Friday 22 Nov 2024
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

মেডিকেল ভর্তিতে প্রথম অর্ণবের প্রেরণা অটিজমে আক্রান্ত ছোট ভাই


১৮ অক্টোবর ২০১৮ ০৯:০০

।। জাকিয়া আহমেদ, স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট ।।

ঢাকা: ছোট ভাই ইশরাক সাদাত অর্পণ অটিজমে আক্রান্ত, অর্থ্যাৎ বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন শিশু। তার সঙ্গেই বেড়ে ওঠা ইশমাম সাকীব অর্ণবের। ছোট ভাইকে দেখেই অর্ণবের মনে ভাবনা জাগে, সমাজে সাধারণভাবে অবহেলিত এসব শিশুদের জন্য বিশেষ কিছু করা দরকার। অর্ণব ভাবেন, ভবিষ্যতে তাকে এমন কিছু হতে হবে যেন বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন এসব শিশদের জন্য কিছু করতে পারবেন, তাদের কাছাকাছি থাকতে পারবেন। তখনই জীবনের লক্ষ্য নির্ধারণ করেন, চিকিৎসক হতে হবে, নিউরো বিভাগে বিশেষায়িত শিক্ষা নিয়ে গবেষণা করতে হবে।

বিজ্ঞাপন

ছোটবেলার এই স্বপ্ন পূরণের পথে অনেকটাই গিয়েছেন অর্ণব। চলতি বছর মেডিকেল কলেজগুলোর ভর্তি পরীক্ষায় পুরো দেশের ৬৩ হাজার ২৬ জনের মধ্যে প্রথম হয়েছেন তিনি। মা-বাবা আর ছোট ভাইয়ের সঙ্গে খুলনায় থাকা অর্ণবের সঙ্গে কথা হয় মোবাইল ফোনে। ফোনেই জানান তার ছোটবেলার কথা, উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষায় পক্সে আক্রান্ত হয়েও অদম্য মনের জোরে পরীক্ষা দিয়ে মেধাতালিকায় স্থান করে নেওয়ার কথা।

আরও পড়ুন: অটিজম, কিছু ভ্রান্ত ধারণা ও বাস্তবতা

মেডিকেল ভর্তি পরীক্ষা, প্রথম স্থান, ইশমাম সাকীব অর্ণব, অটিজম,

অর্ণবদের গ্রামের বাড়ি মাদারীপুরে। তবে সেখানে থাকা হয়নি, মা-বাবার চাকরির জন্য ৩৫ দিন বয়সেই তাকে চলে আসতে হয় খুলনাতে। তবে অর্ণবের লেখাপড়া শুরু হয় যশোরের ব্যাপটিস্ট চার্চ মিশন স্কুলে। পরে কুষ্টিয়ার কলকাকলি বিদ্যালয়ে প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণি আর কুষ্টিয়া জেলা স্কুলে পড়েন তৃতীয় ও চতুর্থ শ্রেণিতে। পঞ্চম শ্রেণিতে এসে অর্ণবকে ভর্তি করা হয় খুলনার সেন্ট জোসেফ উচ্চবিদ্যালয়ে। সেখান থেকেই ২০১৬ সালে মাধ্যমিক পাস করেন, ১২০০ নম্বরের ভেতরে ১১২০ পেয়ে অর্ণব যশোর বোর্ডে সম্মিলিতভাবে নবম স্থান অর্জন করেন।

বিজ্ঞাপন

এসএসসি পর্যন্ত ভালো ফল করে আসা অর্ণবকে নিয়ে উচ্চ মাধ্যমিক আর উচ্চ শিক্ষাতেও আশায় বুক বেঁধেছিলেন পরিবারের সদস্যরা। তবে বাদ সাধে প্রকৃতি। উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষার মধ্যেই পক্সে আক্রান্ত হন তিনি। তবে সেই সময়টিকেই জীবনের ‘টার্নিং পয়েন্ট’ মনে করছেন অর্ণব।

তিনি বলেন, আমি অনেক কষ্ট করে পক্স নিয়ে পুরো পরীক্ষা দিয়েছি। এই বিষয়টি মানসিকভাবে অনেক শক্ত হতে শিখিয়েছে আমাকে। শিখিয়েছে, কী করে জীবনের প্রতিটি ধাপের সঙ্গে নিজেকে মানিয়ে নিয়ে সে অবস্থার মুখোমুখি হতে হয়, সে অনুযায়ী পথ চলতে হয়। আমার কখনও মনে হয়নি, আমি পারব না কিংবা আমাকে দিয়ে হবে না। সবসময় নিজেকে বলেছি, আমাকে পরীক্ষা দিতে হবে এবং যতটুকু প্রস্তুতি নিয়ে গিয়েছিলাম, তার পুরোটুকু নিয়েই পরীক্ষা দিতে হবে। আমি সেসময় নিজের সঙ্গে কথা বলতাম, নিজেকে বোঝাতাম। আর তাতে করেই আমার এ ফল।

উচ্চ মাধ্যমিকের ফল জানতে চাইলে অর্ণব বলেন, আমি যশোর বোর্ডে সম্মিলিতভাবে তৃতীয় হয়েছিলাম। ১৩০০ নম্বরের মধ্যে পেয়েছিলাম ১২০৪।

এরপর তো মেডিকেল কলেজের ভর্তি পরীক্ষায় পুরো দেশের মধ্যেই প্রথম স্থান অধিকার করলেন অর্ণব। এ অর্জনের অনুভূতি কেমন— জানতে চাইলে হেসে ফেলেন অর্ণব। ফোনেই বোঝা যায়, খানিকটা লজ্জাও পেয়েছেন তিনি। বলেন, এটা অন্য এক অনুভূতি, ভাষায় প্রকাশ করার মতো না। এমবিবিএস শেষ করে নিউরো বিষয়ে বিশেষজ্ঞ হওয়ার ইচ্ছার কথাও জানান।

অর্ণবের বাবা আবদুস সোবহান একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে চাকরি করেন। মা হাবিবুন নাহার একসময় চাকরি করলেও ছেলেদের জন্য চাকরি ছেড়েছেন। অর্ণব বলেন, আমাদেরকে সময় দেওয়ার জন্য চাকরি থেকে ছুটি নিয়েছেন।

নিজের এ সাফল্যে কার অবদান বেশি— জানতে চাইলে উত্তর দেন খানিকটা কৌশলে। বলেন, সবার অবদান ছিল, কারও অবদানকে খাটো করে দেখার সুযোগ নেই। আমি বলব, সবার অবদানের সংমিশ্রণই আমাকে এ পর্যায়ে নিয়ে এসেছে।

নিউরোতে পড়ার ইচ্ছা কেন— জানতে চাইলে অর্ণব বলেন, মূলত আমার তিন বছরের ছোট ভাই, ও একজন স্পেশাল চাইল্ড। এই বাচ্চাদের নিয়ে কিছু একটা করার ইচ্ছে আমার ছোটবেলা থেকেই ছিল। নিজের ঘরে এমন একজন থাকার কারণে আমি দেখেছি, ওদের জীবনটা কেমন হয়। আমি ওর সঙ্গেই বড় হয়েছি, দেখেছি খুব কাছ থেকে।

অর্ণব বলে চলেন, ওদের যে স্কুল ছিল, সেখানে আমি মাঝে মাঝেই যেতাম। ওই স্কুলে গেলে মনে হতো, এই বাচ্চাগুলো অবহেলিত, ওরা সমাজের একটা গণ্ডিতে আটকে রয়েছে। এই বাচ্চাগুলোর জন্য যদি একটা কিছু করতে পারি— এটাই ছিল আমার ‘মেইন ড্রাইভিং প্যাশন’। ওর যে অবস্থা, সেটাই আমাকে উৎসাহ জুগিয়েছে।

আরও পড়ুন: প্রতি ১০ হাজারে ১৭ জন শিশু অটিজম বৈশিষ্ট্য সম্পন্ন

মেডিকেল ভর্তি পরীক্ষা, প্রথম স্থান, ইশমাম সাকীব অর্ণব, অটিজম,

ছোটবেলা থেকেই মানুষের এটা-ওটা নানা ধরনের ইচ্ছা থাকে; কিন্তু আমার কোনো ড্রিম ছিল না— এমন জানিয়ে অর্ণব বলেন, ভাইকে দেখে মনের ভেতরে ওদের জন্য কিছু একটা করার স্বপ্ন মনে মনে গেঁথে ফেলি। এদের জন্য কিছু একটা করতে চাই, সেটা অনেকভাবেই করা যায়। কিন্তু চিকিৎসক পেশায় গেলে সবচেয়ে ভালোভাবে, সক্রিয়ভাবে কাজ করতে পারব, বিশেষ করে নিউরোলজি বিষয়টি এ ক্ষেত্রে কার্যকর বলে আমার মনে হয়।

ভাই কি বুঝতে পারছে তার জন্যই বড় ভাইটা কিছু একটা করে ফেলেছে? এমন প্রশ্ন করলে অর্ণব বলেন, এত কিছু না বুঝলেও ভাই যে কিছু একটা করেছে, সেটা সে বুঝতে পারছে। বাসায় মিষ্টি আসছে, ফুল আসছে— এসব কিছু কিন্তু ও বুঝতে পারছে। সে খুব খুশি হয়েছে, আর ওর খুশিটাই আমার কাছে সবচেয়ে আনন্দের বিষয়।

অর্ণব মনে করেন, আমাদের দেশে সুস্থ সোস্যালাইজেশনটা খুব জরুরি। ভার্চুয়াল সোস্যালাইজেশনের প্রবণতা এখন অনেক বেশি, কিন্তু সেটা অনেক ক্ষেত্রে হতাশাও বাড়িয়ে দেয়। সে কারণেই মানুষকে সশরীরে মানুষের কাছে আসতে হবে বলে মনে করেন তিনি। পাশাপাশি সামাজিক ও ধর্মীয় নৈতিকতা চর্চার ওপরও জোর দেন তিনি। এগুলো মাদকাসক্তির মতো সামাজিক সমস্যাগুলো দূর করতে কার্যকরী বলে মত অর্ণবের।

ভবিষ্যতে যারা মেডিকেল পরীক্ষায় বসতে চায়, তাদের জন্য কোনো পরামর্শ রয়েছে কিনা— জানতে চাইলে অর্ণব বলেন, দিনের পড়াটা দিনে শেষ করতে হবে এবং স্বপ্ন দেখতে শিখতে হবে। স্বপ্ন যদি বড় হয়, লক্ষ্য যদি বড় হয়, তাহলে তার পুরোটা না হলেও কাছাকাছি পৌঁছানো যাবে। একইসঙ্গে নিজের কাছে নিজেকে সৎ থাকতে হবে বলেই মনে করেন তিনি।

দিনের পড়া দিনে শেষ করা ছেলেটি যে কেবল সারাদিন পড়ার টেবিলেই পড়ে ছিল, তা কিন্তু নয়। ইশমাম সাকীব অর্ণবের প্রিয় তালিকায় রয়েছে ক্রিকেট-ফুটবল। আর ক্রিকেটে মাশরাফি বিন মর্তুজা প্রিয় অর্ণবের। তার ভাষায়, ‘মাশরাফি ইজ দ্যা রিয়েল বস’। আর ফুটবলে আর্জেন্টিনা পছন্দের না হলেও তার পছন্দের তালিকার ওপরে রয়েছেন মেসি।

পড়ালেখার বাইরে প্রচুর বই পড়ার অভ্যাস ছিল ছোটবেলা থেকেই। সেসব বই থেকে যে চরিত্র তার ভালো লেগেছে, সেখান থেকে সেই ভালোটা নিয়েছেন অর্ণব। এভাবেই ভালোটা কুড়িয়ে নিতে হবে, সবার কাছ থেকে ভালোটা নিয়ে নিজেকে সাজাতে পারলেই সফলতা আসবে,— বলেন অর্ণব।

মা-বাবা দু’জনই খুব সাপোর্টিভ ও বন্ধুত্বসুলভ বলে জানান অর্ণব। তিনি বলেন, ছোট থেকেই তারা পূর্ণ স্বাধীনতা দিয়েছিলেন। সে কারণেই নিজেকে চিনতে পেরেছি। তারা কখনোই কোনো কিছুতে চাপ দেননি যে এটা করতেই হবে।

কথা শেষ হয়ে আসে। শেষ একটা বাক্য বলবেন— বললে আবার হেসে ওঠে ভবিষ্যতের এই চিকিৎসক। বলেন, সবাই দোয়া করবেন যেন এ ফলের ধারা অব্যাহত রাখতে পারি। ‘ফলো ইওর ডুয়িং, ফলো ইওর প্যাশন অ্যান্ড ফলো ইওর মাইন্ড’— তাহলেই জীবনে সফলতা আসবে, বলতে বলতে কথা শেষ করেন অর্ণব।

সারাবাংলা/জেএ/টিআর

অটিজম ইশমাম সাকীব অর্ণব প্রথম স্থান মেডিকেল ভর্তি পরীক্ষা

বিজ্ঞাপন

আরো

সম্পর্কিত খবর