প্রতি কুতুপালং ও উখিয়ার ক্যাম্পগুলোতে ঘুরে সে অবস্থার পরিবর্তন দেখা গিয়েছে। তবে নারীরা আগ্রহী হলেও পুরুষরা তাতে আগ্রহী নন।
শরণার্থী ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনার মো. আবুল কালাম সারাবাংলাকে বলেন, ‘রোহিঙ্গারা মিয়ানমারে জন্ম নিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি সম্পর্কে একেবারেই অজ্ঞ ও অন্ধকারে ছিল। ফলে এটা নিয়ে তাদের কোনো চিন্তা-ভাবনা নেই। তা সত্ত্বেও তাদের সচেতন করার জন্য বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থাগুলো কাজ করে যাচ্ছে।’
রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (আইইডিসিআর) জ্যেষ্ঠ বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা এ এস এম আলমগীর সারাবাংলাকে বলেন, ক্যাম্পগুলোতে দীর্ঘমেয়াদি কন্ট্রাসেপটিভ দেওয়ার জন্য বলা হচ্ছে। পাঁচ বছর মেয়াদি ইমপ্ল্যান্ট দেওয়ার পরামর্শ দেওয়া হচ্ছে।
ক্যাম্পের ‘উইম্যান ফ্রেন্ডলি স্পেসে’ নারীরা বলছেন, ‘নারীরা জন্ম নিয়ন্ত্রণে আগ্রহী হলেও তাতে পুরুষরা আগ্রহী নয়। এখানে যদি কোনও নারী গর্ভবতী না থাকে সেক্ষেত্রে ক্যাম্পের ভেতরেই ধর্ষিত হওয়ার ঝুঁকি অনেক বেড়ে যায়-এরকম একটি কনসেপশন ক্যাম্পে রয়েছে। যার কারণে এখানে জন্মনিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি একেবারেই গড়ে ওঠেনি।’
মাজুমা বলেন, ‘তার ছোট সন্তানের বয়স ১৯ দিন এবং আগামী ৪২ দিন পর থেকেই তিনি জন্ম নিয়ন্ত্রণের যে কোনো পদ্ধতি গ্রহণ করবেন।’
মাজুমা বলেন, ‘মিয়ানমারে জন্মনিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি সর্ম্পকে কিছুই জানতেন না। কিন্তু এখানে আসার পর তিনি জন্ম নিয়ন্ত্রণের নানা পদ্ধতি সর্ম্পকে জেনেছেন এবং এখন তিনি সে সর্ম্পকে আগ্রহী।’
সাত মাসের সন্তানকে কোলে নিয়ে মাজুমার ভাই বউ মেনোকাও জানালেন একই কথা। মেনোকো বলেন, খুব তাড়াতাড়িই তিনি ক্যাম্পের ভেতরে যে কোনো একটি প্রাইমারি কেয়ার সেন্টারে যাবেন। সেখানে গিয়ে ‘ডাক্তার আপা’দের সঙ্গে কথা বলে যে কোনো একটি পদ্ধতি গ্রহণ করবেন।
প্রথম যখন এসেছে তারা একেবারেই অজ্ঞ ছিল। অনেক ধরনের কুসংস্কার তাদের ভেতর কাজ করত-কিন্তু এখন তারা সেখান থেকে সরে আসছে। কিন্তু এই এক বছরে কাউন্সিলিং করার ফলে আগের চেয়ে অনেক উন্নতি হয়েছে। কিন্তু আরও সময় দরকার বলে মন্তব্য করেন কুতুপালং লাম্বাসিয়াতে অবস্থিত বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা ব্র্যাকের প্রাইমারি হেলথ কেয়ারের মেডিকেল অ্যাসিসটেন্ট মো. আরিফুর রহমান।
আরিফুর রহমান বলেন, ‘আমাদের হেলথ কেয়ার গুলোতে পিল, ইনজেকশন, কনডম রয়েছে পর্যাপ্ত। তাদেরকে দিচ্ছি, নিচ্ছেও তারা। অনেকে নিজে থেকেও আসছে-যেটা আমাদের জন্য খুবই পজিটিভ বলে আমরা মনে করছি। তবে আরও সময় লাগবে।’
মাঠ পর্যায়ের কর্মীরা তাদের নিয়ে উঠোন বৈঠকের মতো করছেন, সেখানে তাদেরকে বোঝানো হচ্ছে। বিভিন্ন হেয়ার সেন্টারগুলোতে যখন তারা যায়-সব জায়গায় তাদের সঙ্গে এসব কথা বলা হয় এবং তাতে করে পরিস্থিতির উন্নতি হচ্ছে-নারীরা সচেতন হচ্ছেন, বলেন আরিফুর রহমান।
একই ধরনের কথা বলেন, ‘কক্সবাজারের সিভিল সার্জন আব্দুস সালাম।’
তিনি বলেন, ‘গত এক বছরে কাউন্সিলিং করার ফলাফল একটু পজিটিভ। তবে সেটা খুব ধীর গতির। তারপরও আমরা আশাবাদী, কিন্তু এ জন্য অনেক সময় দরকার। কিন্তু ওরা ইনজেকশনে আগ্রহী হলেও সেটা আমাদের পক্ষ থেকে সাপ্লাই দেওয়া যাচ্ছে না। আমি গত একমাস আগেও এ নিয়ে কথা বলেছি উচ্চপদস্থদের সঙ্গে।’
ইনজেকশন সাপ্লাই নিয়মিত হলে ফলাফল আরেকটু ভালো হতো বলেন আব্দুস সালাম।
সারাবাংলা/জেএ/একে
আরও পড়ুন: রোহিঙ্গা ক্যাম্পে জন্ম নেওয়া শিশুর হিসাব নেই কারও কাছে!