Tuesday 26 Nov 2024
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

অবহেলিত, অনুচ্চারিত নতুন মায়ের ‘পোস্ট পার্টাম ডিপ্রেশন’


২১ অক্টোবর ২০১৮ ০৮:৩১

।। জাকিয়া আহমেদ, স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট ।।

ঢাকা: সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে চারদিন বয়সী সন্তান এবং শিশুটির মায়ের মৃতদেহের ছবি ঘুরে বেড়াচ্ছে। জানা গেছে, ব্রাহ্মণবাড়িয়ার একটি ক্লিনিকের বিল পরিশোধ করতে না পারছিলেন না এবং পরিবার থেকেও এ নিয়ে তিনি মানসিক অশান্তিতে ছিলেন। তারই পরিপ্রেক্ষিতে চারদিনের বাচ্চাকে কোলে নিয়ে ছাদে যায়। পরে প্রথমে বাচ্চাকে এবং পরে তিনি নিজে ছাদ থেকে লাফিয়ে পড়ে আত্মহত্যা করেন।

বিজ্ঞাপন

গণমাধ্যমে কর্মরত নিশিতা ( ছদ্মনাম)। প্রথম সন্তানের জন্মের পর দশ বছর পর দ্বিতীয় সন্তানের মা হন নিশিতা। কিন্তু সন্তান জন্মানোর পর থেকেই বদলে যেতে থাকে নিশিতার আচরণ। হাসি-খুশি মেয়েটা হয়ে ওঠেন খিটখিটে মেজাজের। পরিবারের কাউকে চিনতেন না, নবজাতক সন্তানকে ব্রেস্ট ফিড করাতেন না। এমনকি তাকে ছুড়ে ফেলে দিতে চাইত।

সেসময়টা ছিল ‘হরিবল’বলেন নিশিতা। সে সময়ের কথা জানতে চাইলে নিশিতা বলেন, ‘আমার মেমোরি লস হয়ে গিলছিল, আমি কাউকে চিনতাম না, খাওয়া দাওয়া বন্ধ হয়ে গিয়েছিল।’

‘আমি সবসময় আমার বড় সন্তানকে খুঁজতাম। যার কারণে ছোট সন্তানকে কোলে নিয়ে বুঝতাম-এটা আমার বড় সন্তান নয়, তখন কোলের সন্তানকে ভাবতাম, অন্য কারও সন্তান। ওকে সহ্য করতে পারতাম না। ওকে দেখিয়ে বলতাম-এটা তো আমার বাচ্চা না, আমার বাচ্চা কোথায়? প্রথমদিকে খুব হাসি-খুশি ছিলাম, খুব বেশি খুশি, অতিরিক্ত আনন্দ-অতিরিক্ত উত্তেজনা ছিল ছোট বাচ্চাকে নিয়ে। কিন্তু এর দশ থেকে পনেরো দিন পরই আমি ঠিক উল্টো আচরণ করতে থাকি’ বলেন নিশিতা।

নিশিতা বলেন, তবে সেসময়ে কথা আমার খুব মনে নেই, ভুলে গিয়েছি সবকিছু। পরে পরিবারের লোকেদের কাছে শুনেছি এ সব কথা। কিন্তু অবস্থা এতটাই ভয়ঙ্কর হয়ে ওঠে যে তাকে প্রথমে মানসিক হাসপাতাল এবং পরে তাকে এক ক্লিনিকে ভর্তি করে চিকিৎসা নিতে হয়। চার থেকে পাঁচ মাস পরে অনেকটা স্বাভাবিক হয়ে ওঠেন নিশিতা।

বিজ্ঞাপন

আরও পড়ুন: ব্রেস্ট ফিডিং কর্নার- মা ও শিশুর অধিকার নাকি বিড়ম্বনা?

মা ও সন্তান, গর্ভধারিণী, মায়ের বিষণ্নতা, স্বাস্থ্য সুরক্ষা

প্রথম বারের মতো যারা মা হন-তাদের মধ্যে শতকরা ৮৫ শতাংশ মা-ই ‘পোস্টপার্টাম ব্লুতে’তে আক্রান্ত হন। কোনো কারণ ছাড়াই এসব মায়েরা কাঁদবেন, হাসবেন, ঝগড়া করবেন, জিদ করবেন, বিষণ্ন হবেন। এটা সাত থেকে দশদিন পর ঠিক হয়ে যায়। কিন্তু যদি কারও বেলায় ঠিক না হয় তখনই সেটা পোস্টপার্টাম ডিপ্রেশন বা পোস্টপার্টাম সাইকোসিসের দিকে যায়-বলছেন চিকিৎসকরা।

চিকিৎসকরা বলছেন, অন্য যে কোনও সময়ের বিষণ্নতার চেয়ে এ বিষণ্নতা গুরুতর হতে পারে। আর এই বিষণ্নতা মাকে দুর্বল করে দেয়, তখন এর ওপর মায়ের কোনো নিয়ন্ত্রণ থাকে না। এটি একটি গুরুতর মানসিক রোগ, যার চিকিৎসা প্রয়োজন, প্রয়োজন মায়ের প্রতি বিশেষ মনোযোগ। অথচ এত গুরত্বপূর্ণ হলেও আমাদের দেশে বিষয়টি অবহেলিত এবং অনুচ্চারিত।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সন্তান জন্মদান পরবর্তী মানসিক সমস্যাগুলোকে তিন ধরনের ভাগে ভাগ করা যায়। যেহেতু সমস্যাগুলো সরাসরি সন্তান জন্মদানের সঙ্গে যুক্ত তাহই তিনটি প্রকাশকে তিনটি নামে ব্যাখ্যা করা হয়। প্রথমটি হচ্ছে, মেটার্নিটি ব্লু বা পোস্টপার্টাম ব্লু, এরপর রয়েছে পিউরপেরাল ডিপ্রেশন বা পোস্টপার্টাম ডিপ্রেশন ( পোস্টপার্টাম মুড ডিজঅর্ডারও বলা হয়ে থাকে) এবং পিউরপেরাল সাইকোসিস বা পোস্টপার্পাম সাইকোসিস। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, তিন ধরনের সমস্যা একে অপরের চাইতে ভিন্ন।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার এক তথ্য থেকে জানা যায়, বিশ্বে ১০ শতাংশ নারী গর্ভাবস্থায় এবং সন্তানের জন্মের পর ১৩ শতাংশ নতুন মা বিষণ্নতায় ভোগেন। আর বাংলাদেশে ১৫ দশমিক ৬ শতাংশ নারী গর্ভাবস্থায় এবং ১৯ দশমিক ৮ শতাংশ নারী সন্তানের জন্মের পর বিষণ্নতায় ভোগেন।

আরও পড়ুন: স্বাস্থ্যখাতে কর্মরত মা, নেই মাতৃত্বের ন্যূনতম সুবিধা

মা ও সন্তান, গর্ভধারিণী, মায়ের বিষণ্নতা, স্বাস্থ্য সুরক্ষা

যখন একজন শিশুর জন্ম হয় তখন স্বাভাবিকভাবেই সবাই ধরে নেয় পরিবারের অন্য সবার মতো শিশুর মাও খুব খুশি এবং আনন্দিত হবেন। কিন্তু অনেক সময়ই নতুন মায়ের মনে আনন্দের বদলে ভর করে হতাশা, তার মেজাজের তারতম্য ঘটে-বিষণ্নতা ভর করে তার মনে। নতুন মায়েদের এ দুঃখবোধকে মূলত ‘প্রসব পরবর্তী বিষণ্নতা’ বা ‘পোস্ট পার্টাম ডিপ্রেশন’ বলা হয়ে থাকে। তব কখনো কখনোও কেবল সন্তান জন্মের পর নয়, সন্তান জন্মের আগে থেকেও মা এই বিষণ্নতাতে আক্রান্ত হতে পারেন।

চিকিৎসকরা বলছেন, প্রসব পরবর্তী সময়ে বিভিন্ন হরমোনের পরিবর্তনের কারণে বিষণ্নতা হয়ে তাকে। প্রসব পরবর্তী ৪৮ ঘণ্টার মধ্যেই ইস্ট্রোজেন, প্রোজেস্টেরন ও কর্টিসোল হরমোনের মাত্রা যেমন একদিকে অনেক কমে আসে তেমনি কম ঘুম বা ঘুম ভেঙে সন্তানকে খাওয়ানো বা অন্যান্য দেখাশোনার কারণে পরিপূর্ণ ঘুম অনেক সময় না হওয়ার কারণেও এ সমস্যা হতে পারে। অপূর্ণ বা অপর্যাপ্ত ঘুম এবং সেই সাথে ক্লান্তি এ দুটোকে অনেকে প্রসব পরবর্তী বিষণ্নতার একটি সহযোগী কারণ বলে মনে করে থাকেন।

যে সব মায়েরা পারিবারিক সহযোগিতা কম পেয়ে থাকে, অথবা আগে কোনো না কোনো মানসিক চাপের মধ্যে থাকলে তাদের ক্ষেত্রে প্রসব পরবর্তী বিষণ্নতার সম্ভাবনা বেশি হয়ে থাকে। যেসব মায়েদের আগে বিষণ্নতার ইতিহাস আছে কিংবা পরিবারের কারো মধ্যে বিষণ্নতার ইতিহাস আছে তাদের ক্ষেত্রে এ সমস্যার ঝুঁকির মাত্রা বেশি হয়ে থাকে। এদিকে যেমন মায়েদের ‘পোস্টপার্টাম ডিপ্রেশন’-এ আক্রান্ত হওয়ার ইতিহাস আছে তাদের ক্ষেত্রে প্রসব পরবর্তী বিষণ্নতা হওয়ার সম্ভাবনা প্রায় ৯০ শতাংশ।

আরও পড়ুন: নতুন মায়ের বিষন্নতা- অবহেলা মানেই বিপদ!

মা ও সন্তান, গর্ভধারিণী, মায়ের বিষণ্নতা, স্বাস্থ্য সুরক্ষা

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের মনোরোগ বিদ্যা বিভাগের বিভাগীয় প্রধান ডা. সালাহউদ্দিন কাউসার বিপ্লব সারাবাংলাকে বলেন, পোস্ট পার্টাম ডিপ্রেশন, পোস্ট পার্টাম সাইকোসিস এবং পোস্ট পার্টাম সিন্ড্রোম-ও হয়ে থাকে নতুন মায়েদের ক্ষেত্রে।

পোস্ট পার্টাম ডিপ্রেশনের বেলায় তার বিষণ্নতা হবে, বাচ্চাসহ তার নিজের মরে যেতে মন চাইবে, কিছু ভালো লাগবে না, নিজেকে নিয়ে হতাশায় ভুগবে। কিন্তু পোস্ট পার্টাম সাইকোসিসে সে গায়েবী আওয়াজ শুনতে পারে, অনেক রোগীরাই এসে বলেন, সে শুনতে পেয়েছেন-কেউ তাকে বলছে ‘বাচ্চাকে মেরে ফেল।’ বাচ্চা থাকলে তার অসুবিধা হবে, ক্ষতি হবে।

যার কারণে পোস্টপার্টাম সাইকোসিস সবচেয়ে কম হলেও সমস্যার মাত্রা ও তীব্রতায় এটি সবচেয়ে ভয়াবহ। এ সমস্যায় মা ও শিশু-দুজনেরই ক্ষতির সম্ভাবনাও সবচেয়ে বেশি এবং জীবন ঝুকিপূর্ণ। যার কারণে এ সময়ে প্রয়োজনীয় চিকিৎসার আওতায় না আনতে পারলে মৃত্যু কিংবা অপমৃত্যু দু ধরনের আশঙ্কাই থেকে যায়। তাই এ সময়ে পরিবারের অন্যদের বুঝতে হবে-এটা একটা রোগ এবং সময় মতো সিদ্ধান্ত নিতে হবে চিকিৎসার।

বর্তমান সময়ে তারা এ ধরনের প্রচুর রোগী পাচ্ছেন জানিয়ে ডা. সালাহউদ্দিন কাউসার বিপ্লব বলেন, ‘অধিকাংশ পরিবারে মনে করা হয়, এটা একটি স্বাভাবিক ঘটনা। স্বাভাবিক ঘটনা ঠিক আছে, কিন্তু নিয়ন্ত্রণের রাইরে গেলে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার ঘটনার মতো এ ধরনের ঘটনা হওয়ার শঙ্কা থাকে। আগেও আমরা এ ধরনের ঘটনা দেখেছি।’

তবে কাউন্সিলিংয়ের সঙ্গে এর কোনো সর্ম্পক নেই, পুরোটাই মেডিকেশনের বিষয়। প্রত্যেকটি পরিবাররই বোঝা উচিত, সঠিক চিকিৎসার আওতায় নিয়ে এলে সুস্থ হয়ে যায় নতুন মা

তাই বিষয়টি নিয়ে গণমাধ্যমে কথা বলা উচিত, সচেতনতা তৈরি করতে হবে। এ ক্ষেত্রে স্ত্রী রোগ বিশেষজ্ঞদের আরও জোরালো ভূমিকা পালন করা দরকার নতুন মায়ের পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে কথা বলে, তাদের সচেতন করে।

‘পোস্ট পার্টাম সাইকোসিস’ হলে পরবর্তী গর্ভধারণের সময় পর্যায়ক্রমে ১০ থেকে ২০ শতাংশ ঝুঁকি বাড়তে থাকে বলে মন্তব্য করেছেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের মনোরোগ বিদ্যা বিভাগের চিকিৎসক অধ্যাপক ডা. সুলতানা আলগিন।

তিনি বলেন, সমাজের সব শ্রেণির মধ্যে প্রথম গর্ভবতী হবার সময়ে এই সমস্যা দেখা যায়। বিশ্বে প্রতি লাখে একজন মানসিক রোগী আছে। তাই উপসর্গ দেখা দিলে এটি একটি রোগ বিবেচনা করে সঙ্গে সঙ্গে চিকিৎসা করানোর পরামর্শ দেন ডা. সুলতানা আলগিন।

সারাবাংলা/জেএ/একে

গর্ভধারিণী পোস্ট পার্টাম ডিপ্রেশন মা ও সন্তান মায়ের বিষণ্নতা স্বাস্থ্য সুরক্ষা

বিজ্ঞাপন

আরো

সম্পর্কিত খবর