Sunday 08 September 2024
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

‘আপনাদের ভালোবাসায় যেন বাবা বেঁচে থাকেন’


২০ অক্টোবর ২০১৮ ১৭:০১

।। স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট ।।

চট্টগ্রাম ব্যুরো: জন্মস্থান এনায়েত বাজার থেকে নানার বাড়ি পূর্ব মাদারবাড়ি, লালদিঘীর পাড়ে সরকারি মুসলিম হাইস্কুল থেকে আউটার স্টেডিয়াম- জন্মশহর চট্টগ্রামের সবখানেই জড়িয়ে আছে আইয়ুব বাচ্চুর স্মৃতি। জন্মশহরে কখনও গান গাইতে এলেই স্মৃতিকাতর হয়ে পড়তেন আইয়ুব বাচ্চু। গানের ফাঁকে ফাঁকে সেই স্মৃতিগুলো তুলে ধরতেন। বলতেন, হৃদয়জুড়ে চট্টগ্রামকে ধারণ করার কথা।

চট্টগ্রামের পাহাড়, নদী, সাগর তার হৃদয়ে শিল্পসত্তার জন্ম দিয়েছে- এমনও বলতেন আইয়ুব বাচ্চু। নানার বাড়ি যেখানে বেড়ে উঠেছেন এই গিটারের জাদুকর, সেখানে শ্রদ্ধা জানাতে যাওয়া স্বজন-বন্ধু, ভক্ত-অনুরাগীদের মুখে মুখে ফিরছিল চট্টগ্রামের প্রতি আইয়ুব বাচ্চুর ভালোবাসার কথা।

ছেলে আহনাফ তাজোয়ার আইয়ুবও তুলে ধরলেন চট্টগ্রামবাসীর প্রতি বাবার গভীর অনুভূতিটুকু। পূর্ব মাদারবাড়িতে আসার পর চট্টগ্রামবাসীকে দায়িত্ব দিলেন ভালোবাসার মধ্য দিয়ে তার বাবার স্মৃতিটুকু বাঁচিয়ে রাখতে।

আহনাফ তাজোয়ার আইয়ুব সারাবাংলাকে বলেন, ‘বাবার মনে একটা বিষয় ছিল, তিনি হয়তো চট্টগ্রামকে ‘ইনাফ’ দিতে পারছেন না। তবে তিনি আপনাদের (চট্টগ্রামবাসী) খুব ভালোবাসতেন। আমিও চাইব, আপনাদের ভালোবাসায় যেন আমার বাবা বেঁচে থাকেন। যদি আপনাদের মনে হয়, তিনি অন্যায় করেছেন, তাহলে ক্ষমা করে দেবেন। আমরা শুধু দোয়া চাই।’

আকস্মিক মৃত্যুর তিনদিন পর গিটার গুরু আইয়ুব বাচ্চুর নিথর দেহ শনিবার (২০ অক্টোবর) নিয়ে আসা হয় তার জন্মশহর চট্টগ্রামে। সকাল ১০টা ৫৫ মিনিটে ইউএস-বাংলার একটি ফ্লাইটে তার মরদেহ পৌঁছায় চট্টগ্রাম শাহ আমানত আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে। চট্টগ্রামের মেয়র আ জ ম নাছির উদ্দিন মরদেহ গ্রহণ করেন।

দুপুর ১২টায় মরদেহ নেওয়া হয় নগরীর পূর্ব মাদারবাড়ির বালুর মাঠ এলাকায় তার নানার বাড়িতে। চট্টগ্রামের ছেলের মরদেহ আসবে আপন ঠিকানায়, একেকটি নির্ঘুম রাত যেন পার হচ্ছিল এই শহরের আপামর ভক্ত-অনুরাগী, স্বজনদের। ভোর থেকেই পূর্ব মাদারবাড়ির ডিটি রোডে ভিড় জমতে শুরু হয়। পুলিশ এসে লাইন করে দেন শেষ দেখার অপেক্ষায় থাকা ভক্তকূলদের। ঘণ্টার পর ঘণ্টা রোদে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করতে থাকেন তারা। অবশেষে এলেন সঙ্গীত জগতের কিংবদন্তি, কফিনবন্দি হয়ে। ততক্ষণে লাইনে দাঁড়িয়েছেন হাজার হাজার মানুষ। প্রিয় মানুষের কফিন দেখেই কেউ কেউ চোখ মুছতে থাকেন, সশব্দে কাঁদতে থাকেন অনেকে। সতীর্থ, সঙ্গীত জগতের সঙ্গীরা দু’হাতে চোখ ঢাকেন।

জন্মস্থান এনায়েত বাজার থেকে গিয়েছিলেন গৃহবধূ পারভিন আক্তার। কফিনের পাশে দাঁড়াতেই তার কান্নার বাঁধ যেন ভেঙে যায়।

পারভিন আক্তার সারাবাংলাকে বলেন, ‘উনার (বাচ্চু) বাড়ি এবং আমার বাবার বাড়ি পাশাপাশি। ছোটবেলা থেকে উনাকে দেখেছি। গানের জন্য বাসায় যে কত বকা খেয়েছেন, কত কষ্ট সহ্য করেছেন, সব নিজের চোখে দেখেছি। পরকালে যেন মানুষটা শান্তি পায়!’

রিকশাটা ডিটি রোডে একটি হোটেলের সামনে দাঁড় করিয়ে রেখে লাইনে দাঁড়িয়েছিলেন চালক মো. মনা। তিনি সারাবাংলাকে বলেন, উনার গান খুব ভালো লাগত। উনার প্রোগ্রাম আমি অনেকবার দেখছি। মারা গেছেন লোকটা। একবার দেখতে আসছি।

নগরীর জামালখান থেকে একদল তরুণ গেছেন হাতে রুপালি গিটার নিয়ে। গিটার হাতে গিটারের জাদুকরকে শেষ শ্রদ্ধা জানাতে গিয়ে চোখের পানি ধরে রাখতে পারেননি এই তরুণরা।

চট্টগ্রামে গান গাইতে এলে কিংবা বিদেশের কোথাও চট্টগ্রামবাসীর কোনো অনুষ্ঠানে গেলে একটা কথা বলতেনই আইয়ুব বাচ্চু। ‘চিটাগাঙ্গ্যা ফোয়া, মেডিত পইড়ল্যে লোয়া।’ (চট্টগ্রামের ছেলে, জন্ম নেয় লোহা হয়ে)।

পূর্ব মাদারবাড়ি এলাকায় সর্বস্তরের মানুষের শ্রদ্ধা জানানোর অনুষ্ঠানে উপস্থাপক বারবার সেই কথাটি মনে করিয়ে দিচ্ছিলেন।

আইয়ুব বাচ্চুর ঘনিষ্ঠ চট্টগ্রামের সাংবাদিক এজাজ মাহমুদ সারাবাংলাকে বলেন, ‘চট্টগ্রামের একেবারের দূরের কোনো জেলায় বাচ্চু প্রোগ্রাম করতে গেলে, সেখানে যদি একজনও চট্টগ্রামের মানুষ খুঁজে পেত, তার সে কী আনন্দ! চট্টগ্রামের ভাষায় কথা বলে, সুখ-দুঃখের খবর নিয়ে, খাইয়ে তবেই ছাড়ত। চট্টগ্রাম কিংবা কাছাকাছি জেলায় গান গাইতে গেছে আর বাচ্চু চট্টগ্রামের ভাষায় কথা বলেনি, এমন অনুষ্ঠান বোধ হয় নেই। চট্টগ্রামের প্রতি তার এমনই মমত্ববোধ ছিল।’

পূর্ব মাদারবাড়ি ওয়ার্ডের কাউন্সিলর গোলাম মোহাম্মদ জোবায়ের সারাবাংলাকে বলেন, চিটাগাঙ্গ্যা ফোয়া, মেডিত পইরল্যে লোয়া- এই কথাটা যখন বাচ্চু ভাই বলতেন, তখন দর্শক-শ্রোতারা উল্লাসে ফেটে পড়তেন। তিনি জাতীয়ভাবে প্রতিষ্ঠিত হলেও চট্টগ্রামের এই প্রাণের কথাগুলো ভুলে যাননি। আর কোনোদিন আমরা বাচ্চু ভাইয়ের এমন কথা শুনতে পাব না। তিনি নেই, ভাবতেই খারাপ লাগছে।

চট্টগ্রাম শহরে একখণ্ড জমি কিনে একটি বাড়ি করার স্বপ্ন দেখেছিলেন আইয়ুব বাচ্চু, জানালেন চট্টগ্রামের মেয়র আ জ ম নাছির উদ্দিন। মেয়র বলেন, ‘দেখা হলেই আমাকে বলতেন, বদ্দা, আমাকে একটা বাড়ি করার ব্যবস্থা করে দেন। একটা জায়গা ঠিক করে দেন, আমি কিনে নেব। আমি একটা বাড়ি করব। সেখানে আমার বাবাকে রাখব। আমিও এসে থাকব। বাচ্চুকে ছোটবেলা থেকেই আমি চিনি। সে মানুষকে খুব ভালোবাসত। চট্টগ্রামকে ভালোবাসত। জাতীয় পর্যায়ে অবদান রাখার মতো একজন গুণী ব্যক্তিত্বকে আমরা হারালাম।’

আরো পড়ুন : স্মৃতির শহরে নিথর দেহে ফিরলেন রকস্টার

সারাবাংলা/আরডি/এটি

আইয়ুব বাচ্চু আহনাফ তাজোয়ার আইয়ুব চট্টগ্রাম


বিজ্ঞাপন
সর্বশেষ
সম্পর্কিত খবর