মেরুদণ্ডে আঘাতে অবহেলা নয়, প্রতিরোধে বিপর্যয় এড়ানো যায়
১৬ অক্টোবর ২০১৮ ১৬:২৩
।। জাকিয়া আহমেদ, স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট ।।
ঢাকা: সুমাইয়ার বয়স ১১ বছর। মাস দুয়েক আগে স্কুল থেকে ফেরার সময় রাস্তায় পড়ে যায় সে। ভয়ে বাড়িতে সে কথা জানায়নি সেদিন। মুশকিল হয় ১৫ দিন পরে। পিঠে ব্যথায় ঘুম ভেঙে যায়। তখন সুমাইয়া মাকে জানায়, রাস্তায় পড়ে গিয়ে ব্যথা পেয়েছিল। কিন্তু সুমাইয়ার মা গুরুত্ব দেননি। এরপর ব্যথা তীব্র হতে শুরু করে।
সুমাইয়া তার বাবা-মায়ের সঙ্গে কুমিল্লায় থাকে। সেখানকার এক চিকিৎসক সুমাইয়াকে দেখেন। সব শুনে চিকিৎসক সুমাইয়াকে ঢাকায় নিতে পরামর্শ দেন। এরপর নিয়ে আসা হয় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ে (বিএসএমএমইউ)।
মঙ্গলবার (১৬ অক্টোবর) রোকেয়া বেগম বলছিলেন কথাগুলো। আমার মেয়েটার স্বাস্থ্য বরাবরই ভালো। ভারি শরীর। সুমাইয়া হাঁটতে শেখার পর থেকেই দেখছি, প্রায় প্রায়ই পড়ে যেত। তাই গুরুত্ব দেইনি। কিন্তু এখন বুঝতে পারছি কী ভুল করেছি! মেয়েটা কতটুকু সুস্থ হবে সেই চিন্তায় দিন-রাত এক হয়ে গেছে আমাদের।
নারকেল গাছ থেকে পড়ে গিয়ে পায়ে, পিঠে এবং ঘাড়ে আঘাত পেয়েছিলেন কবীর হোসেন। পায়ে দু’বার অস্ত্রোপচার হয়েছে। পিঠের ব্যথা এখনও কমেনি। চিকিৎসকের পরামর্শে বিএসএমএমইউ হাসপাতালের নিউরো সার্জারি বিভাগে চিকিৎসা নিচ্ছেন। চিকিৎসকরা তাকে জানিয়েছেন, মেরুদণ্ডের ব্যথার কারণে শরীরে অন্যান্য সমস্যা হচ্ছে। নিউরো সার্জারি বিভাগে গিয়ে দেখা গেল, প্রতিটি বেডে রোগী ভর্তি। বিভাগের ১২০টি বেড কখনও খালি থাকে না। দায়িত্বরত নার্স জানালেন, মেরুদণ্ডে আঘাত পাওয়া রোগীর সংখ্যা দিন দিন বাড়ছে।
বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকরা বলছেন, মেরুদণ্ডের সমস্যা তৈরি হলে তার প্রতিকার করা কঠিন, তাই এ ধরনের রোগীর জন্য সুরক্ষার ব্যবস্থা করা জরুরি। পড়ে গিয়ে আঘাত পেয়ে হাত-পা অবশ হয়ে যায়, কোমরে আঘাত পেলেও হাত-পা অবশ হয়ে যায়। আমাদের দেশে এ ধরনের রোগীর সংখ্যা বেড়েই চলেছে। কখনও কখনও এ ধরনের রোগীদের সমস্যা জটিল হলে মলমূত্র বন্ধ হয়ে যায়। সেই সংখ্যাও কম না।
সারা পৃথিবীতে ১৬ অক্টোবর পালন করা হয় ‘ওয়ার্ল্ড স্পাইন ডে’। এবারে দিবসটির প্রতিপাদ্য নির্ধারণ করা হয়েছে, ‘লাভ ইউর স্পাইন। মেরুদণ্ড আপনার অমূল্য সম্পদ, মেরুদণ্ডের যত্ন নিন’। যদিও স্পাইন বা মেরুদণ্ডের জটিলতায় ভুক্তভোগীর সংখ্যা দেশে কত তার কোনও পরিসংখ্যান পাওয়া যায়নি। সঠিক পরিসংখ্যান না থাকলেও এক হাজার মানুষের মধ্যে কমপক্ষে ১৫ থেকে ২০ জন কোমর বা ঘাড়ের ব্যথায় ভুগছেন বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা।
বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকরা বলেন, সাধারণত মেরুদণ্ডের সমস্যা দেখা দিলে রোগীরা ফিজিক্যাল মেডিসিন বিভাগের চিকিৎসকদের কাছে যান। কিন্তু সমস্যা জটিল হলে তখন আর ওষুধ এবং ব্যায়ামে কাজ হয় না, যেতে হয়ে সার্জনের কাছে।
এ প্রসঙ্গে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের নিউরো সার্জারি বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ও নিউরোস্পাইন সোসাইটি অব বাংলাদেশ-এর সাধারণ সম্পাদক ডা. মোহাম্মদ হোসেন সারাবাংলাকে বলেন, মেরুদণ্ডের সমস্যা যদি প্রাথমিক স্তরে ধরা পড়ে তাহলে সেরে যাওয়ার সম্ভাবনা থাকে। তাই মেরুদণ্ডের কোনও সমস্যা অবহেলা করা উচিৎ না। মেরুদণ্ডের সমস্যা থেকে শরীরে নানা ধরনের জটিলতা সৃষ্টি হয়। অস্ত্রোপচারের পরও রোগীর সম্পূর্ণ সুস্থ হয়ে ওঠার সম্ভাবনা খুবই কম থাকে। একটুখানি অবহেলা বড় বিপর্যয় ডেকে আনতে পারে।
এ বিষয়টিতে এবারের প্রতিপাদ্যে জোর দেওয়া হয়েছে জানিয়ে ডা. মোহাম্মদ হোসেন বলেন, এবার বলা হয়েছে ‘লাভ ইউর স্পাইন। মেরুদণ্ডের যে কোনও সমস্যায় অবশ্যই অবহেলা না করে চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে হবে।
কেবল মেরুদণ্ড নয়, সংশ্লিষ্ট লিগামেন্টের সঙ্গে সংযোগ রয়েছে এমন পেশীর যে কোনও অস্বাভাবিক অবস্থাকে স্পাইনাল ডিজিজ বা স্পাইনাল ডিজকমফোর্ট বলে আখ্যায়িত করে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের ফিজিক্যাল মেডিসিন অ্যান্ড রিহ্যাবিলিটেশন বিভাগের অধ্যাপক ডা. এম এ সালেক সারাবাংলাকে বলেন, ব্যাক পেইন সমস্যায় ভুগছেন না এমন মানুষ এখন খুব কম। প্রায় ৭০ থেকে ৮০ শতাংশ মানুষ জীবনে কখনও না কখনও স্পাইন বা ব্যাক পেইনে ভোগেন। তবে আশার কথা হলো, মেরুদণ্ডের চিকিৎসার ক্ষেত্রে কম রোগীদেরই সার্জারির দরকার হয়। যারা চিকিৎসকের কাছে যেতে দেরি করেন, অবহেলা করেন, শুধু তাদেরই সার্জারির দরকার হয়।
শঙ্কা শিশুদের ক্ষেত্রে। একই বিভাগের সহকারী অধ্যাপক ডা. মশিউর রহমান খসরু বলেন, শিশুদের কাঁধে এখন যে ভারি ব্যাগ থাকে- এটা খুবই আশঙ্কাজনক। ভারি ব্যাগের কারণে শিশুদের পিঠে ও ঘাড়ে চাপ পড়ছে। স্কুলে যে চেয়ার-বেঞ্চ রয়েছে, সেগুলোও স্বাস্থ্যসম্মত নয়। যে কারণে এখনকার শিশুরা ছোট থেকেই মেরুদণ্ডের সমস্যা নিয়ে বড় হচ্ছে। এই বিষয়গুলো ভবিষ্যতে তাদের জন্য বড় বিপদ ডেকে আনতে পারে।
যারা দীর্ঘক্ষণ দাঁড়িয়ে কাজ করেন তারাও ঝুঁকিতে রয়েছেন। তবে নিয়মিত চিকিৎসকের নির্দেশিত ব্যায়াম, সঠিক নিয়মে চেয়ারে বসা, সঠিক ভঙ্গিতে হাঁটা, সোজা হয়ে ড্রাইভ করা এবং সঠিক খাদ্যাভাস ও ওজন নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে মেরুদণ্ডের সমস্যা নিয়ন্ত্রণে রাখা যায়, বলেন ডা. মশিউর রহমান।
সারাবাংলা/এটি