মায়ের পাশে চিরঘুমে বাংলা গানের কিংবদন্তি
২০ অক্টোবর ২০১৮ ১৮:৫২
।। স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট।।
চট্টগ্রাম ব্যুরো: গোলাপ দিয়ে গিটার বানিয়ে সেটা নিয়ে এসেছিলেন শোকস্তব্ধ কেউ। কারও হাতে ছিল একটি গোলাপ কিংবা একটি রজনীগন্ধা। কারও চোখে জল, কেউ নির্বাক। ভক্ত-অনুরাগীর স্রোত জমিয়াতুল ফালাহ জাতীয় মসজিদ ময়দান। পূব আকাশের লাল সূর্য যখন বিদায়ের প্রস্তুতি নিচ্ছিল, তখন এই শহরের লাখো ভক্ত-অনুরাগীর কাছ থেকে বিদায় নিচ্ছিলেন সঙ্গীতাকাশের সূর্য আইয়ুব বাচ্চু।
বাংলাদেশের সঙ্গীত জগতের এ কিংবদন্তি কোটি কোটি ভক্ত-অনুরাগীর শেষ শ্রদ্ধাটুকুকে সম্বল করে মায়ের পাশে চিরশায়িত হয়েছেন।
বৃহস্পতিবার (১৯ অক্টোবর) সকালে আকস্মিক হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে মারা যান আইয়ুব বাচ্চু।
তিনদিন পর শনিবার সকালে আইয়ুব বাচ্চুর মরদেহ আনা হয় জন্মশহর চট্টগ্রামে। চট্টগ্রাম শাহ আমানত আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর থেকে মরদেহ নেওয়া হয় আইয়ুব বাচ্চু নানাবাড়ি নগরীর পূর্ব মাদারবাড়িতে, যেখানে বেড়ে উঠেছিলেন এই গিটার জাদুকর। সেখানে আইয়ুব বাচ্চুকে শেষবারের মতো দেখতে হাজার হাজার মানুষের ঢল নামে।
শনিবার দুপুর আড়াইটার দিকে তার মরদেহ নেওয়া হয় জমিয়াতুল ফালাহ জাতীয় মসজিদ ময়দানে। সেখানে মরদেহ নেওয়ার আগে থেকেই হাজার হাজার মানুষের পদচারণা শুরু হয়। আশপাশের সব পথে যেন মানুষের মিছিল। সব পথ মিশে যায় একই মোহনায়।
হাজার হাজার ভক্ত-অনুরাগীর এই ভিড় সামলাতে বেগ পেতে হয় পুলিশকে। কোনোভাবেই সারিবদ্ধ করে রাখা যায়নি জমিয়াতুল ফালাহ ময়দানমুখী মানুষের স্রোত। কফিনবন্দি মরদেহে কেউ ফুল দিয়ে বানানো গিটার তুলে দেন। পুষ্পস্তবক, ব্যানার, প্ল্যাকার্ড দিয়ে গিটারের জাদুকরের প্রতি ভালোবাসা জানান ভক্ত-অনুরাগীরা।
রিদম মিউজিক্যাল শপ ও নোঙর বাড়ি নামের দুটি প্রতিষ্ঠান থেকে ফুল দিয়ে তৈরি গিটার দিয়ে শ্রদ্ধা জানানো হয় আইয়ুব বাচ্চুকে। ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা জানায় মুক্তিযোদ্ধা সংসদ সন্তান কমান্ড, সোলস, চিটাগাং মিউজিক্যাল ব্যান্ড এসোসিয়েশনসহ শতাধিক সংগঠন। ফুলে ফুলে ঢেকে যায় আইয়ুব বাচ্চুকে বহনকারী গাড়িটি।
বাদ আসর জানাজার আগে মরদেহে শ্রদ্ধা জানিয়ে সিটি মেয়র আ জ ম নাছির উদ্দীন বলেন, ‘দাবি উঠেছে আইয়ুব বাচ্চুর নামে একটা সড়ক বা কিছু তার নামে নামকরণের। সিটি করপোরেশনের সাধারণ সভায় এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেব।’
জানাজার মাঠে নগরীর নন্দনকানন বৌদ্ধ মন্দির মোড়ে আইয়ুব বাচ্চুর একটি আবক্ষ ভাস্কর্য স্থাপনের দাবি তোলেন বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির (সিপিবি) সাধারণ সম্পাদক শাহ আলম। সে ব্যাপারেও আশ্বাস দেন মেয়র।
শ্রদ্ধা জানাতে এসে স্মৃতিচারণ করেন নগর আওয়ামী লীগের ভারপ্রাপ্ত সভাপতি মাহতাব উদ্দিন চৌধুরী, দক্ষিণ জেলা আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক মফিজুর রহমান, চট্টগ্রাম মহানগর বিএনপির সভাপতি ডা. শাহাদত হোসেন, বিভাগীয় কমিশনার আব্দুল মান্নান, চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন পুলিশ কমিশনার মো.মাহাবুবর রহমান, নগর যুবলীগের আহ্বায়ক মহিউদ্দিন বাচ্চু, নগর ছাত্রলীগের সভাপতি ইমরান আহমেদ ইমু ও ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক জাকারিয়া দস্তগীর।
স্মৃতিতর্পণের পর জানাজা শেষে আইয়ুব বাচ্চুর মরদেহ বহনকারী গাড়ি সাইরেন বাজিয়ে নিয়ে যাওয়া হচ্ছিল। গন্তব্য চৈতন্য গলি বাইশ মহল্লা কবরস্থান। হাজার হাজার ভক্ত ছুটতে থাকেন সেই গাড়ির পেছনে। যেন চলছে ভক্তদের শোক মিছিল।
পরিবারের পক্ষ থেকে অনুরোধ করা হয়েছিল গণমাধ্যমকর্মীরা যেন কবরস্থানে না যান। কিন্তু যে আইয়ুব বাচ্চু জনতার, কোন অনুরোধে তো তার শেষ যাত্রার প্রত্যক্ষদর্শী হওয়া ঠেকানো যায়নি হাজার হাজার ভক্ত-অনুরাগীর মতো গণমাধ্যম কর্মীদেরও।
সন্ধ্যা নামছিল। পাখিরা ফিরছিল আপন নীড়ে। ঘনিয়ে আসছিল আঁধার। সন্তান-স্বজন, হাজার হাজার ভক্ত-অনুরাগী চোখের জলে শেষ বিদায় জানালেন গান গেয়ে হৃদয় জয় করা ভালোবাসার মানুষটিকে। দশ মাস দশদিন গর্ভে ধারণ করে যিনি এই পৃথিবীর আলো দেখিয়েছিলেন, সেই জননীর পাশে চিরঘুমে শায়িত হলেন আইয়ূব বাচ্চু। ভালোবাসার সঙ্গীতের মঞ্চ থেকে সারা বাংলাদেশের মানুষের মন জয় করা আইয়ুব বাচ্চুর ঠিকানা এখন শুধু ‘সাড়ে তিন হাত মাটি’, তার গানের মতোই।
সারাবাংলা/আরডি/একে
আরও পড়ুন
সড়ক ও জাদুঘরের পরিচিত হবে আইয়ুব বাচ্চুর নামে
জনস্রোত বিদায় জানাল আইয়ুব বাচ্চুকে
বিদায় আইয়ুব বাচ্চু (ভিডিও স্টোরি)
হার্টের ৩০ শতাংশ ক্ষমতা নিয়ে বেঁচে ছিলেন আইয়ুব বাচ্চু
রাষ্ট্রপতি-প্রধানমন্ত্রীর শোক